ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

হলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলা ও খাগড়াগড় বিস্ফোরণের নথিপত্র ঘেঁটে এমন তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা

বাংলাদেশ ও ভারতে অস্থিরতা সৃষ্টির নেপথ্যে আইএসআই

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ৩১ অক্টোবর ২০১৬

বাংলাদেশ ও ভারতে অস্থিরতা সৃষ্টির নেপথ্যে আইএসআই

শংকর কুমার দে ॥ বাংলাদেশ ও ভারতের মাটিতে জঙ্গী তৎপরতা, অস্ত্র গোলাবারুদ-বিস্ফোরক দ্রব্য ও জাল টাকার চোরাচালানের মাধ্যমে দুই দেশেই পরিকল্পিত রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে। এ ধরনের আন্তঃদেশীয় একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার কৌশল নিয়েছে পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। গুলশানের হলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলা ও খাগড়াগড়ে বোমা বিস্ফোরণ ঘটনার পর পৃথক তদন্তে এ ধরনের তথ্য প্রমাণ পেয়েছে দিল্লী ও ঢাকার গোয়েন্দা সংস্থা। গত দুই বছর ধরে বিভিন্ন সময়ে দুই দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও গোয়েন্দা সংস্থার মধ্যে কয়েক দফা বৈঠকে জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাসবাদ, দুর্বৃত্তায়ন, অর্থায়ন মোকাবেলায় তথ্য ও মতামত বিনিময়সহ কর্মকৌশল নির্ণয়ে ঐকমত্য পোষণ করেছে দুই দেশই। আইএসআইয়ের মদদে পাকিস্তানী অস্ত্র কারিগর দিয়ে মালদহে অস্ত্র তা ঢাকায় পাঠিয়ে হলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলা চালানোর তথ্য প্রমাণ মিলেছে। জানা গেছে, বাংলাদেশে টার্গেট কিলিংয়ে আন্তর্জাতিক যোগসূত্র আছে কিনা, তা খুঁজে বের করার আগেই হত্যার দায় স্বীকার করে আইএস। আর এসবের অন্তরালে কলকাঠি নেড়েছে আইএসআই গুলশান হামলার পর দৌলাতুল ইসলামের ব্যানারে হামলার পক্ষে একটি ভিডিও প্রকাশ করা হয়। তাতে বাংলাদেশী তিন যুবক হামলার পক্ষে বক্তব্য দেন। ফুটেজটি বিশ্লেষণ করে ধারণা করা হচ্ছে, ব্যাকগ্রাউন্ড দৃশ্যপট পাক সীমান্তবর্তী কোন অঞ্চলের। গত বছরের নবেম্বরের শেষদিকে ইদ্রিস শেখসহ চার জেএমবি সদস্যকে গ্রেফতারের পর আইএসআই’র যোগসূত্রের বিষয়টি আবারও সামনে চলে আসে। গোয়েন্দারা এ সময় বাংলাদেশে জঙ্গীবাদ বিস্তারে ঢাকায় পাকিস্তান হাইকমিশনের তৎকালীন সেকেন্ড সেক্রেটারি (রাজনৈতিক) ফারিনা আরশাদের যোগসূত্রও খুঁজে পান। হলি আর্টিজানে হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্র তৈরি ও প্রশিক্ষণের বিষয়ে পাকিস্তানের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া গেছে। হলি আর্টিজানে হামলার এক সপ্তাহের মধ্যেই শোলাকিয়ায় হামলার পর পুলিশের আইজি শহীদুল হক বলেছিলেন, এসব হামলার সঙ্গে জেএমবি জড়িত। থাকতে পারে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেছেন, দুবাই থেকে অর্থ ও ভারত থেকে অস্ত্র এসেছে। অস্ত্র আসার বিষয়টি পরে তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে। দুবাই থেকে যে অর্থায়ন ঘটেছে তা সম্ভবত ঘটেছে পাকিস্তান থেকে দুবাইয়ে এবং দুবাই থেকে বাংলাদেশেÑ এমন চক্রাকারে। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, দৌলাতুল ইসলামের ব্যানারে প্রচারিত ভিডিও ফুটেজে বাংলাদেশী তিন যুবকের মধ্যে তুষার জেএমবির অনুসারী। আরেক যুবক জুন্নুন শিকদার এবিটি এবং তাহমিদ শাফী হিযবুত তাহরীরের অনুসারী বলে জানা গেছে। এই তিন যুবকের সঙ্গে গুলশানে হামলাকারীদের যোগসাজশ ছিল গোয়েন্দারা। হলি আর্টিজানে থান্ডার বোল্ট অভিযানের পর ঘটনাস্থল থেকে একটি সাদা রুমাল উদ্ধার করা হয়। সেখানে লেখা ছিলÑ ‘দৌলাতুল ইসলাম টিকে থাকবে।’ জঙ্গীদের প্রশিক্ষণ ও হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্র ও বিস্ফোরক কারা সরবরাহ করেছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। জঙ্গীবাদ বিস্তারে বিদেশী জঙ্গীরা বাংলাদেশে লক্ষ্য নির্ধারণ করে নাশকতার চেষ্টা চালাচ্ছে। বিশেষ করে পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গী সংগঠনগুলো এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে। পাকি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই তাদের মদদ দিচ্ছে বলেও তথ্য উঠে এসেছে। এমনকি ভারতে জাল রুপী পাচার করে পাকি জঙ্গীদের আর্থিক সহায়তা দেয়ার তথ্যও পেয়েছেন গোয়েন্দারা। গুলশানে হামলাকারীরা প্রশিক্ষিত জঙ্গী। তারা দীর্ঘদিন ধরে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। তারা দেশে ঐ দেশে প্রশিক্ষণ নিয়েছে। গোয়েন্দাদের ধারণা জেএমবি, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি) ও হিযবুত তাহরীর সমন্বিতভাবে এ হামলা চালিয়েছে। তাদের এক প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসতে বিদেশী জঙ্গী ও আইএসআই নেপথ্যে কাজ করেছে পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গী সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বা, তেহরিক-ই তালিবান ও জইশ-ই-মুহাম্মদের যেসব সদস্য বাংলাদেশে গ্রেফতার হয়েছিল তাদের ব্যাপারে বিশেষভাবে খোঁজখবর নিচ্ছেন গোয়েন্দারা। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের নবেম্বরে উত্তরা ও খিলগাঁও থেকে জেএমবির চার সদস্যকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তাদের মধ্যে ইদ্রিস ও মকবুলের কাছে পাকিস্তানী পাসপোর্ট পাওয়া যায়। ইদ্রিসের কাছ থেকে একটি স্পাই মোবাইল সেট উদ্ধার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে সে ডিবিকে জানায়, এটি পাকিস্তানের একটি রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা তাকে সরবরাহ করেছিল। এ ঘটনার পর ইদ্রিস আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীও দেয়। জবানবন্দীতে সে বলেছে, পাকিস্তান হাইকমিশনের সেকেন্ড সেক্রেটারি ফারিনা আরশাদ বাংলাদেশে জঙ্গীবাদ বিস্তারে কাজ করছেন। এ ঘটনার পর পাকিস্তান সরকার তাকে প্রত্যাহার করে নেয়। গত বছরের জানুয়ারিতে জঙ্গী অর্থায়নে জড়িত থাকার অভিযোগে পাকিস্তান হাইকমিশনের কর্মকর্তা মাজহার খানকে বাংলাদেশ বহিষ্কার করে। এসব ঘটনার ধারাবাহিকতায় হলি আর্টিজান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গী হামলার পরম্পরা ও সম্ভাব্য যোগসূত্র খতিয়ে দেখছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। ঘেটে দেখা গেছে, ২০০৮ সালের শেষের দিকে ভারতীয় জাল রুপীসহ কলকাতায় গ্রেফতার হন পাকিস্তানী নাগরিক সরফরাজ। তিনি ঢাকার কর্ণফুলী গার্ডেন সিটির একটি ফ্ল্যাটে থাকতেন। পাকিস্তান থেকে জাল রুপী এনে তিনি সে সময় বাংলাদেশ দিয়ে ভারতে পাচার করতেন। তিনি লস্কর-ই-তৈয়বার সক্রিয় সদস্য। ২০০৯ সালের শেষের দিকে রাজধানী থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে লস্কর-ই-তৈয়বার ছয় সদস্যÑ মুফতি হারুন ইজহার, শহীদুল ইসলাম সুজন, সাইফুল ইসলাম, আব্দুল করিম, আশরাফ জাহিদ ও মনোয়ার আলী। বাংলাদেশে নাশকতা চালানোর ষড়যন্ত্র ছিল তাদের। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয় জইশ-ই-মুহাম্মদের পাঁচ সদস্য। এর মধ্যে রিজওয়ান আহমেদ নামে এক পাকিস্তানী ছিল। সে সমরাস্ত্র, বিস্ফোরক তৈরি ও অস্ত্র চালনায় পারদর্শী। বাংলাদেশী জঙ্গীদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিতেই সে বাংলাদেশে এসেছিল। শুধু তাই নয়, আইএসআইয়ের মদদে সম্প্রতি পাকিস্তানে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছে বাংলাদেশের ৭ জেএমবির জঙ্গী সদস্য। প্রশিক্ষণ গ্রহণকালে বিভিন্ন সময়ে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে ৪ জঙ্গী। অপর ৩ জেএমবি জঙ্গী প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরে এসেছে বাংলাদেশে। পাকিস্তানে প্রশিক্ষণ নিয়ে ৩ জঙ্গী ফিরে আসার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছে। ৩ জঙ্গীর জবানবন্দীতে জামায়াতের সহযোগিতায় পাকিস্তানে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে বাংলাদেশে এসে নাশকতা চালানোর চক্রান্ত তাদের ছিল বলে স্বীকারোক্তি দিয়েছে। পাকিস্তান ফেরত নিহত ৪ জঙ্গীর দুজনের পরিচয় পেরেছেন গোয়েন্দারা। এরা হচ্ছে সাইজুদ্দিন ওরফে কারগিল ও শামিম। অপর নিহত ২ জঙ্গীর নাম সংগ্রহের চেষ্টা করছেন গোয়েন্দারা।
×