ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কর্মচারীদের বসার জায়গা হিসেবে ব্যবহার করার জন্য ভবন চেয়ে প্রধান বিচারপতির চিঠির উত্তরে আইন মন্ত্রণালয়

ট্রাইব্যুনাল ভবন নিলে সুপ্রীমকোর্ট দেশবাসীর কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হবে

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ৩১ অক্টোবর ২০১৬

ট্রাইব্যুনাল ভবন নিলে সুপ্রীমকোর্ট দেশবাসীর কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হবে

বিকাশ দত্ত ॥ ৭৪ দিনের মাথায় সুপ্রীমকোর্ট এলাকা থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সরিয়ে নেয়ার বিষয়ে সুপ্রীমকোর্র্ট প্রশাসনের দেয়া চিঠির জবাব দিয়েছে আইন মন্ত্রণালয়। রবিবার আইন মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে ট্রাইব্যুনাল না সরানোর অনুরোধ জানিয়ে বলা হয়েছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম বন্ধ করে পুরাতন হাইকোর্ট ভবনটির দখল বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের অনুকূলে হস্তান্তর করা হলে তা বর্তমান প্রেক্ষাপটে সর্বজনগ্রাহ্য হবে না বরং বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট দেশবাসীর কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এ ভবনটি পূর্ববাংলা ও আসাম প্রদেশের গবর্নর এর সরকারী বাসভবন হিসেবে নির্মাণ করা হয়। সবশেষে পুরাতন হাইকোর্ট ভবনে অবস্থিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে বিচার কাজ শুরু হয়। অনেক কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীর বিচার কাজ সুসম্পন্ন হয়। সে কারণে এ ভবনটির ঐতিহ্য আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের জনগণ চায় যে এ ভবনটি ঐতিহাসিক ভবন বিধায় সে মর্যাদাকে সমুন্নত রেখে ভবনটি সংরক্ষণ করা হোক। এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এখান থেকে সরানো না হোক। এটা সরানো হলে জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি হবে এবং দেশের সঠিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতার ক্ষেত্রে এ স্থানান্তর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। আইন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব মোঃ তৈয়বুল হাসান স্বাক্ষরিত এই চিঠিটি সুপ্রীমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল বরাবরে পাঠানো হয়েছে। রেজিস্ট্রার জেনারেল সৈয়দ আমিনুল ইসলামকে টেলিফোনে পাওয়া না পাওয়া গেলেও সুপ্রীমকোর্টের রেজিস্ট্রার আবু সৈয়দ দিলজার হোসেন জনকণ্ঠকে বলেছেন, আইন মন্ত্রণালয়ের চিঠি পেয়েছি। এটা ফাইলে উঠানো হবে। পরবর্তীতে প্রধানবিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা সিদ্ধান্ত নেবেন। তিনি আরও বলেন শীঘ্রই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেয়া হবে বলে আশা করছি। এদিকে আইন মন্ত্রণালয়ের চিঠির জবাবের বিষয়ে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহম্মেদ জনকণ্ঠকে বলেন, পুরাতন হাইকোর্ট ভবন থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সরানোর প্রশ্নই উঠে না। এটা একটি ঐতিহাসিক স্থান। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষে এটাকে যাদুঘর হিসেবে রক্ষা করা হোক। তিনি আরও বলেন যতদিন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা তদন্ত করে দেখবে আসামি পাওয়া যাচ্ছে ততদিন ট্রাইব্যুনালের বিচার কাজ চলবে। আর যখন আসামিদের তথ্য উপাত্ত পাওয়া যাবে না। তখন ট্রাইব্যুনালের বিচার কাজ বন্ধ করে দেয়া যেতে পারে। আর তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন রেখে কোন লাভ নেই। ট্রাইব্যুনালের বিচারতিগণ হাইকোর্টে স্বপদে ফিরে যাবেন। তাতে আমার মনে হয় আরও দুতিন বছর লেগে যেতে পারে। সুপ্রীমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল বরাবর আইন মন্ত্রণালয়ের ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, উপযুক্ত বিষয় ও সূত্রের প্রেক্ষিতে নির্দেশিত হয়ে জানানো যাচ্ছে যে, পুরাতন হাইকোর্ট ভবনটি বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী ও ঐতিহাসিক স্থাপনা। এ ভবনটি পূর্ব বাংলা ও আসাম প্রদেশের গবর্নরের সরকারী বাসভবন হিসেবে নির্মাণ করা হয়। পরবর্তীতে এ ভবনটিকে পূর্ব পাকিস্তানের হাইকোর্টে রূপান্তর করা হয়। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সংঘটিত অপরাধসমূহ যেমন- যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা, ধর্ষণ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধসহ অন্যান্য অপরাধের সঙ্গে জাড়িতদের বিচারকার্য পরিচালনা করার জন্য বর্তমান সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এর ধারাবাহিকতায় অন্য কোথাও নিরাপদ স্থাপনা না পাওয়ার কারণে সরকার শেষ পর্যন্ত উক্ত ভবনটিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল হিসেবে ব্যবহার করছে। আইন মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে আরও বলা হয়, উল্লেখ্য ২০০৯ খ্রিঃ সালে এ ভবনের একটি অংশে আইন কমিশন ও অপর অংশে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। সে সময় উক্ত ভবনের রক্ষণাবেক্ষণ সঠিকভাবে হচ্ছিল না। তখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করার জন্য জায়গা খোঁজা হচ্ছিল এবং নিরাপত্তার দিকটি বিবেচনায় এনে এ ভবনটি সবচেয়ে নিরাপদ হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় এখানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করা হয়। ভবনটিতে ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করার পর প্রয়োজনীয় সংস্কার কাজ করা হয় এবং আইন কমিশন ও বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের অফিস ১৫, কলেজ রোড, ঢাকা ঠিকানায় স্থানান্তর করা হয়। সে সময় থেকে এখানে বিচার কাজ শুরু হয় এবং অনেক কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীর বিচার কাজ সু-সম্পন্ন হয়। সে কারণে এ ভবনটির ঐতিহ্য আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের জনগণ চায় যে এ ভবনটি ঐতিহাসিক বিধায় সে মর্যাদাকে সমুন্নত রেখে ভবনটিকে সংরক্ষণ করা হোক এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এখান থেকে সরানো না হোক। এটা সরানো হলে জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি হবে এবং দেশের সঠিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতার ক্ষেত্রে এ স্থানান্তর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। চিঠিতে আরও বলা হয়, এমতাবস্থায়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম বন্ধ করে পুরাতন হাইকোর্ট ভবনটির দখল বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের অনুকূলে হস্তান্তর করা হলে তা বর্তমান প্রেক্ষাপটে সর্বজনগ্রাহ্য হবে না বরং বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট দেশবাসীর কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হবে। ফলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল স্থানান্তর করে বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের অনুকূলে পুরাতন হাইকোর্ট ভবনের দখল হস্তান্তর করার বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করার জন্য আপনাকে নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো। উল্লেখ্য, ১৮ আগস্ট সুপ্রীমকোর্টের রেজিস্ট্রার আবু সৈয়দ দিলজার হোসেন স্বাক্ষরিত চিঠি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টে বর্তমানে পর্যাপ্ত স্থানাভাবে বিচারপতিগণের প্রয়োজনীয় চেম্বার ও এজলাসের ব্যাবস্থা করা সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া স্থান সঙ্কুলান না হওয়ার কারণে সুপ্রীমকোর্ট রেজিস্ট্র্রার অফিসের কর্মকর্তা/কর্মচারীদের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক চেম্বার দফতরের ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না। ভবিষ্যতে বিষয়টি আরও প্রকট হবে বিধায় জরুরী ভিত্তিতে বিচারপতিগনের চেম্বার ও এজলাস এবং কর্মকর্তা কর্মচারীদের অফিস হিসেবে ব্যাবহারের নিমিত্ত প্রয়োজনীয় স্থানের ব্যবস্থা করা আবশ্যক। সে লক্ষ্যে ৩১ অক্টোবরের মধ্যে সুপ্রীমকোর্টকে পুরাতন হাইকোর্ট ভবনটির (আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল হিসেবে ব্যবহৃত অংশ) দখল হস্তান্তরের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো। সরানোর প্রশ্নই উঠে না সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহম্মেদ আইন মন্ত্রণালয়ের চিঠির জবাব প্রসঙ্গে বলেছেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের স্থানটি এখন দেশ বিদেশে সবার কাছে সুপরিচিত। এটা সরানোর প্রশ্নই উঠে না। এই বিচারটা হয়েছে দীর্ঘ ৪২ বছর পরে। জাতির প্রত্যাশা প্রতিফলিত হয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের জন্য এখানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল স্থাপিত হয়েছে। বিচার শেষ হলেও যাদুঘর হিসেবে স্থানটিকে রক্ষা করা হোক। যাতে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম জানতে পারে যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় এদেশে গণহত্যা, ধর্ষণ করেছিল। তাদের বিচার এখানে হয়েছে। এটা ইতিহাসের অংশ হিসেবে থাকবে। সে জন্য এ স্থানটি সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। আর এটা সরানোর কোন প্রশ্নই থাকতে পারে না। সরালে জাতি বিভ্রান্তির মধ্যে পড়বে। এতে অনেকেই আপত্তি জানাবে। মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার কতদিন চলবে এ প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার শফিক আহম্মেদ আরও বলেন, তদন্ত সংস্থা যতদিন আসামিদের তথ্য উপাত্ত পাবে ততদিন বিচার কাজ চলবে। তদন্তের পর দেখা যাবে আর কোন আসামির বিরুদ্ধে তথ্য উপাত্ত পাওয়া যাচ্ছে না তখন বিচার বন্ধ করা যেতে পারে। তখন তদন্ত সংস্থা, প্রসিকিউশন রেখে কোন লাভ হবে না। একই সঙ্গে যারা ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি হিসেবে নিয়োজিত আছেন তারাও হাইকোর্টে স্বপদে ফিরে যাবেন। ৮ সংগঠন এর আগে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিসহ আটটি সংগঠন সুপ্রীমকোর্ট প্রশাসনের প্রতি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালটি পুরাতন হাইকোট ভবন থেকে না সরানোর অনুরোধ জানিয়েছিল। শুধু আট সংগঠন নয় এর পাশাপাশি সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমাযুন ও বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস প্রেসিডেন্ট আব্দুল বাসেত মজুমদারও হাইকোর্টের বিচারপতিদের নিরাপত্তা, প্রসিকিউটরদের নিরাপত্তার পাশাপাশি সাক্ষীদের নিরাপত্তার জন্য ট্রাইব্যুনাল না সরানোর অনুরোধ করেছিলেন। তারা বলেছিলেন, আইনজীবীদের নিরাপত্তাসহ সকল বিষয় চিন্তভাবনা করেই এখান থেকে ট্রাইব্যুনাল সরানো উচিত হবে না। এদিকে ২৭ আগস্ট ৮টি সংগঠনের পক্ষে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলেন, ট্রাইব্যুনাল সরানো যাবে না। ট্রাইব্যুনাল ওখানেই থাকবে এবং অবশিষ্ট যে সমস্ত মানবতাবিরোধী অপরাধী আছে তাদের বিচার হবে। ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করব। এ সময়ের মধ্যে ট্রাইব্যুনাল সরানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে না এলে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। সেখানে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ছাড়াও ছিলেন, বিশিষ্ট গবেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন, আপীল বিভাগের সাবেক বিচারপতি সামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, আপীল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শ্রম এ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি সামছুল হুদা, শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণী, উদীচীর সভাপতি কামাল লোহানী, প্রজন্ম ’৭১-এর তৌহিদ রেজা নুর, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাংগঠনিক সম্পাদক ওসমান গনি, মুক্তিযোদ্ধা জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক, সেক্টর কমান্ডারর্স ফোরামের সাধারণ সম্পাদক হারুন হাবিব, জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি শফিকুর রহমান, সাংস্কৃতিক জোটের হাসান আরিফ, মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়েশা খানম ও কাজী মুকুল।
×