ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মতিঝিলে পার্কিং বিল্ডিং থাকা সত্ত্বেও কেউই ইজারা নেয় না

যেমন খুশি গাড়ি পার্কিং, কারও দায়িত্ব নেই

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ৩১ অক্টোবর ২০১৬

যেমন খুশি গাড়ি পার্কিং, কারও  দায়িত্ব নেই

আরাফাত মুন্না ॥ রাজধানীর বড় সমস্যার একটি গাড়ির পার্কিং। শহরজুড়ে পর্যাপ্ত পার্কিংয়ের ব্যবস্থাই নেই, আবার যেখানে আছে সেখানে যেতে আগ্রহী নয় মালিক-চালকরা। পর্যাপ্ত কার পার্কিং ব্যবস্থা না থাকা এবং গাড়ির মালিক ও চালকদের স্বেচ্ছাচারিতাÑ দুটোই এ সমস্যার জন্য দায়ী। অবৈধ কার পার্কিংয়ের অতি পরিচিত একটি জায়গা শহরের অন্যতম বাণিজ্যিক এলাকা মতিঝিল। রাজধানীর বাংলামোটর থেকে শুরু করে মগবাজার পর্যন্ত এলাকায় রাস্তার দুই ধারে গড়ে উঠেছে কার ডেকোরেশনের মার্কেট। শুধু এ এলাকা নয়, বিজয়নগর ও পল্টন এলাকায়ও রয়েছে এ ধরনের গাড়ির সাজসজ্জার দোকান। বাংলামোটর গেলে যে কেউ দেখবেন ২০ গজ সামনে বাংলামোটর মোড়েই রয়েছে একটি পুশিল বুথ। এ বুথের এত কাছে এভাবে অবৈধ পার্কিং করে যান চলাচলে বাধা সৃষ্টি করা হলেও ভ্রƒক্ষেপ নেই ওই বুথের পুলিশ সদস্যদের। বরং অনেক সার্জেন্টই এসব কার ডেকোরেশনের দোকান থেকে মাসোয়ারা (মাসিক ভিত্তিতে টাকা) নেন বলে অভিযোগ আছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই মার্কেটের এক কর্মচারী জনকণ্ঠকে বলেন, পুলিশ মাঝে মধ্যে এসে অনেক গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা করে। দোকানের মালিকদের কিছু বলে না? এমন প্রশ্নে ওই কর্মচারী বলেন, মালিকদের বলবে কেন, মালিকরা তো মাসে মাসে টাকা দেয়। পুলিশ কত দিন পরপর এখানে রাখা গাড়িগুলোকে মামলা দেয়? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, দু-এক মাস পরপর। দোকান মালিকরা টাকা দেয়ার পরও পুলিশ কেন মামলা দেয়? এমন প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মচারী জানান, ‘পুলিশরা মাঝে মধ্যে এসে বলে আজ দু’একটা মামলা দিতে হবে, নয়ত একটু সমস্যা আছে।’ এতেই বোঝা যায় কেমন করে চলে এসব। প্রতিদিন মতিঝিলে আসতে হয় এমন একজনের নাম জামিল আহমেদ। তিনি বলছিলেন, বড় কোন ভবন থেকে মতিঝিলের রাস্তার দিকে তাকালে মনে হবে রাস্তা নয় গাড়ি বেচা-কেনার বড় এক হাট। রাস্তার বেশির ভাগজুড়েই থাকে এই অবৈধ পার্কিং। সকালে অফিসে আগতদের যেমন দুর্ভোগ পোহাতে হয়, সন্ধ্যায় ফেরার পথেও একই দুর্ভোগ। এ যন্ত্রণা নিত্যদিনের হলেও কারও যেন কিছু করার নেই। এ দুর্ভোগ থেকে কবে মুক্তি মিলবে? প্রশ্ন জামিলের। একটি বেসরকারী ব্যাংকের কর্মকর্তা জামিল গত তিন বছর ধরে নিয়মিত মতিঝিলে আসছেন। তার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, মাঝে মধ্যে দেখি উচ্ছেদ হয় আবার দুই-চার দিন পরপর একই অবস্থা। এ উচ্ছেদ-উচ্ছেদ খেলার মানে কী? জামিল বলছিলেন, আমাদের নগরজীবন নানা সমস্যায় পরিপূর্ণ। প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের সমস্যা-সঙ্কট