ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জাকারিয়া স্বপন

অভ্যাস ৬ ॥ সিনারজাইজ

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ৩১ অক্টোবর ২০১৬

অভ্যাস ৬ ॥ সিনারজাইজ

(পর্ব তৃতীয়) গত সপ্তাহে লিখেছিলাম ‘সিনারজাইজ’ অভ্যাসটির দ্বিতীয় পর্ব নিয়ে। আজকে লিখছি তার শেষ পর্ব। ড. স্টিফেন কোরের লেখা ‘দি সেভেন হ্যাবিটস অব হাইলি ইফেক্টিভ পিপল’ বইটিতে যে সাতটি অভ্যাসের কথা বলা হয়েছে, তার ষষ্ঠ অভ্যাসটি হলো ‘সিনারজাইজ’- সৃজনশীল সহযোগিতার নীতিমালা। গত সপ্তাহের লেখার শেষে একটি পরিস্থিতির কথা বলেছিলাম; আর জানতে চেয়েছিলাম এমন একটি পরিস্থিতিতে আপনি কিভাবে সিদ্ধান্ত নেবেন? বিষয়টি আরেকবার দেখে নেয়া যাক। একটি ছুটির মৌসুম। বাচ্চাদের স্কুল-কলেজ বন্ধ হয়ে গেছে। বাবা তাদের একটি চমৎকার সময় উপহার দেয়ার জন্য দূরে কোথাও যাওয়ার পরিকল্পনা করে ফেলেছেন। সেখানে হ্রদে নৌকা বাওয়া যাবে, বড়শি দিয়ে মাছ ধরা যাবে, সঙ্গে থাকছে রাতের বার-বি-কিউ। পরিবারের সবাইকে নিয়ে চমৎকার ছুটির পরিকল্পনা। পুরো বছর ধরে তিনি এমনটাই ভেবে রেখেছেন এবং সেই বনের ভেতর কটেজে বুকিংও দিয়ে রেখেছেন। তার ছেলেমেয়েরা বিষয়টি নিয়ে খুবই উত্তেজনায় আছে; কবে আসবে সেই মুহূর্তটি। অন্যদিকে তার স্ত্রী এই ছুটির সময়টার জন্য অপেক্ষা করছিলেন, যেন ২৫০ মাইল দূরে থাকা তার মায়ের সঙ্গে কাটাতে পারেন। তার পক্ষে বৃদ্ধা মাকে দেখতে যাওয়া খুব একটা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তার জন্য এটাই মোক্ষম সময় এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। দু’জনই তাদের মতো পরিকল্পনা করে ফেলেছেন। তাদের এই বিপরীতমুখী অবস্থান উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর হতে পারে। তাদের সম্পর্কে শীতলতা আসতে পারে। কী করা যায় এখন? এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি আমাদের অনেক সময়ই পড়তে হয়। এমন অবস্থায় আপনি হলে কী করতেন? বাংলাদেশীরা এখনও মা পাগল। আমার পাঠকদের অনেকে সেটা প্রমাণ করেছেন। তাদের অনেকেই বলেছেন, তারা মাকে সঙ্গে করে ছুটি কাটাতে নিয়ে যেতেন। কেউ কেউ বলেছেন, প্রথমে মাকে দেখে, তারপর সেখান থেকে জঙ্গলে বেড়াতে যাবেন। কেউ কেউ বলেছেন, মায়ের জন্য জঙ্গলে বেড়াতে যাওয়া বাতিল করবেন। ছেলেমেয়েদের নিয়ে অন্য কোথাও বেড়াতে যাবেন। মাকে ফেলে শুধু বেড়াতে যাওয়ার কথা কেউ বলেননি। আবার কেউ কেউ প্রশ্ন করেছেন, স্ত্রীকে না জানিয়ে যে লোক ছুটির পরিকল্পনা পাকা করে ফেলে সে আবার কেমন স্বামী? এবারে দেখি স্বামী-স্ত্রীর ভেতর আলোচনাটি কিভাবে চলতে পারে। স্বামী : ‘সব পরিকল্পনা করা হয়ে গেছে। ছেলেমেয়েরা উত্তেজনায় আছে। আমাদের জঙ্গলে বেড়াতে যাওয়াটা জরুরী।’ স্ত্রী : ‘আমি জানি না, আমার মা আর কতদিন বাঁচবেন? তাই আমি তার পাশে কিছুদিন থাকতে চাই। তার পাশে লম্বা সময় থাকার এটাই সবচে ভাল সুযোগ।’ ‘তুমি তো জানো, সারাটা বছর ধরে আমরা এই এক সপ্তাহ ছুটিটার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। নানা বাড়িতে গিয়ে ছেলেমেয়েরা হাত গুটিয়ে বসে থাকবে। ওখানে করার কিছুই নেই। ওরা বসে বসে বিরক্ত হবে। তাছাড়া তোমার মা তো তেমন অসুস্থ নন এবং কয়েক মাইল দূরেই তোমার বোন থাকে।’ ‘তিনি তো আমারও মা। আমি তার পাশে থাকতে চাই।’ ‘তুমি প্রতি রাতে তাকে ফোন করতে পারো। আর আমরা তো বড় দিনের ছুটিতে সবাই মিলে তার বাড়িতেই মিলিত হচ্ছি।’ ‘সেটা তো আগামী পাঁচ মাসের ভেতর হচ্ছে না। আমরা তো কেউ বলতে পারি না যে, তিনি ততদিন বেঁচে থাকবেন। তাছাড়া তিনি নিজেও চাইছেন আমি তার পাশে থাকি। তোমরা যাও। আমি মায়ের কাছে যাব। মার আমাকে প্রয়োজন।’ ‘তাকে তো বেশ যতেœই রাখা হয়েছে। ছেলেমেয়েদের এবং আমারও তোমাকে প্রয়োজন।’ ‘জঙ্গলে বেড়াতে যাওয়ার চেয়ে আমার মা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’ ‘মায়ের চেয়ে স্বামী এবং সন্তানরা তোমার কাছে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’ তর্ক এবং যুক্তি এভাবেই তিক্ত হতে শুরু করে। একটা সময়ে গিয়ে তারা একটা কম্প্রোমাইজ অবস্থানে আসে। বাবা তার সন্তানদের নিয়ে জঙ্গলে বেড়াতে যাবে; আর মা তার মায়ের কাছে যাবে এবং এই সিদ্ধান্তটি নিয়ে কেউই পুরোপুরি সুখী অনুভব করছে না। দু’জনের ভেতরই এক ধরনের অপরাধবোধ কাজ করছে। বাচ্চারাও সেটা বুঝতে পারছে। তারাও কেমন মন মরা হয়ে গেছে। ছুটির মজাটাই যেন আর থাকল না। আমাদের মতো সমাজে এমন ছেলে অনেক পাওয়া যাবে, যারা স্ত্রীর এই কথাগুলো শুনবে না। স্ত্রীকে তাদের সঙ্গে যেতেই হবে। এটা স্ত্রীর ভাল লাগুক আর নাইবা লাগুক। আমাদের দেশে বেশিরভাগ ছেলেরা তাদের সিদ্ধান্তে অটল থাকে। আবার অনেক সময় অনেক মেয়েকেও উল্টো অবস্থানে পাওয়া যাবে। দেখে মনে হবে তারা ছেলেদের ওপর প্রতিশোধ নিচ্ছে। কিন্তু কোন এক্সট্রিমই ভাল ফল বয়ে আনতে পারে না। দু’জন মানুষ এতটা এক্সট্রিমে না গিয়ে আগে থেকেই বিষয়টি নিয়ে খোলা মনে কথা বলে প্রাইয়োরিটি ঠিক করে নিতে পারতেন। এমন বিয়ে প্রচুর রয়েছে যা একটা সময়ে দারুণ ভালবাসায় পূর্ণ ছিল, চমৎকার সিনারজি ছিল এবং সুন্দর কোমল ব্যবহারে একে অন্যকে জড়িয়ে ছিল; কিন্তু পরবর্তী সময়ে এমন অসংখ্য সিদ্ধান্তের কারণে বৈরী পরিস্থিতিতে পরিণত হয়েছে। যাদের বিয়ের কিছুটা সময় পার হয়েছে তাদের অনেকেই হয়ত এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন, কিংবা