ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট জয়

প্রকাশিত: ০৬:৩৭, ৩১ অক্টোবর ২০১৬

ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট জয়

মিথুন আশরাফ ॥ মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ যখন স্লিপে ডাকেটের ক্যাচটি লুফে নিতে পারলেন না, তখন ভয়ই ধরে যায়। এই ক্যাচ ফেলাতেই না আবার ভুগতে হয়। কিন্তু মিরাজ (৬/৭৭) স্বমহীমায় এমনই উজ্জ্বল, বাংলাদেশকে জয়ই এনে দিলেন। সেই জয়টি আবার ইতিহাস রচনা করল। ইংল্যান্ডকে প্রথমবারের মতো টেস্টে হারাল বাংলাদেশ। ১০৮ রানের জয়ে ইতিহাসও গড়া হয়ে গেল। ঢাকা টেস্ট তিনদিনেই শেষ হয়ে গেল। এমন হত বাংলাদেশের বিপক্ষে প্রায়ই। এখন বাংলাদেশই প্রতিপক্ষকে এমন কষ্টের দিন উপহার দেয়। চট্টগ্রাম টেস্টে জয়ের বন্দরে গিয়ে নোঙর ফেলতে পারেনি বাংলাদেশ। তবে এবার আর জয় হাতছাড়া হলো না। সেইসঙ্গে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথমবারের মতো দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে ১-১ ড্র’ও করল বাংলাদেশ। দ্বিতীয় ইনিংসে ২৯৬ রান করতেই অলআউট বাংলাদেশ। তাতে করে ইংল্যান্ডের সামনে জিততে ২৭৩ রানের টার্গেট দাঁড় হলো। এ টার্গেটেই কুপোকাত ইংলিশরা। ইংল্যান্ড জিতলেও ইতিহাস গড়ত। বাংলাদেশ জিতলেও তাই। ইংল্যান্ড যে কখনই উপমহাদেশে ২৫০ রানের বেশি টার্গেট নিয়ে জিততে পারেনি। বাংলাদেশের বিপক্ষে জিতলে ইতিহাস গড়েই জিততে হত। আর বাংলাদেশ যে এমন শক্তির দলকে কখনই হারাতে পারেনি, সেই ইতিহাস হত। জিম্বাবুইয়েকে এর আগে ৫ বার ও ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ২ বার টেস্টে হারিয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু ইংল্যান্ডের মতো পূর্ণশক্তির দল জিম্বাবুইয়ে কিংবা ওয়েস্ট ইন্ডিজ ছিল না। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের হাতেই ইতিহাস লুটে পড়ল। এর আগে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামেই ২০১০ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে ২০৯ রানের টার্গেটে জিতেছিল ইংল্যান্ড। সেটিই উপমহাদেশের মাটিতে সর্বোচ্চ রানের টার্গেটে ইংল্যান্ডের জেতার ইতিহাস ছিল। এবার আর ইংল্যান্ডকে জিততে দিল না বাংলাদেশ। চট্টগ্রাম টেস্টে বাংলাদেশের সামনে জিততে ২৮৬ রানের টার্গেট ছুড়ে দিয়েছিল ইংল্যান্ড। পারেনি বাংলাদেশ। ২২ রানে হারে। ১-০তে তাই সিরিজে এগিয়ে যায় ইংল্যান্ড। এবার ইংল্যান্ডের সামনে উল্টো টার্গেট দেয় বাংলাদেশ। এবার ইংল্যান্ড পারেনি। প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশ ২২০ রান করে। জবাবে প্রথম ইনিংসে ইংল্যান্ড ২৪৪ রান করে। দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশ ২৯৬ রান করে বড় টার্গেটই দাঁড় করিয়ে দেয়। হাতে প্রায় আড়াইদিনের সময় থাকলেও বাংলাদেশের দুই স্পিনার