মোকাবেলা করে চলতে হয় আমাদের। এর ওপর মতিঝিলে এমনভাবে গাড়িগুলো পার্কিং করে রাখা হয়, যাতে আমাদের মতো সাধারণ মানুষদেরও চলাচলে সমস্যার সৃষ্টি হয়। তিনি এসব অবৈধ কার পার্কিংকে রাজধানীর যানজটের অন্যতম কারণ বলে আখ্যায়িত করেন। জামিল বলেন, মাঝে মধ্যে মনে হয়, সমস্যার সঙ্গে যুদ্ধ করে কোনভাবে বেঁচে আছি আমরা। অনেক ক্ষেত্রে বসবাসের অযোগ্য মনে হলেও শত প্রতিকূলতা নীরবে মুখ বুজে সয়ে যেতে হয়। এভাবেই চলছে দিনের পর দিন। ক্রমেই অবস্থা ভাল হওয়ার বদলে আরও খারাপ হচ্ছে। ঢাকায় যে হারে গাড়ি বাড়ছে, সে তুলনায় পার্কিং ব্যবস্থার উন্নতি হচ্ছে না। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের এ শহরটি বসবাসের অযোগ্যই হয়ে যাবে। মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা বিল্লাল হোসাইন বলছিলেন, আসাদ গেট থেকে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার রাস্তা। ৩০ ফুট এ রাস্তাটির দুই পাশেই দুই লাইনে পার্কিং করা থাকে অসংখ্য প্রাইভেটকার। দুই পাশেই পার্কিং করে রাখায় পাশাপাশি দুটি গাড়ি যাওয়ার জায়গা থাকে না। তিনি বলেন, এ কারণে এক কিলোমিটারেরও কম এ রাস্তাটি পার হতে সময় লাকে এক থেকে দেড় ঘণ্টা। আর এ রাস্তাটির কারণেই পুরো মোহাম্মদপুরেই দীর্ঘ যানজট লেগে থাকে বলে বিল্লালের দাবি। মতিঝিল কিংবা মোহাম্মদপুর নয়, রাজধানী ঢাকার অধিকাংশ এলাকারই একই অবস্থা। বাংলামোটর থেকে মগবাজার মোড় (রাশেদ খান মেনন সড়ক), এ রাস্তাটির দু’পাশেই পার্কিং করা থাকে ব্যাক্তিগত গাড়ি। তবে এখানে বেশির ভাগ গাড়ি পার্কিং করা হয় বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে। বাংলামোটরে রয়েছে ২০ থেকে ২৫টি কার ডেকোরেশনের দোকান। দোকানগুলো রাস্তার ওপরে গাড়ি রেখে এমনভাবে কাজ করে, মাঝে মধ্যে একটি রিক্সাও যেতে পারে না। আর দোকানের সামনের ফুটপাথগুলোর এমন অবস্থা, দেখলে মনে হবে সাধারণ মানুষের চলাচল নিষেধ। এছাড়া রাশেদ খান মেনন সড়কের দিলু রোড থেকে মগবাজার পর্যন্ত রাস্তায়ও অনেক কার ডেকোরেশনের দোকান রয়েছে। এ রাস্তার দুই পাশের অর্ধেকেরও বেশি জায়গা দখল করে রাখে তারাই। বাংলামোটরের শামিম কার ডেকোরেশনের মালিক শামিম আহমেদের সঙ্গে কথা বললে তিনি বলেন, আমরা এখানে অনেক টাকা বিনিয়োগ করে ব্যবসা করছি। মার্কেটের সামনে কোন জায়গা নেই, বাধ্য হয়ে আমাদের রাস্তায় গাড়ি রেখে কাজ করতে হচ্ছে। এভাবে গাড়ি রাখায় সাধারণ মানুষের চলাচলে কষ্ট হচ্ছে কিনাÑ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, একটু কষ্ট হচ্ছে, তবে আমাদেরও কিছু করার নেই। বাংলামোটরে ডেকোরেশনের কাজ করতে আসা একটি গাড়ির ড্রাইভার নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে বলেন, এখানে গাড়ি নিয়ে আসলে দোকানদাররাই রাস্তায় রাখতে বলেন। কিন্তু যখন পুলিশ এসে মামলা দেয় তখন তারা কোন দায়িত্ব নেয় না। পুলিশ ঠিকই আমাদের মামলা দিয়ে দেয়। এছাড়া অন্য কোথাও রাস্তায় পার্কিং করেন কিনা? এমন প্রশ্নে এই চালক বলেন, ‘স্যারের অফিস কাওরানবাজারে, ওখানেও রাস্তায়ই রাখতে হয়। স্যারই রাস্তায় রাখার জন্য বলেছেন।’ সরেজমিন দেখা গেছে, রাজধানীর মতিঝিল, গুলিস্তান, দৈনিক বাংলা, পল্টন মোড়, বিজয়নগর, নয়াপল্টন, বেইলি রোড়, নিউমার্কেট, মোহাম্মদপুর, বাংলামোটর, মহাখালী, উত্তরাসহ দুই সিটি কর্পোরেশনের অধিকাংশ এলাকার সড়কগুলোতে একই অবস্থা বিরাজ করছে। যেন চলছে অবৈধভাবে গাড়ি পার্কিংয়ের মহোৎসব। আরও দেখা গেছে, আবাসিক এলাকাগুলোর তুলনায় বাণিজ্যিক এলাকায় রাস্তায় গাড়ি পার্কিং বেশি করা হয়। এসব এলাকায় বেশিরভাগ ভবনেই পর্যাপ্ত গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা নেই। কিছু কিছু ভবনের গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গায় গড়ে উঠেছে মার্কেট, দোকান, অফিস ও রেস্টুরেন্টসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। ফলে নগরবাসীর অনেকেই বাধ্য হয়ে সড়ক দখল করে যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং করতে বাধ্য হচ্ছে। এভাবে গাড়ি রাখায় সড়ক প্রস্থে ছোট হয়ে যায়। ফলে অতিরিক্ত যানবাহনের চাপে নগরীতে অসহনীয় যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। তাছাড়া রাজধানীতে গাড়ি পার্কিংয়ের কোন নীতিমালা না থাকায় গাড়িচালক ও মালিকরা এ বিষয়ে কারও কোনো কথাই শোনেন না। এই চিত্রের ভিন্ন চিত্র রয়েছে অনেক। যেখানে পার্কিংয়ের কোন ব্যবস্থা নেই, বাধ্য হয়ে সেখানে গাড়ি রাখলেও পড়তে হয় বিড়ম্বনায়। কোন কথা না শুনেই মামলা ঠুকে দেন ট্রাফিক সার্জেন্ট। বুধবার মতিঝিল ও দিলকুশা ঘুরে দেখা গেছে, সব সড়কের ওপর অবৈধভাবে শত শত গাড়ি পার্কিং করে রাখা হয়েছে। দিলকুশার সাধারণ বীমা ভবনে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা থাকলেও এ ভবনটির উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্বদিকে রাস্তার ওপরই লাইন করে রাখা হয়েছে গাড়ি। এখানে পার্কিং করা একটি গাড়ির ড্রাইভার তাজুল ইসলাম জানান, তাকে তার গাড়ির মালিক রাস্তার ওপর গাড়ি পার্ক করে রাখতে বলেছেন। তাই তিনি সেখানে পার্কিং করেছেন। এর পাশেই ওই সময় কয়েক পুলিশ সদস্যকে একটি গাড়ির কাগজ চাইতে দেখা গেছে। কিন্তু ওই গাড়ির ড্রাইভার পুলিশকে কোন কাগজ না দিয়ে মোবাইল ফোন তুলে দেন গাড়ির মালিকের সঙ্গে কথা বলার জন্য। পুলিশও রীতিমতো গাড়ির মালিকের সঙ্গে কথা বলে অন্যদিকে চলে যায়। একদিকে যানজট অন্যদিকে জনভোগান্তি বাড়ছে। সম্প্রতি ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আনিসুল হক, দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সড়কে গাড়ি পার্কিং না করতে সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ করেছেন। