ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সিরিজ ও ম্যাচসেরাও মিরাজ

ঐতিহাসিক বিজয় ॥ ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের মিরাজময় টেস্ট জয়

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ৩১ অক্টোবর ২০১৬

ঐতিহাসিক বিজয় ॥ ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের মিরাজময় টেস্ট জয়

মিথুন আশরাফ ॥ ‘আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে’ ইংল্যান্ডকে প্রথমবারের মতো টেস্টে হারানোর পর ক্রিকেটাররা দুই হাত মেলে যেন আকাশে উড়তে চাইলেন। আনন্দে আত্মহারা হয়ে বাতাসের সঙ্গে খেলা করতে চাইলেন। একেকজন একেকদিকে ছুটতে লাগলেন। বাঁধনহারা উল্লাস। ফিনের এলবিডব্লিউর আবেদনে আম্পায়ার যেই সাড়া দিলেন, ক্রিকেটাররা আনন্দে কী করবেন কিছুই যেন বুঝতে পারছিলেন না। ১০৮ রানে জয় মিলেছে। ঐতিহাসিক জয়। উৎসব কী আর থামার নাকি! আনন্দ একটু থামিয়ে ইংলিশ ক্রিকেটারদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করলেন বাংলাদেশ ক্রিকেটাররা। সেই পর্ব শেষ হতে দেরি। আবার মাঠে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিলেন। যেন ক্রিকেটাররা বলতেও চাইলেন, ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা মনে মনে।’ সেই আনন্দ যেন সবচেয়ে বেশি খেলা করল মাত্রই কৈশোরকে বিদায় জানানো মেহেদী হাসান মিরাজের মনে। টেস্ট জিতল বাংলাদেশ। জেতালেন তো আসলে তিনিই। দুই ইনিংস মিলিয়ে ১২ উইকেট নিলেন। ইংল্যান্ডকে যে টেস্টে হারিয়ে ঐতিহাসিক জয়টি তুলে নিল বাংলাদেশ, সেই টেস্টটি তো মিরাজময়ই হয়ে থাকল। দ্বিতীয় টেস্টটিই কী শুধু মিরাজময় হলো, সিরিজজুড়েই তো ‘মিরাজ, মিরাজ’ ধ্বনি শোনা গেল। প্রথম টেস্টে দুই ইনিংস মিলিয়ে ৭ উইকেট (৬ ও ১ উইকেট) নিলেন। দ্বিতীয় টেস্টে তো ১৯ বছর বয়সী এ তরুণ দুই ইনিংসেই নিলেন ৬ উইকেট করে। প্রথম টেস্টে ইংলিশ ব্যাটসম্যানদের ভোগালেন। কিন্তু জয় আর ধরা দিল না। ২২ রানে হারল বাংলাদেশ। সিরিজে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে গেল ইংল্যান্ড। তবে দ্বিতীয় টেস্টে ইংল্যান্ড ব্যাটসম্যানদের নাভিশ্বাসই শুধু তুললেন না, সেই সঙ্গে বাংলাদেশকে জয়ও এনে দিলেন। বাংলাদেশ প্রথম ইনিংসে ২২০ রান করল। মিরাজের ঘূর্ণির সামনে পড়ে ২৪৪ রানের বেশি প্রথম ইনিংসে করতেই পারল না ইংল্যান্ড। দ্বিতীয় ইনিংসে ইমরুল কায়েসের ৭৮ রানে ২৯৬ রান করে আড়াই দিন আগে ইংল্যান্ডের সামনে বড় টার্গেটই ছুড়ে দিল। যে টার্গেট অতিক্রম করা ইংল্যান্ডের জন্য কষ্টসাধ্য তা আগেই বোঝা গেছে। তাই বলে এতটা। তা ধারণা করা যায়নি। উপমহাদেশে কখনই ২৫০ রানের বেশি টার্গেটে জিততে পারেনি ইংল্যান্ড। এবারও তাই হলো। এবার তো ১৮০ রানও করতে পারল না। বিনা উইকেটে ১০০ রান করে ইংল্যান্ড দ্বিতীয় সেশনের বিরতিতে যায়। তৃতীয় সেশন শেষ না হতেই ইংল্যান্ডের ইনিংস খতম! তৃতীয় সেশনের প্রথম বলেই ডাকেটকে আউট করে যে উইকেট শিকার শুরু করলেন মিরাজ, দেখতে দেখতে ব্যালান্স, মঈন, কুক, বেয়ারস্টো, ফিনের উইকেট তুলে নিলেন। মাঝখানে ৪৩ ওভারের সময় সাকিবের ঘূর্ণিঝড় দেখা মিলল। ৪ বলে তিন উইকেট নিয়ে নিলেন। ৬৪ রানেই ১০ উইকেট পড়ে গেল ইংল্যান্ডের। এই জয় পেয়ে বাংলাদেশ সিরিজও ১-১ ব্যবধানে ড্র করল। ২৭৩ রানের টার্গেটে খেলতে নেমে ১৬৪ রানের বেশি করতেই পারল না ইংল্যান্ড। মিরাজ অসাধারণ বোলিং করে সিরিজ সেরার পুরস্কারটিও নিজের করে নিলেন। ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট সিরিজেই বাজিমাত করলেন মিরাজ। বাঁধন হারা আনন্দে ছোটাছুটিটা তাই তিনিই সবচেয়ে বেশি করলেন। আর যেন ইংল্যান্ডের শেষ উইকেটটি নিতেই দেশের হয়ে টেস্ট সিরিজে সবচেয়ে বেশি ১৯ উইকেট নিয়ে দুই হাত মেলে দিয়ে বলতে চাইলেন, ‘মেলে দিলাম এই ডানা মনে মনে।’ আগের দিনই বিশ্ব ক্রিকেটে প্রথম অফ স্পিনার হিসেবে টানা দুই টেস্টের প্রথম ইনিংসে ৬ উইকেট তুলে নিয়ে ইতিহাস গড়েছিলেন মিরাজ। তার ঘূর্ণিতে যেখানে ধাঁধা খাচ্ছেন ব্যাটসম্যানরাই। খেলবেন, না ছাড়বেন; এ দ্বন্দ্বে পড়ে যান। সেখানে ফিন তো একজন বোলার। সেই ধাঁধায় বল গিয়ে লাগল ফিনের পায়ে। আবেদন করছেন বোলার মিরাজ। চিৎকার করেই চলেছেন। আউট হলেই ইংল্যান্ডের ইনিংস শেষ। বাংলাদেশ ক্রিকেটাররা মুহূর্তেই দুই দিকের উইকেট প্রথমে ঘিরে ধরলেন। আউট হলেই যে ঐতিহাসিক জয়ের উইকেটটি নিজের কাছে রাখবেন। আবেদন করতেই আম্পায়ার সাড়াও দিলেন। কিন্তু উইকেট তুলতে পারছেন না কেউই। ফিন আম্পায়ারকে যে কী যেন বলতে চাইলেন। ‘রিভিউ’ নেয়ার অপেক্ষা। কিন্তু সেই সুযোগ যে নেই। ইংল্যান্ড পক্ষের দুটি ‘রিভিউ’ই শেষ। যেই এটা বুঝতে পারলেন বাংলাদেশ ক্রিকেটাররা, সঙ্গে সঙ্গে উইকেট উপড়ে ফেলতে লাগলেন। যে যেভাবে পারলেন উইকেট নিজের কবজায় করলেন। আনন্দে ছোটাছুটি করতে লাগলেন। সেই আনন্দ শুধু ক্রিকেটাররাই করলেন না, পুরো জাতিই তাতে শামিল হলো। মিরাজকে তো সবাই কোলে তুলে নেয়ারও চেষ্টা করলেন। তবে এখন যে কতটা প্রতাপশালী দল বাংলাদেশ সেই প্রমাণ মিলল একটু পরেই। ক্রিকেটাররা কতটা পরিপক্ব হয়ে উঠেছেন তা বুঝিয়ে দিলেন বিশ্বকে। জয়ের আনন্দ খানিক করার পর ইংল্যান্ড ক্রিকেটারদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন ক্রিকেটাররা। সেই পর্ব শেষ হতেই আবার আনন্দ করতে করতে দৌড়ে উইকেটের কাছে আসেন। খুব অল্প সময় সেই আনন্দ স্থায়ী হয়। মুহূর্তেই সবাই উইকেটের সামনে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনায় ব্যস্ত হন। বোঝাই যায়, যা আনন্দ করা হয়েছে, এতটুকুই। জয়োৎসবে আবার হারিয়ে যেন না যান, সেই চেষ্টাই করা হয়। তা হলোও। একটু পরেই সবাই আনন্দ করা থামিয়ে দিলেন। ওয়ানডেতে এখন যে দলের বিপক্ষেই জিতুক বাংলাদেশ, উৎসব আর আগের মতো হয় না। বাঁধনহারা উৎসব মেলে না। তাই বলে ঐতিহাসিক টেস্ট জয়ের পর পতাকা নিয়ে স্টেডিয়াম ঘোরার সেই দৃশ্য মিলবে না! যখন আবার ইংল্যান্ডের মতো শক্তিশালী দলকে প্রথমবারের মতো হারানো গেছে। সেই জয়টিও এসেছে দাপটের সঙ্গেই। যে দলের বিপক্ষে এর আগে চার সিরিজেই নাস্তানাবুদ হতে হয়েছে, তাদের এবার দুই টেস্টেই হারিয়ে দেয়ার মতো অবস্থা তৈরি করে বাংলাদেশ। জয় শেষ পর্যন্ত একটি টেস্টে মেলেও। আনন্দ স্থায়ী