মিরাজ ৬ ও ৪ উইকেট নেয়া সাকিব যে ঘূর্ণির মায়াজালেই বেঁধে ফেলেন ইংলিশদের। তাতে করে ১৬৪ রানের বেশি করতেই পারল না ইংল্যান্ড। এমনই অবস্থা হলো, মধ্যাহ্ন বিরতির কিছুক্ষণ পর বাংলাদেশ দ্বিতীয় ইনিংসে অলআউট হয়। এরপর থেকে দুই সেশন শেষ না হতেই ইংল্যান্ড গুটিয়ে গেল। আসলে বলতে গেলে এক সেশন শেষ না হতেই ইংলিশরা অলআউট হয়ে গেল! তৃতীয় সেশন শুরুর আগেতো বিনা উইকেটে ১০০ রানই করে ফেলে ইংল্যান্ড। দিনের শেষ সেশনে গিয়ে ৬৪ রান যোগ করতেই অলআউট হয়ে যায়। ইংল্যান্ডের স্কোরবোর্ডে যখন ২০ রান, তখনই ইংলিশদের ঘাড়ে চাপ তৈরি করার সুযোগ এসে পড়ে। কিন্তু মিরাজের ঘূর্ণি বলটিতে ১২ রানে থাকা ওপেনার ডাকেট বোকা বনে গেলেও তারচেয়েও বোকা বনে যান রিয়াদ। ডাকেটের ব্যাট ছুঁয়ে বল স্লিপে থাকা রিয়াদের হাতে পড়ে। এত সহজ ক্যাচ। যে কেউ ধরতে পারার কথা। অথচ রিয়াদের হাত গলে বের হয়ে গেল! যখন দ্বিতীয় সেশনের বিরতিতে ওপেনার কুককে নিয়ে বের হচ্ছেন ডাকেট, তার স্কোরবোর্ডে ৫৬ রান লেখা। কুক ও ডাকেট মিলে আবার একঘণ্টার মধ্যে ১০০ রানের জুটিও গড়ে ফেলেন। তৃতীয় সেশন শুরুর প্রথম বলেই ডাকেটকে বোল্ড করে দেন মিরাজ। উল্লাস যেন শুরু হয়ে যায়। ত্রাতার ভূমিকায় আবার দেখা যায় মিরাজকে। এই সেশনের দ্বিতীয় ওভারের প্রথম বলেই আবার রুটকে এলবিডাবলিউ করে দেন সাকিব। ১০০ রানে যেখানে বিনা উইকেট ছিল ইংল্যান্ডের, সেখানে আর ৫ রান যোগ হতেই নেই ২ উইকেট। মুহূর্তেই চিত্র পাল্টে যায়। সেটি আরও পাল্টে যেত, যদি মিরাজের বলে ৪৪ রান করা কুককে যে এলবিডাবলিউ দিলেন আম্পায়ার ধর্মসেনা, সেই সিদ্ধান্ত ‘রিভিউ’তে পাল্টে না যেত। সেই কুক কিছুক্ষণ পরেই ক্যারিয়ারের ৫২তম অর্ধশতকটি করে ফেলেন। কুক একপ্রান্ত আগলে রাখেন ঠিক। কিন্তু আরেক প্রান্তে উইকেট যেতেই থাকে। দেখতে দেখতে ১২৪ রানের মধ্যে ৪ উইকেট হারিয়ে বসে ইংল্যান্ড। ব্যালান্স ও মঈনকেও ঘূর্ণির জালে ফেলেন মিরাজ। পুরোদমে চাপে পড়ে যায় ইংল্যান্ড। সবার তখন একটিই চাওয়া, কোনভাবে কুককে আউট করা গেলেই হয়! ইংল্যান্ডের বিপক্ষে কখনই টেস্টে জয় তুলে নিতে পারেনি বাংলাদেশ। এমনকি ড্র ফলও বের করে নিতে পারেনি। তবে ২০১০ সালে মিরপুরেই ড্র করার সুযোগ তৈরি করেছিল। সেই ম্যাচ পঞ্চমদিনেও গড়ায়। দ্বিতীয় টেস্টের দ্বিতীয় সেশন শুরুর কিছুক্ষণ পরই অলআউট হয় বাংলাদেশ। দুই সেশনের মতো সময় পায় ইংল্যান্ড। জিততে টার্গেট থাকে ২০৯ রান। কুক সেঞ্চুরি করেই জয় তুলে নেন! সেটি ছিল কুকের টেস্ট অধিনায়কত্বের অভিষেক সিরিজ। কুকই টানা দুই টেস্টে সেঞ্চুরি করে ব্যবধান গড়ে দেন। এবার আর সেই সুযোগ পাননি। দলের যখন ১২৭ রান, কুকের তখন ৫৯ রান। মিরাজের বল ঠেকাতে গিয়ে সিলি পয়েন্টে মুমিনুলের হাতে ক্যাচ তুলে দেন কুক। সে কি উল্লাস। যেন ম্যাচ জেতাই হয়ে যায়। আসলেই তাই। কুককে নিয়েই যত ভয় ছিল। সেই কুকই যখন