ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আল-আমিন ইমরান

আবাস যখন প্রজাপতির ডানায়

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ৩০ অক্টোবর ২০১৬

আবাস যখন প্রজাপতির ডানায়

ভোর বেলার আরামের ঘুমটা অবশেষে ভেঙ্গেই গেল। আরেকটু ঘুমানোর ইচ্ছেটাকে কবর দিয়ে তাই শেষমেশ উঠে পড়লাম বিছানা থেকে। দখিনের জানালাটা খোলাই ছিল। সারারাতের ভ্যাপসা গরমের পর সকালবেলার ঠা-া পরিবেশে ঘুমটা বেশ জেঁকে বসেছিল। কিন্তু তা আর হলো কই? বেরসিক পাখি দুটো যে ঘুমোতেই দিল না। আজ কোন কারণে মনে হয় ওদের মধ্যে আবারও ঝগড়া লেগেছে। কি জানি বাপু! পাখির সংসারে আবার ঝগড়া-ঝাটি কিসের? ওরা তো আর মানুষ নয় যে নিত্যদিন কোন না কোন বিষয় নিয়ে ঝগড়া-ঝাটিতে মেতে থাকবে! জানালার ওপাশটাতে আজ বেশ কিছুদিন ধরে দুটো শালিক বাসা বেঁধেছে। লাল ইটের গাঁথুনির ফাঁকা জায়গাটায় ওদের ছোট্ট সংসার। তাই ভাবলাম দেখি সকাল-সকাল ব্যাটারা আবার কি ঝামেলা পাকিয়েছে। জানালার এ পাশে দাঁড়িয়ে দেখি ওদের চেঁচামেচির কারণটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। জানালা ঘেঁষে লাল ইটের দেয়াল ছুঁয়ে যে জাম গাছটি চার তলার ছাদ স্পর্শ করেছে, সেখানে একটি লক্ষ্মীপেঁচা বার বার ঘাড় ওপর-নিচ করে পাখি দুটোকে বিরক্ত করছিল। আর তাকে তাড়াতেই পাখি দুটোর এত চিৎকার চেঁচামেচি! প্রায় প্রতিদিনই এমন কিছু মিষ্টি অনুভূতি নিয়ে দিন শুরু হয় প্রজাপতি ডানার বাসিন্দাদের! শুনতে অবাক লাগছে নিশ্চয়? প্রজাপতির ডানায় আবার মানুষ বসবাস করে নাকি! করতেই পারে। তবে তা যদি হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যায়ের মীর মশাররফ হোসেন হল, তাহলে সেখানে অবাক হবার কিছুই নেই। এখানে বসবাসকারী সকল ছাত্রই প্রজাপতির ডানার বাসিন্দা। কেননা এর নান্দনিক আকৃতি হুবহু প্রজাপতির মতো। হলটিকে পাখির চোখে দেখলে মনে হবে যেন গাঢ় সবুজের গালিচায় বিশাল ডানা ছড়িয়ে বসে আছে টুকটুকে লাল রঙের এক প্রজাপতি। ছুঁয়ে দিলেই হয়ত উড়ে পালাবে দূরে কোথাও। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য নান্দনিকতারও কোন ঘাটতি নেই। আর এই অপূর্ব স্থাপত্যশৈলীর উৎকৃষ্ট একটি উদাহরণ হতে পারে মীর মশাররফ হোসেন হল। ঘন-সবুজ অরণ্যবেষ্টিত হলটিকে জাবির এমনকি অনায়াসেই পুরো বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর আবাসিক হলও বলা যেতে পারে। একেবারে ভিন্ন আঙ্গিকে প্রজাপতির নক্সায় তৈরিকৃত এই হলটির স্থপতি ছিলেন প্রখ্যাত স্থপতি মাজহারুল ইসলাম। হলটির নির্মাণ কাজ ১৯৭৩ সালে শেষ হলেও ১৯৭৮ সালের ১৪ এপ্রিল তৎকালীন সিন্ডিকেট কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলা সাহিত্যের অমর