ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নাসির উদ্দীন ইউসুফ

শিল্প ও রাজনীতির যুগলবন্দীর স্রষ্টা আসাদুজ্জামান নূর

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ৩১ অক্টোবর ২০১৬

শিল্প ও রাজনীতির যুগলবন্দীর স্রষ্টা আসাদুজ্জামান নূর

আজ আসাদুজ্জামান নূরের ৭০ বছর পূর্ণ হলো। কালের পরিক্রমায় হয়ত এ নিহায়তই তুচ্ছ অধ্যায় মাত্র। কিন্তু জীবনের কররেখায় আসাদুজ্জামান নূরের সাত দশক জীবন্মৃত্যু, আনন্দ-বেদনা, জয়-পরাজয়ের রক্তাক্ত মানচিত্র। সহস্র লোভী-নির্লোভ ভক্তকুলের দ্বারা নিত্যদিন পরিবেষ্টিত উদ্যাপিত নূরকে আমরা দেখি। সেই উদ্যাপনের সুউচ্চ শিখরে তার অবস্থান নিস্তরঙ্গ অভিযাত্রায় আয়াসলব্ধ হয়নি। এক তরঙ্গসঙ্কুল কণ্টকপূর্ণ অভিযাত্রায় তিনি জয় করেছেন অসম্ভবকে। ক্রমান্বয়ে জাতির সামনে তিনি দাঁড়িয়েছেন সংস্কৃতি ও রাজনীতির মিশেলে এক অনুসরণীয় মানুষ হিসেবে। আদর্শ শিক্ষক পিতা-মাতার সন্তান আসাদুজ্জামান নূর। শৈশব-কৈশোরে বেড়ে উঠেছেন মানবকল্যাণের মূল্যবোধের কঠিন পাঠদান পরিবেশে। যদিও তখন দ্বিখ-িত বাংলার উষ্ণ রক্তপ্লাবিত স্বদেশ-শরণার্থীদের দীর্ঘশ্বাসে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। তবুও সেই সময়েই আমরা দেখি আমাদের পিতৃপুরুষের ঘুরে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা। লঙ্ঘিত মানবতার ক্রান্তিকালে অসাম্প্রদায়িক অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক অধিকারের নতুন বাণী নিয়ে, নতুন স্বপ্ন বাঁধার উন্মেষকাল। সেই আশা-নিরাশার মাঝে বেড়ে উঠছেন নূর। নতুন কালের ঘণ্টাধ্বনি তখন বেজে উঠেছে বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনকে ঘিরে। সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির বিপরীতে তখন পূর্ব বাংলায় নব উন্মেষ ঘটছে অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির, সমন্বয় ও সমতার সংস্কৃতির। এই পরস্পরবিরোধী আবহে পঞ্চাশের দশকে বেড়ে ওঠা নূর পিতা-মাতার নিবিড় পরিচর্যায় এক অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতিবান মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠেছেন। মওলানা ভাসানী, মনি সিংহ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালী তখন পাকিস্তানের রাষ্ট্রকাঠামোয় বাঙালী জাতিসত্তার অধিকার সংরক্ষণের রাজনীতির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে যখন জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্রের প্রবল জোয়ার। পূর্ববাংলার জনগণ তখন এই নতুন পরিস্থিতির বাইরে নয়। বিগত শতকের ’৫০ ও ’৬০ দশকের সময়ে বেড়ে ওঠা তরুণরা জাতীয়তাবাদের মূল সংজ্ঞা সমাজতন্ত্রের সংশ্লেষে নিরূপণের চেষ্টায় রত। ঠিক এই সময়ে পূর্ববাংলায় ভাষাভিত্তিক সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে ওঠে। আসাদুজ্জামান নূর একদিকে দেশের স্বাধীনতা অন্যদিকে অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্ন নিয়ে নতুন সাংস্কৃতিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি নূর সমাজের অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায়ও পাঠ নিতে থাকেন। একজন সংস্কৃতিকর্মী-একজন রাজনৈতিক কর্মীর বেড়ে ওঠার এটিই শ্রেষ্ঠ সময়। বঙ্গবন্ধুর অপ্রতিরোধ্য উত্থানকাল এই ’৬০’-এর দশকেই। তার ‘জয়বাংলা’ ধ্বনি তখন বাঙালীর কাছে