তারা আশপাশে অজস্র উদাহরণ দেখতে পাচ্ছেন। এটা একটা উদাহরণ মাত্র। একটি বিষয়ে স্বামী এবং স্ত্রী ভিন্নভাবে দেখতে পারেন। সেই ভিন্নভাবে দেখতে পারার জন্য তাদের পোলারাইজ করতে পারে, সম্পর্কে শীতলতা আনতে পারে এবং একটা সময়ে বিচ্ছেদের দিকে মোড় নিতে পারে। অনেক ক্ষেত্রেই তারা মনে মনে বিচ্ছেদ হয়ে আছেন; কিন্তু থাকতে হচ্ছে একটি ছাদের নিচেই। এমন পরিস্থিতির সংখ্যা কম নয় কিন্তু। আবার এই দ্বিমতকে ঠিকভাবে হ্যান্ডেল করতে পারলে এই দু’জনই একটি ভিন্নমাত্রায় সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেন, যা সাধারণের ভেতর দেখা যায় না। তারা উঁচু মাত্রার এমন একটি সম্পর্ক তৈরি করতে পারেন যা শ্রদ্ধার এবং বোঝাপড়ার- যেখানে থাকে এমন একটি প্রশান্তি, যা আর এই গ্রহে অন্য কিছুতেই নেই। তাদের ভেতর খেলে যায় দারুণ এক বৈদ্যুতিক ক্রিয়া। একজন আরেকজনের কাছে হয়ে ওঠেন ভীষণ মূল্যবান। তার মূল কারণ হলো তাদের ভেতর রয়েছে উঁচু ইমোশনাল ব্যাংক এ্যাকাউন্ট এবং খোলা মনে ভাবের আদান-প্রদান। তারা দু’জনই উইন-উইন চিন্তা করেন। তারা তৃতীয় আরেকটি সমাধানে যাওয়ার চেষ্টা করেন, যা উভয়ের জন্যই লাভবান এবং প্রথমে যে প্রস্তাবটি দেয়া হয়েছিল তার থেকে অনেক ভাল। তারা সহমর্মিতা দিয়ে শোনেন এবং কাউকে বোঝাতে যাওয়ার আগে তাকে বুঝতে চেষ্টা করেন এবং তাদের ভেতর একটা সিনারজি তৈরি করার চেষ্টা করেন, যেন ১+১= ৩ কিংবা আরও বেশি কিছু হয়। বৌদ্ধ ধর্মে এটাকে বলা হয়ে থাকে ‘মধ্যম পন্থা।’ অনেকেই এটাকে কম্প্রোমাইজ অবস্থান বুঝতে পারেন। ‘মধ্যম পন্থা’ আসলে কম্প্রোমাইজ নয়। এটা হলো একটি ত্রিভুজের চূড়া- অনেক ওপরে। এক্ষেত্রে দু’জনই উভয়ের চাহিদাটা বোঝার চেষ্টা করবেন। স্বামী বুঝতে চেষ্টা করবেন তার স্ত্রীর মূল কনসার্নটা কোথায়, তার মায়ের শরীর যে কোন সময় খারাপের দিকে চলে যাওয়ার একটি সম্ভাবনা রয়েছে এবং যদি কিছু একটা হয়ে যায় তাহলে তার স্ত্রী কখনই তাকে ক্ষমা করতে পারবেন না। অন্যদিকে, স্ত্রীও বুঝতে পারবেন ছুটির জন্য পুরো পরিবার তৈরি হয়ে আছে, সকল প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হয়েছে, সেখানে তিনি যদি না যান তাহলে সন্তান এবং স্বামী সবার জন্যই একটা খুব খারাপ অভিজ্ঞতা হতে যাচ্ছে। তারা দু’জন মিলে এই সমস্যাটার সমাধান করার চেষ্টা করছেন। তারা দু’জন টেবিলের দু’পাশে নন, একদিকে বসে সমস্যাটাকে দেখার চেষ্টা করছেন এবং সেটার একটা সমাধান বের করবেন। তৃতীয় আরেকটি প্রস্তাবনা বের করা যায় কি না, সেটাই চেষ্টা করবেন। স্বামী বললেন, ‘এমনকি হতে পারে যে, এই মাসেই আরেকটি উইকএন্ডে তুমি চলে গেলে। আমি এই দিকটা সামাল দিলাম। সপ্তাহের প্রথম দিকেই আমরা কিছু রান্নাবান্না করে রাখলাম। ওরাও স্কুল-কলেজে গেল। আমি অফিসটা করলাম। আমরা চালিয়ে নিতে পারব।’ ‘অথবা এমনকি হতে পারে, আমরা তোমার মায়ের বাড়ির আশপাশের কোন জায়গায় ক্যাম্প করতে পারি। ওটার পরিবেশ হয়ত ততটা ভাল হবে না; কিন্তু অন্য প্রয়োজনগুলো মিটে যাবে। আমরা ওদের কাজিনদের আসতে বলতে পারি। ওরাও একসঙ্গে কিছু করতে পারে।’ এভাবে তারা বিভিন্ন দিক সামনে আনতে থাকে, যতক্ষণ না তারা তৃতীয় আরেকটি সমাধানে আসতে পারে। তবে সেই সমাধানটি অবশ্যই দু’জনের ভেতর একটা ভাল অনুভূতির জন্ম দিতে হবে। এটা ঠিক কম্প্রোমাইজ না, এটা হলো তৃতীয় আরেকটি পন্থা বের করা, যা উভয়ের চাহিদাকেই মেটায়। এর মাধ্যমে দু’জনই তাদের নিজেদের জিনিসগুলো পেয়ে যায় এবং তাদের সম্পর্কটা আরও বেশি উচ্চমার্গীয় হয়। এটাই হলো সিনারজি। ॥ দুই ॥ আমাদের ভেতর যেমন ইতিবাচক সিনারজি আছে, আবার ঠিক উল্টো নেতিবাচক সিনারজিও রয়েছে। কখনও কি একটু ভেবে দেখেছেন, একটি সমস্যার সমাধান করতে গেলে কী পরিমাণ নেতিবাচক এনার্জি কাজ করে? যখন কোন একটি সিদ্ধান্ত অন্যের সঙ্গে মিলে নিতে হবে, সেক্ষেত্রে অনেক রকমের নেতিবাচক বিষয় থাকতে পারে। সিদ্ধান্তটি যদি আপনার একার হয় তাহলে তো কোন কথাই নেই। কিন্তু যেই মুহূর্তে আপনাকে অন্য আরেকজনের সঙ্গে মিলে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, সেখানে আপনি অনেক নেতিবাচক বিষয় দেখতে পাবেন। আমরা অনেকেই জীবন চালাই, ‘মাই ওয়ে, অর হাইওয়ে’ নীতিতে। অর্থাৎ আমার পন্থায় আসো, নইলে ভাগো। কিন্তু তৃতীয় পন্থাটার কথা আমরা ভুলেই যাই। আপনি কি খেয়াল করে দেখেছেন অন্যের বদনাম করে কী পরিমাণ সময় নষ্ট করছেন? নোংরা রাজনীতি করে, আরেকজনকে বেকায়দায় ফেলার জন্য কতটা সময় নষ্ট করছেন? কারও ওপর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য নিজের কতটা সময় নষ্ট করছেন? কারও সঙ্গে মতের অমিলকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে কতটা সময় খোয়াচ্ছেন? কতটা সময় আপনি নষ্ট করছেন অন্যকে নিচে ফেলে আপনি নিজে ওপরে ওঠার জন্য? এটা অনেকটা এমন যে, আপনি দ্রুত গাড়ি চালিয়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে চাইছেন, তবে একই সঙ্গে এক পা দিয়ে রেখেছেন গাড়ির এক্সেলেটরে, আরেক পা দিয়ে রেখেছেন ব্রেকে। যারা গাড়ি চালাতে পারেন তারা বিষয়টি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। আপনি আপনার পা ব্রেক থেকে না তুলে আরেক পায়ে আরও বেশি গ্যাস দিচ্ছেন। তাতে কি কোন ভাল ফল পাবেন? তাতে আপনি আরও বেশি চাপে গাড়ি চালাতে চাইছেন, আরও বেশি লজিক দিয়ে আপনার অবস্থান দৃঢ় করার চেষ্টা