হবে না তাতে! কিন্তু টেস্টেও যেন বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটাররা আনন্দ উদ্যাপনে একটু ধীর গতিতে চলতে চান। আর তাই তো শুরুতে, ‘আজকে মোদের বড়ই সুখের দিন’ তালে মাতোয়ারা হয়ে যাওয়া হয়েছে। পরে সেই মাতলামি আরও বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই থেমেও গেছে। ২০০০ সালে বাংলাদেশ প্রথম টেস্ট খেলে। সেই থেকে প্রায় ১৬ বছর কাটিয়ে দেয়। কিন্তু কখনই জিম্বাবুইয়ে ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো দুর্বল দল ছাড়া অন্যদের হারাতে পারেনি। শুধু হারই হয়েছে নিয়তি। শেষ পর্যন্ত সেই গোলকধাঁধা থেকে বের হয়েছে বাংলাদেশ। ইংল্যান্ড দেখল ‘ওয়ানডে স্টাইলে’ খেলে কিভাবে বাংলাদেশ জয়ের বন্দরে পৌঁছে গেল। ইংলিশ ব্যাটসম্যানরা মিরাজ, সাকিবদের মতো স্পিনারদের ঘূর্ণিতে তালগোল পাকিয়ে ছন্নছাড়া হয়ে পড়ল। আর তাতে, ‘আমরা করব জয়, আমরা করব জয়’ সুর বাজতে বাজতে জয় ধরাই দিয়ে ফেলেছে। সেই জয়টির নায়ক একজনই। তিনি মিরাজ। পার্শ্ব নায়ক হিসেবে বোলিংয়ে সাকিব, তাইজুল ও ব্যাটিংয়ে ম্যাচের একমাত্র সেঞ্চুরিয়ান তামিম, মুমিনুল, ইমরুল আছেন। তবে আসল আতঙ্ক তো ছড়িয়েছেন মিরাজই। প্রথম ইনিংসে তামিম ও মুমিনুল বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। তামিম ১০৪ রান করেছেন। মুমিনুলের ব্যাট থেকে আসে ৬৬ রান। তামিম ও মুমিনুল মিলে যে ১৭০ রানের জুটি গড়েন, তাতে প্রথম ইনিংসটা খানিক মোটাতাজা হয়। এরপর ইংলিশরা ব্যাটিংয়ে নেমে মিরাজকে তো ৬ উইকেট দেয়ই, তাইজুলকে ৩টি ও সাকিবকে ১টি উইকেট দিয়ে ২৪ রানে এগিয়ে যেতে পারে। দ্বিতীয় ইনিংসে ইমরুল ৭৮ রান করেন। বাকিদের মধ্যে তামিম ৪০, মাহমুদুল্লাহ ৪৭ ও সাকিব ৪১ রান করেন। তবে ইমরুল ২০০ রানে আউট হওয়ার পর ৯৬ রানেই যে আরও ৬ উইকেটের পতন ঘটে যায়, সেটি দলের বিপর্যয়ের কারণ হতে পারত। যদি ইংল্যান্ড এমনভাবে ধসে না যেত। সেই ধসে যাওয়ার মূল কারিগর একজনই। যিনি ম্যাচ সেরাও, আবার সিরিজ সেরাও, মিরাজ। তৃতীয় সেশন শুরুর আগ পর্যন্ত তো বোঝাই যায়নি, ম্যাচটি বাংলাদেশ তৃতীয় দিনেই জিতে যাবে। উল্টো কুক ও ডাকেটের ব্যাটিং দেখে শঙ্কা জাগছিল, বাংলাদেশ না আবার হেরে যায়! যেই তৃতীয় সেশনের শুরুর প্রথম বলেই ডাকেটকে আউট করে দেন মিরাজ, শুরু হয়ে যায় ইংলিশ ব্যাটিংয়ের ছন্দপতন। ডাকেটের পর রুট আউট হন। উইকেটটি নেন সাকিব। কিন্তু এরপর ইংল্যান্ড ইনিংসের মাজা ভেঙ্গে দেয়ার কাজটি মিরাজই করেন। ব্যালান্স, মঈন, কুক, বেয়ারস্টোÑ টানা চারটি উইকেট তুলে নেন। বিশেষ করে কুকের উইকেটটি তুলে নিতেই আনন্দ শুরু হয়ে যায়। জয়ের আলামত মিলে যায়। সেই কাজটি তো মিরাজই করেন। ইংল্যান্ডকে হারিয়ে দেয়া যাবে। এ বিশ্বাস থাকলেও, জোর দিয়ে কেউই বলতে পারছিল না। এখন তো হারিয়েই দিয়েছে। ওয়ানডেতে ঠিক যেমন বড় দলগুলোর মধ্যে একটি, দুটি দলকে হারিয়ে এখন সোনালি দিনে পৌঁছে গেছে বাংলাদেশ। ঠিক তেমনি টেস্টেও যেন সেই সুরই বাজছে! আর সেই সুরের ধ্বনি মিরাজই কি বাজিয়ে দিলেন না? ঐতিহাসিক টেস্ট জয়টি তাই মিরাজময়ই হয়ে থাকল।
×