অবিনাশী মন্ত্র। আসাদুজ্জামান নূর এই মহাপুরুষের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধজয়ী বীরমুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যে আসাদুজ্জামান নূরকে আমরা পাই সে নতুন এক মানুষ। সাধারণ মানুষের সঙ্গে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় অতিবাহিত করে ৯ মাসে তখন যে নূরকে আমরা দেখি, সে রক্তাক্ত-দগ্ধ বাংলাদেশের মাটিতে জন্ম নেয়া এক ‘কাকুনুস পাখি’। মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে মহাজীবনের পাঠ নেয়া পঁচিশ বছরের যুবক আসাদুজ্জামান নূর রাজনীতির মঞ্চ নয়, সংস্কৃতির মঞ্চকে বেছে নিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃতি সংসদের নেতৃত্বে চলে এলেন। যোগ দিলেন নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ে। বাংলা মঞ্চ পেল নতুন কালের নতুন অভিনেতা। কিন্তু যে সংস্কৃতির মঞ্চ তিনি বেছে নিলেন সে সংস্কৃতি রাজনীতিবর্জিত নয়। বরঞ্চ সেই নাটক, সঙ্গীত, চিত্রকলা শ্রমজীবী মানুষের স্বপ্নের দুচোখে ঠাসা। দেশ গড়তে হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়। মঞ্চই তো সেই চেতনার আলোকে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ত-নিরন্তর জাগিয়ে রাখে। মহিলা সমিতির অনুজ্জ্বল আলোয় তখন বাংলাদেশের নাট্যকর্মীরা মানুষের দুচোখে ঠেসে দিচ্ছে উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত বাংলাদেশের চিত্ররূপ। এ রকম এক সম্ভাবনার কালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের প্রায় সকল সদস্যকে হত্যা করা হলে দেশে নেমে আসে অন্ধকার কাল। রাজনীতি তখন সামরিক জান্তার হাতে বন্দী। সংবিধান ক্ষতবিক্ষত। সন্ত্রাসের জনপদে অনিশ্চিত মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ। কিন্তু সেই ক্রান্তিকালে আসাদুজ্জামান নূরসহ অনেক অমিততেজী নাট্যকর্মীর দ্রুত সাংস্কৃতিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর ইতিহাস তো আমাদের জানা। আসাদুজ্জামান নূর সেই এক অভিনেতা যিনি বাংলার সেই শ্রমজীবী মানুষের মুখ বিস্মৃত না হয়ে প্রবল ভালবাসায় ও বিশ্বাসে বাংলা মঞ্চ ও টেলিভিশন অভিনয়ে সৃষ্টি করলেন অমর সেসব চরিত্র যা পরবর্তীকালে বাংলার রাজনৈতিক আন্দোলনকে ‘বাতিঘরের’ মতো পথ দেখিয়েছে। মঞ্চ অতিক্রম করে তার অভিনীত চরিত্রের সংলাপ তখন বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে, রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মীদের কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত। মঞ্চে যখন অভিনেতা নূর ‘নূরলদীনের সারাজীবন’-এর আব্বাসরূপী বলে ওঠেন ‘জাগো বাহে কোন্ঠে সবাই’ তখন সারাদেশ দাঁড়িয়ে যায় স্বৈরশাসক, সেনাশাসক ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে। নাট্যমঞ্চ, আবৃত্তিমঞ্চ অতিক্রম করে নূর তখন পরিণত হন এক ‘যুগন্ধর’ অভিনেতাতে। তার হাতে ‘গডোর অপেক্ষায়’ এস্ট্রাগন চরিত্র হয়ে ওঠে আমাদের চরিত্র নির্মাণের শিল্পকৌশলের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ‘গ্যালিলিও’ নাটকে পাদ্রি, ‘মাইলপোস্ট’-এর সং তো এখনও আমাদের স্মৃতিতে হীরক উজ্জ্বল হয়ে আছে। মঞ্চাভিনয়ের পাশাপাশি টেলিভিশন নাটকে তার অভিনয় এবং জনপ্রিয়তা তো কিংবদন্তিতুল্য। ‘লালমাটি কালো ধোঁয়া’, ‘অয়োময়’, ‘আজ রবিবার’, ‘কোথাও কেউ নেই’সহ অসংখ্য টিভি নাটকে