করছেন। এই ধরনের ক্ষেত্রে বেশিরভাগই হয়ে থাকে উইন-লুস কিংবা লুস-উইন। যখনই দ্বৈত সিদ্ধান্তের বিষয়টি চলে আসে, কিংবা সবাই মিলে একটা ঐকমত্যে পৌঁছানোর বিষয় থাকে, সেখানে নেতিবাচক শক্তি কাজ করলে পুরো বিষয়টিই ভেস্তে যাবে। আমাদের মতো দেশে, আমরা যেহেতু ছোটবেলা থেকে এই বিষয়গুলো শেখাই না, তাই সম্মিলিতভাবে কিছু করতে গেলেই আমাদের অনেকের ভেতর নেতিবাচক শক্তির প্রকাশ ঘটে। তারা এমনভাবে সক্রিয় হয়ে যায় যে, নিজের অনেকটা শক্তি ক্ষয় করে মূল উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করার জন্য। এটা খেলাতে যেমন দেখা যাবে, কর্মক্ষেত্রে দেখা যাবে, সমাজ উন্নয়নে দেখা যাবে, দেশের স্বার্থেও দেখা যাবে। তারা হয়ত মুখে বলবে উইন-উইন; কিন্তু কাজে সেটা দেখা যাবে না। তখন সেখানে আর সিনারজি কাজ করে না। যে সকল মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে তারাই মূলত নানা রকমের ম্যানুপুলেশনে ব্যস্ত থাকে। আর এই নেতিবাচক দিকটির কারণে সেখানে আর সিনারজি তৈরি করা যায় না। তারা মূলত সবাইকে নিজের মতো দেখতে চায় এবং সবাইকে তাদের মতো করে ভাবতে বাধ্য করে। তারা বুঝতে পারে না যে, একটি বিষয়ে অন্য মতামতগুলো ভিন্ন দিকগুলোকে দেখতে সাহায্য করে। সবাই একইভাবে ভাবলে তখন আর ভিন্ন দিকগুলো দেখার কেউ থাকে না। সবাই মিলে একই চিন্তার মানুষ হলে সেখানে বড় ধরনের ঐক্য হয় না। একটি দলের সবাই একইভাবে চিন্তা করে, সেখানে মূলত শক্তি একটাই। কিন্তু একটি দলে একেকজন একেকভাবে চিন্তা করতে পারে এবং তারা যখন একত্রে হয়, তার ক্ষমতা অনেক। সেই ক্ষমতাকে রুখতে পারাটা অসম্ভব। সে কারণে ছোট একটি দলের ভেতর সিনারজি তৈরি করতে পারলে তারা অনেক বড় কিছু ঘটিয়ে ফেলতে পারে। একই কারণে কোন খেলায় কোচ একেকজন খেলোয়াড়কে একেক যোগ্যতায় বাছাই করে থাকেন। সবার যোগ্যতা এক ধরনের হলে সেই দল কখনই ভাল করতে পারে না। একটি দলে সিনারজি তৈরি করতে হলে দলের সদস্যদের প্রথম তিনটি অভ্যাস তৈরি করতে হবে। এই বইতে প্রথম যে তিনটি অভ্যাসের কথা বলা হয়েছে, সেগুলো কারও ভেতর তৈরি করতে পারলে তাদের ভেতরের ভিতটা খুব শক্ত হয়, তারা নিজেকে মেলে দিতে ভয় পায় না। তারা জানে নিজেকে মেলে দিলে যে ঝুঁকির মুখোমুখি হওয়া লাগতে পারে, সেটা তারা সামাল দিতে পারবে। যখনই তাদের ভিতটা শক্তিশালী হবে, তখন তাদের চতুর্থ এবং পঞ্চম অভ্যাস দুটো তৈরি সহজ হয়ে যাবে। এই পাঁচটি অভ্যাসের মিলিত ফলাফল হবে সিনারজি। বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে ছোটবেলা থেকেই প্রচ- প্রতিযোগিতার ভেতর ছেলেমেয়েদের বড় হতে হয়, সেখানকার ছেলেমেয়েরা খুবই লজিকাল হয়। তারা তাদের বাঁ দিকের ব্রেইন দ্বারা