ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চলচ্চিত্রের ৬০ বছর

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ৩১ অক্টোবর ২০১৬

চলচ্চিত্রের ৬০ বছর

বাংলাদেশ তথা ঢাকার চলচ্চিত্রের ৬০ বছর পালন উপলক্ষে বাঙালী সমগ্র জাদুঘর নামের একটি সংগঠন নানা কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে চলচ্চিত্র নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠান, ছবির পোস্টারসহ আলোকচিত্র ও বিভিন্ন নিদর্শন প্রদর্শন সর্বোপরি বিভিন্ন চলচ্চিত্রের অসমাপ্ত ও দুর্লভ ফুটেজ দেখানো অন্যতম। এখানে উল্লেখ করা আবশ্যক, ১৯৫৬ সালে প্রথম মুক্তি পায় বাংলা সবাক চলচ্চিত্র ‘মুুখ ও মুুখোশ’। সেই সময় থেকে হিসাব করা হলে ঢাকাই চলচ্চিত্রের বয়স দাঁড়ায় ৬০ বছর। তবে কথা আছে এখানে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের চুলচেরা বিশ্লেষণে দেখা যায়, মানিকগঞ্জের ছেলে হীরালাল সেন প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য ‘ফ্লাওয়ার অব পার্সিয়া’ নির্মাণ করেন ১৮৯৮ সালে। এর মাত্র তিন বছর আগে আবিষ্কৃত হয়েছিল চলচ্চিত্র মাধ্যমটির। এর পর ১৯২৭ সালে ঢাকার নবাব পরিবারের উদ্যোগে নির্মিত হয় ‘সুকুমারী, দ্য লাস্ট কিস’। সেই প্রেক্ষাপটে ‘মুখ ও মুুখোশকে’ বলা যেতে পারে বাংলাদেশে ছবি নির্মাণের তৃতীয় উদ্যোগ। ঢাকার ছবির হীরক জয়ন্তীতে উপনীত হয়ে সঙ্গত কারণেই এই প্রশ্নটি উত্থাপিত হতে পারে যে, দেশের চলচ্চিত্র শিল্পের বর্তমান অবস্থাটি ঠিক কেমন? দেশের চলচ্চিত্র শিল্প কী যথেষ্ট উন্নত, সমৃদ্ধ ও মানসম্মত হয়ে উঠতে পেরেছে? আমরা কী দর্শকদের চলচ্চিত্রের মাধ্যমে যথার্থ অর্থে বিনোদনক্ষম, জীবনঘনিষ্ঠ সর্বোপরি বাণিজ্য সফল চলচ্চিত্র উপহার দিতে সক্ষম হচ্ছি? তদুপরি চলচ্চিত্র কী শেষ পর্যন্ত সার্বিক অর্থে ‘শিল্প’ হিসেবে গড়ে ওঠা এবং বিকশিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে? এক কথায় এসব প্রশ্নের উত্তর না সূচক হতে বাধ্য। সেক্ষেত্রে ঢাকার চলচ্চিত্র কেন এই দুর্দশা ও দুরবস্থা, তার কারণ অনুসন্ধান করে দেখতে হবে চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে, সুধীজন ও সরকারকে। যেহেতু বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ৬০ বছর অতিক্রম করেছে, সেহেতু একে বয়োপ্রাপ্ত বলা যায় নিঃসন্দেহে। এতদিনে ঢাকায় চলচ্চিত্রের অনেক উত্থান-পতন হয়েছে বটে, তবে সার্বিক বিবেচনা ও মূল্যায়নে পতনের দিকটিই সমধিক প্রত্যক্ষ করা যায়। প্রতিযোগিতামূলক ও বাণিজ্যিক এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখাসহ জীবনমুখী ও মানসম্মত চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য সময় সময় সরকারী-বেসরকারীভাবে নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা এফডিসির কার্যকরী সহায়তাসহ আর্থিক অনুদান এবং কর সুবিধাও দেয়া হয়েছে। তবে এতেও যে শেষ পর্যন্ত সুফল মিলেছে, এমন কথা বলা যায় না। চলচ্চিত্র জীবনঘনিষ্ঠ শিল্প। শিল্পের বিভিন্ন মাধ্যমের মধ্যে চলচ্চিত্রই সর্বাধিক দর্শক-শ্রোতার সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে চলে। চলচ্চিত্রের মাধ্যমে মানুষকে যতটা জীবন ও বাস্তবমুখী করে তোলা যায়, অন্য কোন শিল্প মাধ্যমে তা সম্ভব নয়। একই সঙ্গে চলচ্চিত্র শিল্পের একটি বাণিজ্যিক দিকও রয়েছে। এ দুইয়ের মেলবন্ধন না হলে সার্থক ও সফল চলচ্চিত্র নির্মাণ সম্ভব হয় না। এ কথা সত্য যে, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প একদা কৃতী পরিচালক সুভাষ দত্ত, জহির রায়হান, খান আতাউর রহমান, এহতেশাম, মুস্তাফিজ, কাজী জহির, নারায়ণ ঘোষ মিতা, আমজাদ হোসেন, এম এ সামাদ, চাষী নজরুল ইসলাম প্রমুখের ছত্রছায়ায় পরিপুষ্ট ও সমৃদ্ধ হয়েছে। তারা একের পর এক ভাল ও দর্শকধন্য বাণিজ্য সফল ছবি উপহার দিয়েছেন। কিন্তু কেন যেন সেই পরিপুষ্ট ধারাটি এখন প্রায় শুকিয়ে গেছে যথাযথ পরিচর্যা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে। সরকারী উদ্যোগে চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা এফডিসি এবং বেসরকারী দু-একটি স্টুডিও চলচ্চিত্র নির্মাণের সহায়তা করলেও যুগ ও সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে ব্যর্থ হয়েছে চরমভাবে। তদুপরি অযোগ্য-অদক্ষ লোকজনের হাতে পড়ে চলচ্চিত্র শিল্পটি অচিরেই হয়ে উঠেছে বিদেশী গল্প ও সিনেমার অন্ধ অনুকরণ এবং নাচ-গানসহ অশ্লীলতায় ভরপর। ফলে দর্শকরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে এ থেকে এবং দেশের সিনেমা হলগুলো বন্ধ হয়ে গেছে একে একে। এহেন দুরবস্থা থেকে দেশীয় চলচ্চিত্র শিল্পকে টেনে তোলা দুরূহ হলেও অসম্ভব নয়। আশার কথা এই যে, অধুনা দু-চারটি বাণিজ্য সফল ছবি নির্মিত হচ্ছে এবং মানুষ আবার ফিরে আসতে শুরু করেছে সিনেমা হলে। ইতিবাচক এই অবস্থাটি যদি ধরে রাখার সর্বতোমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করা যায় সব মহল থেকে, তাহলে দেশীয় চলচ্চিত্র শিল্পে সুদিন ফিরে আসতেও পারে।
×