তার ঈর্ষণীয় সাফল্য ও জনপ্রিয়তার কথা আমাদের শিল্প-সংস্কৃতির ইতিহাসে দুর্লভ। সমসাময়িক অনেক রাজনৈতিক অথবা সামাজিক নেতৃত্বের চাইতে আসাদুজ্জান নূর ‘বাকেরভাই’ হিসেবে তুলনাহীন জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। তার অভিনয়ের গুণে ‘বাকের’-এর মুক্তির দাবিতে মিছিল-সভা হয়নি এমন জেলা বা উপজেলা খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আবৃত্তি শিল্পভুবনে আসাদুজ্জামান নূর সৃষ্টি করেছেন নিজস্ব এক স্বকীয় ভঙ্গি। তার দরাজ-নিখাদ কণ্ঠ হতে নির্গত কবিতা পংক্তি জনসভার মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো ঐক্যের পরিসরে নিয়ে আসত। তার হাতেই মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলা আবৃত্তিশিল্প পেয়েছে ভিন্ন এক মাত্রা। চলচ্চিত্রে তার অসামান্য অভিনয়ে মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র পেয়েছিল শিল্পের নতুন পথের ঠিকানা। কিন্তু অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূরের অকল্পনীয় উত্থান এই সাত্ত্বিক শিল্পীকে তার আদর্শ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। তিনি সত্যিকার অর্থে ‘মহাতারকা’ হয়েছেন কিন্তু সর্বদা মানুষের মাঝেই অবস্থান করেছেন। তাইত দেখি অভিনয়, আবৃত্তি সব কিছুকে তিনি ব্যবহার করেছেন জনগণের মুক্তির আন্দোলনে, স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলনে, ধর্মান্ধ মৌলবাদী শক্তির বিরুদ্ধে জনপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে। তাইত আমরা দেখি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার আন্দোলনে, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ‘গণতন্ত্রের অভিযাত্রায়’, গণআদালতের মঞ্চে, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনে তার নিঃসংকোচ অংশগ্রহণে। এভাবে শিল্প ও রাজনীতির যুগলবন্দীতে তিনি জীবনকে বেঁধে ফেলেন। শিল্প ও মানুষ তার বুকে বাস করে নিরন্তর। তবুও হয়তবা মানুষের প্রয়োজনে, রাজনীতির অনিবার্যতায় আমাদের প্রিয় অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর শিল্পকলার সৃষ্টিশীলতা থেকে রাজনীতির কঠিন-কঠোর পথের পথিক এখন। সাফল্যও পেয়েছেন অনেক। রাজনীতিবিদদের কাক্সিক্ষত মন্ত্রিপরিষদের সদস্য তিনি। এওবা কম কীসে যে, আমাদেরই একজন শিল্পী এখন সংস্কৃতিমন্ত্রী। দ্রুত উন্নয়নগামী বাংলাদেশের সংস্কৃতির যে অনিবার্য পরিবর্তন ঘটছে, বর্তমানে সে সময় হয়ত আসাদুজ্জামান নূরের মতো একজন কুশলী অভিনেতার প্রয়োজনই সবচেয়ে বেশি অনুভব করেছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা। এ রকম একজন সফল শিল্পী-রাজনীতিবিদের সত্তরতম জয়ন্তী আজ, এই আনন্দক্ষণে কী বলে অভিনন্দন জানাব তাকে। যদি এভাবে বলি- ‘নাটক ও আবৃত্তির যুগল মন্থনে তোমার হাতেই সৃষ্টি হয়েছে বাংলার নতুন শিল্প অভিধা তুমিই তো বাংলা মঞ্চের সুবর্ণ নট তোমার মাঝেই প্রত্যক্ষ করেছি আমরা শিল্পের অমিত সম্ভাবনার পথ কিন্তু শিল্পমঞ্চ হতে রাজনীতির মঞ্চগমন আমাদের করেছে বঞ্চিত জন্ম-তারিখ আর সাফল্যের হিসাব-নিকাশ নয় তোমার সৃষ্টির দ্যুতিতে উদ্ভাসিত শিল্পসত্য আমাদের করতলে এ তারই বন্দনাগীত তুমিই বাংলামঞ্চের সুবর্ণ নট একথা সত্য প্রমাণিত হোক পুনর্বার গণমানুষের মঞ্চ পাশে নাট্যমঞ্চে তোমার প্রত্যাবর্তনের আশায় তোমাকে অভিবাদন।’ ুড়ঁংঁভভ১৯৭১@মসধরষ.পড়স
×