পরিচালিত হয়। তারা সব কিছুতে যুক্তি খুঁজে বের করে এবং প্রতিটি বিষয়কেই যৌক্তিক কিংবা অযৌক্তিক- এই দুটোর একটাতে ফেলে দেবে। তাদের মাথায় ডানদিকের ব্রেন আছে ঠিকই; কিন্তু সেটা একটিভ নয়। তার মাসলগুলো সক্রিয় নয়। তাদের ডানদিকের ব্রেন মূলত নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে আছে। এটা হয়েছে মূলত তাদের ভেতরে স্ক্রিপ্টটা ওভাবেই লেখা হয়ে গেছে। সেটা পরিবার থেকে, স্কুল থেকে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, চাকরি ক্ষেত্র থেকে, বৈবাহিক সম্পর্ক থেকে। বিশেষ করে আমাদের প্রথাগত যে শিক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে, তা আমাদের বাঁ দিকের ব্রেনকে সক্রিয় করতে সাহায্য করে এবং ডানদিকের ব্রেনকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। একজন মানুষ যখন তার ডানদিকের ব্রেনকেও এক্সেস করতে পারে, তখনই সে তার ক্রিয়েটিভি ভিজুয়াল ক্ষমতা এক্সেজ করতে পারে। তখনই কেবল তার দুটো ব্রেনই একত্রে কাজ করতে শুরু করে। আর তখনই আমাদের ভেতর এক ধরনের সাইকোলজিক্যাল সিনারজি তৈরি হয়। তখন আমরা বুঝতে পারি জীবনটা শুধু লজিক্যাল নয়, ইমোশনালও বটে। ॥ তিন ॥ আমাদের চারপাশে অনেক নেতিবাচক শক্তি থাকে, যারা কারও উন্নতিকে পেছন থেকে টেনে ধরে। বাংলাদেশে এটা আরও বেশি। তার কারণ হলো, আমাদের ভেতর স্কারসিটি (সম্পদের অভাব) মানসিকতা কাজ করে। আমরা বেশিরভাগ সময় ভাবি সম্পদ কম, তাই যতটা পারো নিজেরটা ঘরে নিয়ে আসো; প্রয়োজন হলে অন্যকে ঠকিয়ে হলেও। অনেক সময় আমরা বুঝতেও পারি না যে, এভাবে কাজটি করছি। সে কারণেই হয়ত আমাদের ভেতর একটি প্রচলিত কথা চালু আছে- নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করা। কিংবা যেই দোজখে বাঙালীরা আছে, সেখানে দারোয়ানের প্রয়োজন হয় না; একজন আরেকজনকে টেনে ধরে রাখে। এই ধরনের নেতিবাচক শক্তিকে কাটিয়ে যদি নিজেকে সামনে নিয়ে যেতে চান তাহলে সিনারজি ভাল একটা উপায়। আপনি ভিন্ন একজন মানুষের সঙ্গে সিনারজি করবেন, যে আপনার জন্য পরিপূরক। আপনার ভেতর যে গুণটি নেই, তার ভেতর যেন সেটা থাকে। আমাদের চারপাশে দুই ধরনের শক্তি আছে- ড্রাইভিং ফোর্স এবং রেস্ট্রেনিং (নিরোধক) ফোর্স। এটা পরিবারের ভেতর যেমন আছে, তেমনি আছে কর্মক্ষেত্রে, তেমনি আছে রাজনীতিতে এবং জীবন চলার প্রতিটি ধাপে। ড্রাইভিং ফোর্স মূলত ইতিবাচক, ন্যায়সঙ্গত, যুক্তিসঙ্গত, সচেতন এবং পরিমিত ব্যয়ী। অন্যদিকে নিরোধক শক্তি হলো নেতিবাচক, আবেগতাড়িত, যুক্তিহীন, অসচেতন এবং সামাজিক বা মানসিক। উভয় শক্তিরই অস্তিত্ব রয়েছে এবং যে কোন পরিবর্তনে দুটোকে মাথায় রাখতে হবে। আপনি যদি আপনার পরিবারের দিকে ভাল করে