আউট, ইংল্যান্ডেরও যখন ৫ উইকেটের পতন ঘটে যায়; তখন যেন জয়ের আশার বেলুন ভালভাবেই আকাশে উড়তে থাকে। বেয়ারস্টোকেও যখন আউট করে দেন মিরাজ, তখনতো জয় পাওয়া যেন সময়ের দাবিই হয়ে ওঠে। এ উইকেটটি নিতেই ৫ উইকেটও শিকার করে ফেলেন মিরাজ। সেই সঙ্গে টেস্ট সিরিজে বাংলাদেশের হয়ে এনামুল হক জুনিয়রের পর সর্বোচ্চ ১৮ উইকেট নেয়ায় হয়ে গেল মিরাজের। ১৪৯ রানের সময় ১৩ রানে থাকা স্টোকসও আউট হয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু নিজেই বল করে, মাটিতে লুটিয়ে পড়ে চেষ্টা করেও হাতের মুঠোয় থাকা বলটি ফিরতি ক্যাচ বানাতে পারলেন না সাকিব। তবে খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। ১৬১ রানের সময়ই স্টোকসকে (২৫) বোল্ড করে দেন সাকিবই। ৪৩তম ওভারের দ্বিতীয় বলে স্টোকসকে আউট করে পরের বলেই রশিদকেও সাজঘরে ফেরান সাকিব। হ্যাটট্রিকের আশা জাগান। হ্যাটট্রিক হয়নি। তবে ওভারের শেষ বলেই আনসারিকেও আউট করে দেন দেশের সেরা এ অলরাউন্ডার। ৯ উইকেটের পতন ঘটে যায়। তখনও ইংল্যান্ডের জিততে ১১২ রান লাগে। তৃতীয় দিনের বাকি থাকে ৯ ওভার। তবে বোঝা যায়, শেষটার দেখা মিলবে এদিনেই। তাই হলো। শেষটাও করলেন মিরাজই। ১৬৪ রানে ফিনকে এলবিডাবলিউ করে দিয়ে বাংলাদেশের হয়ে সিরিজে সর্বোচ্চ ১৯ উইকেট শিকার করলেন। সেই সঙ্গে বাংলাদেশকে ঐতিহাসিক টেস্ট জয়ও এনে দিলেন মিরাজ। দ্বিতীয়দিনটি ১৫২ রানে শেষ করে বাংলাদেশ। ৩ উইকেটের পতনও ঘটে। এরপরও ভাল কিছুই হবে। সেই আশা সবাই দেখেন। আগেরদিন ৫৯ রানে ব্যাট হাতে থাকেন ইমরুল। সাকিবের সঙ্গে তৃতীয়দিনটি শুরু করেন। শুরুটাও খারাপ হয় না। দুইজন মিলে ভালই এগিয়ে যাচ্ছিলেন। ইমরুল ও সাকিব দুইজনই ‘নতুন জীবন’ পেয়ে দলের স্কোরবোর্ড আরও মজবুত করার কাজটিও করে চলেন। দুইজন মিলে চতুর্থ উইকেটে ৪৮ রানের জুটিও গড়েন। যেই দলের স্কোরবোর্ডে ২০০ রান জমা হয়, সুইপ করতে গিয়ে শতক করার আশা দেখানো ইমরুল (৭৮) মঈনের বলে এলবিডাবলিউ হয়ে যান। এরপর সেই চিরাচরিত নিয়মের পুনরাবৃত্তিই যেন ঘটা শুরু হয়ে যায়। দেখতে দেখতে আর ৯৬ রান যোগ হতেই নেই আরও ৬ উইকেট! সাকিব, মুশফিক, সাব্বির, তাইজুল, মিরাজ, রাব্বি দেখতে দেখতে সাজঘরে ফেরেন। একেকজন যে কি সব শট খেলতে থাকেন, যেন আর তিনদিন পর শুরু হতে যাওয়া ‘বিপিএলে’র জন্য ব্যাটসম্যানদের ব্যাটিং রিহার্সেল হচ্ছে। সেই রিহার্সেল না হলে বাংলাদেশও আরও বেশি টার্গেট ইংল্যান্ডকে দিতে পারত। তাতে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ত ইংলিশরা। বাংলাদেশ যে টার্গেট দিয়েছে তাতেও আতঙ্ক ইংলিশ শিবিরে দেখা যায়। সেই আতঙ্কেতো হেরেই যায় ইংলিশরা। স্পিন যে তাদের সামনে কি পরিমাণ বিষ হয়ে ধরা দেয় তা আবারও বোঝা গেল। তাতে করে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো ইংল্যান্ডের মতো শক্তিশালী দলকে হারিয়ে ইতিহাসও গড়ল।
×