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার জন্যও প্রশাসনকে কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু মেয়র ও মন্ত্রীর এমন নির্দেশের পরও রাজধানীর সড়কে অবৈধ গাড়ি পার্কিং বন্ধ হচ্ছে না। বিশেষ করে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) চেয়ে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকায় সড়কে অবৈধ গাড়ি পার্কিং বেশি লক্ষ্য করা গেছে। নগরীর যত্রতত্র গাড়ি পার্কিংয়ের ফলে যানজট সৃষ্টি হওয়ায় এ সমস্যা নিরসনে ২০০৭ সালে রাজধানীর বিভিন্ন স্পটে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন গাড়ি পার্কিংয়ের মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু অর্থের অভাবে এখন পর্যন্ত এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। ফলে যত্রতত্র গাড়ি পার্কিংয়ে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় যানজট লেগেই থাকছে। ডিএসসিসির কয়েক কর্মকর্তা জানান, রাজধানীতে গাড়ি পার্কিংয়ের নীতিমালা তৈরি করা খুবই জরুরী। এ ব্যাপারে নীতিমালা তৈরি করে তা বাস্তবায়ন করা গেলে নগরীতে যানজট কমার পাশাপাশি কর্তৃপক্ষের আয়ও বাড়বে। এ নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকার দুই সিটি মেয়র আলোচনাও করেছেন। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে যে টাকা লাগবে সে টাকা পাওয়ার কোন সম্ভাবনা না থাকায় দুই মেয়রের আলোচনা আর এগোয়নি। সূত্রমতে, রাজধানীতে দুই সিটি কর্পোরেশনের ছয়টি সুবিধাজনক পার্কিংয়ের স্থান রয়েছে। এর মধ্যে মতিঝিল ও দিলকুশায় রয়েছে দুটি। বাকি চারটি হলো শিশুপার্ক সংলগ্ন কার পার্ক, মোহাম্মদপুর টাউন হল সংলগ্ন কার পার্ক, নিউমার্কেট কাঁচাবাজার সংলগ্ন কার পার্ক, মোহাম্মদপুর নতুনবাজার সংলগ্ন কার পার্ক। এ পার্কিংয়ের স্থানগুলোতে সর্বোচ্চ দেড় হাজার পর্যন্ত গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু এসব পার্কিংয়ের স্থানে গাড়ি পার্কিং করার বিষয়ে চালকদের সব সময় অনীহা লক্ষ্য করা যায়। এছাড়া ডিএসসিসির পক্ষ থেকে মতিঝিল ও দিলকুশায় দুটি দামী জায়গা ডেভেলপারকে দিয়েছিল গাড়ি পার্কিং স্পেস নির্মাণের জন্য। এ দুটি গাড়ি পার্কিংয়ের নির্মাণ কাজ শেষ হলেও কর্তৃপক্ষ এখনও তা পার্কিং হিসেবে ব্যবহার করতে পারেনি। এর মধ্যে মতিঝিলে দুই বিঘা জমির ওপর নির্মিত ৩৭ তলা সিটি সেন্টারের দ্বিতীয় থেকে আটতলা পর্যন্ত ডেভেলপার কোম্পানি ওরিয়ন গ্রুপ আরো প্রায় সাড়ে তিন বছর আগেই ডিএসসিসিকে বুঝিয়ে দিয়েছে। এ গাড়ি পার্কিং স্পেসের জন্য দফায় দফায় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েও ইজারাদার মেলাতে না পারায় মূল্যবান এ ফ্লোরগুলো এখন অব্যবহƒত অবস্থায় পড়ে আছে। সম্প্রতি নগর ভবনে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কমিটির সভায় সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, রাজধানীতে যেখানে সেখানে গাড়ি পার্কিং করায় পথচারীরা পড়ছেন নানা বিড়ম্বনায়। অন্যদিকে সৃষ্টি হচ্ছে তীব্র যানজট। অথচ পার্কিংয়ের জন্য যে স্থান রয়েছে তা খালি পড়ে আছে। কেউ যাতে যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং না করে সে বিষয়েও প্রশাসনকে কঠোর নির্দেশ দেন তিনি।
×