তাকান, সদস্যদের দিকে খেয়াল করেন দেখবেন সেখানেও ইতিবাচক এবং নেতিবাচক শক্তি রয়েছে। আপনি নিজের মত প্রকাশে, ভাব প্রকাশে কতটা নিরাপদ, কতটা স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করছেন, একটি কনসার্নকে কতটা সহজে প্রকাশ করতে পারছেন, কতটা সম্মানজনক কিংবা অসম্মানজনক ইত্যাদি অনেক কিছুই এসে আপনাকে ভর করে। আপনাকে ভাবতে হয়। দুটো শক্তিই এক সঙ্গে বসবাস করছে। এখন আপনি হয়ত এমন একটি পরিবেশ তৈরি করতে চাচ্ছেন যা অনেক বেশি খোলামেলা, অনেক বেশি ইতিবাচক, অনেক সম্মানজনক এবং অনেক বেশি বিশ্বাসের। আপনি চাইলেই কি সেটা পারছেন? কিন্তু আপনার এই চাওয়াটাই হলো ড্রাইভিং ফোর্স। এটা করার পেছনে আপনার নিশ্চয়ই কোন যুক্তি কাজ করছে। এটা কিন্তু আপনি হঠাৎ করেই আবেগপ্রবণ হয়ে করে ফেলছেন না। ড্রাইভিং ফোর্সগুলো এমনি হবে। আপনি আপনার ড্রাইভিং ফোর্সকে আরও বাড়িয়ে দিলেই আপনার কাজটি উদ্ধার হয়ে যাবে না। আপনার বিপরীতে রয়েছে রেস্ট্রেনিং ফোর্স। তারা আপনার ক্ষমতাকে বাধা দেবে। যেমন, পরিবারের সন্তানরা বাধা দেবে। কারণ তারা একটা প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে বড় হয়েছে, তারা সহযোগিতার চেয়ে প্রতিযোগিতাটা দেখে বেশি। আপনি আর আপনার স্ত্রী ভিন্নভাবে বড় হয়েছেন, আপনাদের মাথায় ভিন্ন স্ক্রিপ্ট লেখা হয়েছে। তাই একজন আরেকজনের কাজকে বাধা দেবেন। পরিবারের ভেতর আপনারা যেভাবে অভ্যাসগুলোকে তৈরি করেছেন সেগুলো বাধা দেবে। আপনি এবং স্ত্রী যে ধরনের কাজে অভ্যস্ত সেগুলো এসেও বাধা দেবে। আপনি পরিবারে একটি পরিবর্তন আনার চেষ্টা করুন। দেখুন তো সবাই একসঙ্গে আপনার সঙ্গে হাত লাগায় কি না? কোনরকম বাধা ছাড়া কাজটি করতে পারছেন কি না? আপনি যদি ড্রাইভিং ফোর্স বাড়ান তাতে কিছুটা ফল পাবেন। কিন্তু যতক্ষণ রেস্ট্রেনিং ফোর্স থাকছে ফলাফল ততটা ভাল হবে না এবং দিনকে দিন সেটা আপনার জন্য কঠিন হবে; আপনি একটা সময়ে শক্তি হারিয়ে ফেলবেন। এটা অনেকটা স্প্রিংয়ের বিপরীতে টান দেয়া। আপনি টানতে টানতে অনেকটা দূরে নিয়ে যেতে পারবেন। কিন্তু একটা সময় স্প্রিং তার শক্তি দিয়ে আপনাকে সেই আগের জায়গায় নিয়ে আসবে এবং কিছুদিন পরেই আপনার মনে হবে ধ্যাৎ মানুষ এমন খারাপ, এরা আর পাল্টাবে না। ভাববেন, পরিবর্তন আনাটা অসম্ভব। আপনি যদি অভ্যাস-৪ এবং অভ্যাস-৫ দক্ষতার সঙ্গে প্রয়োগ করতে পারেন এবং তাদের সঙ্গে সিনারজি তৈরি করার পথকে সুগম করে দেন, তাহলে তাদের রেস্ট্রেনিং ফোর্স নষ্ট হয়ে যাবে। ওই শক্তি দুর্বল হয়ে যাবে। তাদের সেই নেতিবাচক শক্তির নতুন রূপায়ণ হবে। ট্রান্সফর্মেশন হবে। তারা এটার সঙ্গে যুক্ত হবে। তারা বুঝতে পারবে এটা তাদের সমস্যা এবং তারাই এটার সমাধানে এগিয়ে আসবে। এর ফলে সম্মিলিত একটি নতুন টার্গেট তৈরি হবে, যা পুরো প্রতিষ্ঠানকে সামনের দিকে টেনে নিয়ে যাবে। ॥ চার ॥ ইকোলজি (বাস্তুসংস্থান) হলো এমন একটি শব্দ যা প্রকৃতিতে সিনারজির বিষয়টাকে তুলে ধরে। সেখানে বলা হয়ে থাকে সব কিছুই অন্য ‘সব কিছু’র সঙ্গে যুক্ত। আমরা যে অভ্যাসগুলোর কথা বলছি সেগুলোও একটা আরেকটার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। কেউ আলাদাভাবে একক সত্তা নিয়ে দাঁড়িয়ে নেই। আমাদের অভিধানে সিনারজি শব্দটা না থাকলেও এটা বাস্তবে কাজ করে। এটা পরিবার কিংবা প্রতিষ্ঠানে- যেখানেই এই পরিবেশ তৈরি করা যাবে সেখানেই সিনারজি কাজ করবে। এটা আমাদের আগের সকল ভাল অভ্যাসের সম্মিলিত অর্জন। যখনই কোথাও পরনির্ভর সমীকরণ থাকবে, টিমওয়ার্ক, টিম বিল্ডিং, নিজেদের মধ্যে ইউনিটি তৈরি করা এবং ক্রিয়েটিভি প্রকাশ করার জন্য সিনারজির বিকল্প নেই। যদিও আপনি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অন্য মানুষের ভাবনা এবং অভ্যাসকে পরিবর্তন করতে পারবেন না, তবে আপনার সার্কেল অব ইনফ্লুয়েন্সের ভেতর দেখবেন অনেকটা সিনারজি রয়ে গেছে। সেটুকু ব্যবহার করুন। আপনার নিজের ভেতর যে সিনারজি রয়েছে সেটা তো পুরোটাই আপনার নিয়ন্ত্রণে। আপনি নিজের ব্রেনের দুটো অংশকেই সম্মান দেখাতে পারেন- আপনার যৌক্তিক ব্রেন (বাঁ দিক), আর আপনার ক্রিয়েটিভ ব্রেন (ডানদিক)। আপনি এই দুটোর পার্থক্যকে সম্মান দেখাতে পারেন এবং এই পার্থক্যকে ব্যবহার করেই আরও বেশি ক্রিয়েটিভ হয়ে উঠতে পারেন। এমনকি খুব বৈরী পরিবেশেও আপনি নিজের ভেতর সিনারজি তৈরি করতে পারেন। কেউ আপনাকে অপমান করল, এটাকে আপনি খুব ব্যক্তিগতভাবে না নিয়ে ভাবুন যে, ওটা তার সমস্যা, আপনার নয়। এই পৃথিবীতে কত সহস্র সমস্যা জড়িত মানুষ রয়েছে। এরা নেতিবাচক শক্তি। এদের থেকে নিজেকে দূরে রাখুন। আপনি অন্য মানুষের ভেতর ভালটুকু খুঁজে বের করুন এবং সেটাকে নিজের ভেতর আনার চেষ্টা করুন। আপনি অন্যের ভিন্নমতকে সম্মান করতে শিখুন। যখন কেউ আপনার সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে তখন তাকে বলুনÑ ‘যাক, আপনি এটা ভিন্নভাবে দেখছেন। এবারে আমাকে বুঝিয়ে দিন।’ আর যখনই দেখতে পাবেন আপনার হাতে মাত্র দুটো অপশন আছে- আপনারটা এবং ভুলটাÑ তখনই তৃতীয় কোন অপশন আছে কি না খুঁটিয়ে দেখুন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তৃতীয় ভাল একটা সমাধান হাতের কাছেই রয়ে যায়। আপনি যদি উইন-উইন ভাবতে পারেন এবং অন্যকে সত্যিই বোঝার চেষ্টা করেন আপনি সব সময় তৃতীয় আরেকটি সমাধান পেয়ে যাবেন, যা সবার জন্য মঙ্গল। সিনারজি তৈরি হয়ে যাবে। ২৯ অক্টোবর ২০১৬ ুং@ঢ়ৎরুড়.পড়স
×