ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বছরে এক কোটি গাছ রোপণের ৫ সালা পরিকল্পনা ফাউন্ডেশনের

নিমগাছ এখন আর ফেলনা নয়, কদর বেড়েছে বিশ্ববাজারে

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ৩১ অক্টোবর ২০১৬

নিমগাছ এখন আর ফেলনা নয়, কদর বেড়েছে বিশ্ববাজারে

সমুদ্র হক ॥ দেশে অনাদরে জন্মানো অতি পরিচিত বৃক্ষ নিমের প্রতি বিশ্বের উন্নত দেশগুলো অনেক আগ্রহ দেখিয়েছে। নিমের প্রতি যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে সরকারের সহযোগিতায় দেশে গঠিত হয়েছে ‘বাংলাদেশ নিম ফাউন্ডেশন’। ইতোমধ্যে নিম গাছ রোপণের হার বেড়েছে। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে নিম চাষ বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে নিম ও নিমজাত পণ্যের বার্ষিক রফতানি প্রতিবছর ২০ শতাংশ হারে বেড়ে গেছে। নিম এভাবে প্রবেশ করেছে আন্তর্জাতিক বাজারে। দেশে ভেষজ ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা শাস্ত্রের উন্নয়নে সরকার সার্বিক সহযোগিতা দিচ্ছে। সারাবিশ্বে ভেষজ চিকিৎসায় গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ভেষজে নিম অন্যতম বড় উপাদান। তারই আলোকে ঢাকায় পঞ্চম জাতীয় নিম সম্মেলন ও তৃতীয় হারবাল ওয়ার্ল্ড এক্সপো প্রদর্শনী হয়েছে। সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয়েছে দেশে প্রতিবছর এক কোটি করে নিম গাছ রোপণ করা হবে। এই অভিযান চলবে পাঁচ বছর। পাঁচ বছরে দেশে অন্তত পাঁচ কোটি নিম গাছ রোপিত হবে। দেশের প্রতিটি গ্রামে একটা সময় একাধিক নিম গাছ রোপণ করা হতো। গৃহস্থ ও কিষান বাড়িতে আম কাঁঠালের সঙ্গে নিম গাছ রোপণ ছিল অতি আগ্রহের। পুকুরের চার ধারে নিম গাছ রোপণের পর সেই বৃক্ষ বড় হলে পুকুরের পানি হয় স্বাস্থ্যসম্মত। নিকট অতীতে গ্রামের খুলিতে (বহিরাঙিনা) অনেকে নিম তলায় বসে কিংবা শুয়ে থাকত। প্রবীণরা বলেন, নিম গাছের এতটাই গুণ যে নিম গাছের নিচের হাওয়া পর্যন্ত স্বাস্থের জন্য উপকারী। এখনও অনেকে নিমের ডালে দাঁত মাজেন। শরীরের কোথাও চর্মরোগ হলে বা কোথাও কেটে গেলে নিমের পাতায় গরম পানিতে ক্ষত স্থান পরিষ্কার করা হলে দ্রুত সেরে ওঠে। নিম পাতার রস প্রতিদিন সকালে পান করলে রক্ত পরিষ্কার থাকে। দেশে নিম গাছ রোপণের আবহাওয়া অন্যান্য দেশের চেয়ে উপযোগী। শীত গ্রীষ্ম বর্ষায় নিম গাছ রোপণ আবহাওয়া অনুকূলে থাকে। নিম গাছ রোপণে বড় বৈশিষ্ট্য হলো, পাতা ও ছাল তেঁতো থাকায় ছাগল ও অন্য পশু পাখির উপদ্রব থাকে না। সহজেই বেড়ে ওঠে। বহু আগেই দেশের আনাচে কানাচে নিম গাছ গজিয়ে ওঠার পালা শুরু হয়। নিমের সার্বিক উপকারিতা লক্ষ্য করে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে বহু যুগ আগে কৃষি জমিতে সযতেœ নিমের চাষ শুরু হয়েছে। তাদের চিকিৎসা বিজ্ঞানে নিমের ব্যবহার বেড়েছে। ওষুধ, প্রসাধনসহ নানা পণ্যে তারা নিমের পাতা ছাল বাঁকল তেল ব্যবহার করছে। ভারত চিকিৎসা বিজ্ঞানে নিমের ব্যবহার বাড়িয়ে উন্নত ওষুধ তৈরি করছে। ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউটিও) এক হিসাবে বলা হয়েছে, ষাটের দশকের শেষ ভাগে উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ৫৩ মিলিয়ন ডলারের নিমজাত পণ্য আমদানি করে। গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শেষে এই হার জ্যামিতিক হারে বেড়ে দাঁড়ায় ৯০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ’১৫ সালে উন্নত দেশগুলো কত বিলিয়ন ডলারের নিমজাত পণ্য আমদানি করেছে সেই হিসাব আক্ষরিক অর্থেই চোখে চড়ক গাছ দেখায়। এই পরিমাণ অন্তত তিন হাজার বিলিয়ন ডলার। যার বেশিরভাগই আমদানি করা হয়েছে এই উপমহাদেশ থেকে। বিশেষ করে ভারত থেকে। পাশ্চাত্য আগে এই আগ্রহ তেমন দেখায়নি। উন্নত দেশগুলো নিমের বহুমুখী ব্যবহারকে সামনে রেখে নিমজাত দ্রব্য আমদানিতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও উপমহাদেশের দেশগুলোর প্রতি নির্ভর করা শুরু করেছে। বাংলাদেশেও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে নিম রফতানি শুরু হয়েছে। তবে বিষয়টি এখনও মাঠ পর্যায়ে ছড়ায়নি। গ্রামের গৃহস্থ ও কিষান বাড়ির উঠানে নিজ উদ্যোগে ও আগ্রহে নিম গাছ রোপণ করা হয়। পরিকল্পনা করে কেউ নিম গাছ রোপণ করে না। হালে হাতেগোনা কয়েকটি এলাকায় ঔষধি নার্সারিতে নিম গাছ রোপিত হতে দেখা যায়। বর্ষা মৌসুমে বৃক্ষ রোপণের সময় বন বিভাগ বিভিন্ন গাছের চারা রোপণের পরামর্শ দিয়ে চারা বিক্রি করে। তারা বৃক্ষ মেলারও আয়োজন করে। তবে নিম গাছের উপকারিতা ও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে রোপণ করলে যে রফতানি আয়ের বড় পথ সৃষ্টি হয় প্রচার কার্যক্রমে তার উল্লেখ থাকে কমই। বাংলাদেশ নিম ফাউন্ডেশন গঠিত হওয়ার পর কিছু প্রচার শুরু হয়েছে। তাও বিচ্ছিন্নভাবে। মাঠ পর্যায়ে ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম চোখে তেমন পড়ে না। উদ্যোগ নিলে নিমের রফতানি আয় অনেক বেড়ে যাবে। এক ভেষজ চিকিৎসক জানালেন, নিমের তেল ও রস মানুষ, পশু পাখির তথা প্রাণিকূলের দেড় শ’ ধরনের রোগ নিরাময়ে সহায়তা করে। শতাধিক রোগ দমিয়ে রাখে। নিমের তেলে রয়েছে বিরল গুণ। কোন পরিবার পাঁচটি নিম গাছ রোপণ করলে ১০ বছর পাতা বীজ তেল ও ডালপালা বিক্রি করে দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে পারে। নিমের খামার লাভজনক। এক একরে প্রায় ৬শ’ নিম গাছ রোপণের পর পরবর্তী দশ বছরে নিমের পাতা, ডাল, ছাল, রস বিক্রি করে আয় হবে অন্তত ৪০ লাখ টাকা। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে নিমের খামার গড়ে নিম রফতানি করে বিশ্বের কাছে সুনাম কুড়িয়েছে। বাংলাদেশও সহজে নিম উৎপাদন বাড়িয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে বড় আসন করে নিতে পারে।
×