কথাশিল্পী মীর মশাররফ হোসেনের নামে হলটির নামকরণ করা হয়। এই হলের বাসিন্দাদের কাছে যার ভালবাসার আরেক নাম ‘প্রজাপতি হল’। জাবির অন্যান্য স্থাপনাগুলো থেকে একেবারে আলাদা অবস্থান এবং এর চারপাশের সবুজ প্রাকৃতিক পরিবেশ এটিকে সম্পূর্ণ ভিন্ন বৈশিষ্ট্য দান করেছে। পাশাপাশি সৃষ্টি করেছে এক অনন্য প্রাকৃতিক আবহের। যা কিনা যে কোন ভাবুক হৃদয়ে কাঁপন তুলতে খুব বেশি সময় নেয় না। নিয়ে যায় প্রকৃতির একদম কাছাকাছি। আর এর অপূর্ব স্থাপত্য নান্দনিকতা মুহূর্তেই মনকে ভরিয়ে তোলে। হলটির সৌন্দর্য কত যে দর্শনার্থীকে আকুল করে তোলে আর হৃদয়ে তোলে আফসোসের ঝড়, তার কোন ইয়াত্তা নেই। অবচেতন মনে বার বার বেজে ওঠে আফসোসের সুর ‘ইস! যদি আমিও হতাম এই হলের বাসিন্দা তবে কতই না ভাল হতো।’ তাহলে ভাবুনতো হলটিতে যারা নিয়মিত থাকেন তাদের অনুভূতি কেমন হতে পারে? তেমনটিই জানাচ্ছিলেন হলটির আবাসিক শিক্ষার্থী লোক-প্রশাসন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র জামিনুর জুয়েল। ‘জাবির অপরূপ স্বর্গভূমিতে এসে প্রথমেই এই প্রজাপতি হলের প্রেমে পড়েছিলাম, আর যখন জানতে পারলাম আমার হল এলট এখানেই তখন যেন হাতে পূর্ণিমার চাঁদ পাবার মতো অনুভূতি হয়েছিল। সে এক অদ্ভুত অনুভূতি, যাকে বর্ণনা করা এক কথায় অসম্ভব।’ সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রাসেল মিয়া খানিকটা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলেন, ‘জাবির অন্য হলগুলো থেকে একেবারেই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যম-িত এই হলটি। এর নিরিবিলি প্রাকৃতিক পরিবেশ মুহূর্তেই মন ভাল করে দেয়। হলটিকে ঘিরে থাকা প্রাকৃতিক পরিবেশে বসবাস করে নানা প্রজাতির পাখি, প্রজাপতি, কাঠবিড়ালি, গুইসাপ, বেজি, শিয়াল প্রভৃতি। যা কিনা প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি মানুষ আর প্রাণিকুলের মধ্যে সহাবস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। আর এর অতুলনীয় নান্দনিক সৌন্দর্যের কথা নাইবা বললাম।’ এখানে লাল ইটের দেয়ালে সকালের সূর্যের রক্তিম আভা যেন মিশে গাঢ় লাল বর্ণ ধারণ করে। দুপুরের রোদ হয়ে যায় পানসে। গোধূলি লগ্নে হয়ে ওঠে আরও বেশি মায়াময়। কখনও বৃষ্টির ঝাপটা এসে আরও বেশি রঙিন করে তোলে বিবর্তনে মলিন হওয়া ইটগুলোকে। শুভ্র মেঘের দল প্রজাপতির লাল ডানা ছুঁয়ে দেবার দুঃসাহস দেখায় কখনও কখনও। আসে হেমন্ত, শীত, বসন্ত। সময়ের ভেলায় চড়ে যেন প্রতিনিয়তই প্রজাপতি হলের রূপ পরিবর্তিত হচ্ছে। সময়ের সেই একই ভেলায় চড়ে কোন একসময় প্রজাপতি ডানার বাসিন্দারাও হয়ে ওঠে প্রাক্তন। বয়ে চলে সময়, পেছনে পড়ে থাকে অজস্র স্মৃতি আর প্রিয় প্রজাপতি হল।
×