ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

তরুণ স্পিনার মিরাজের ইতিহাস

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ৩০ অক্টোবর ২০১৬

তরুণ স্পিনার মিরাজের ইতিহাস

স্পোর্টস রিপোর্টার ॥ আগের টেস্টেই আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরু করেছেন। চট্টগ্রামে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে অভিষেকটাকে অন্যরকম রঙ্গে রাঙ্গিয়ে যাত্রাটা শুভ হয়েছে মেহেদি হাসান মিরাজের। এক ইনিংসে ৮০ রানে ৬ উইকেট নিয়ে দেশের পক্ষে বয়স বিবেচনায় সেরা অভিষেক নৈপুণ্য প্রদর্শন করেছেন। এমন বর্ণিল অভিষেক টেস্ট ক্রিকেটের প্রায় ১৩৯ বছরের ইতিহাসে অনেকের থাকলেও ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় টেস্টে হয়ে গেছেন বিবর্ণ। কিন্তু তরুণ মিরাজ ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় টেস্টে নেমেও সেটা ধরে রাখলেন। কম রানে গুটিয়ে যাওয়া দলের ত্রাণকর্তা হয়ে আবার নিলেন ৬ উইকেট। এবার ৮২ রান দিয়ে। বাংলাদেশের পক্ষে অভিষেক টেস্টে এখন পর্যন্ত ৭ বোলার ৫ উইকেট বা তার বেশি নিতে পারলেও আর কেউ নিজের দ্বিতীয় টেস্টে এমনটা করতে পারেননি। এমনকি বিশ্ব ক্রিকেট ইতিহাসে অভিষেকে এমন অনেক ঘটনা থাকলেও ক্যারিয়ারের প্রথম দুই টেস্টে ৫ উইকেট শিকার করার ঘটনা স্পিনারদের মধ্যে এটি সবেমাত্র তৃতীয়। আর অফস্পিনার হিসেবে নতুন ইতিহাস গড়েছেন তরুণ মিরাজ। তিনিই বিশ্বের প্রথম অফস্পিনার যিনি ক্যারিয়ারের প্রথম দুই টেস্টেই ৫ উইকেট বা তার বেশি শিকার করলেন। উজ্জ্বল অভিষেকের পর নিজের দ্বিতীয় ম্যাচেও উদ্ভাসিত থাকার বিরল কৃতিত্ব দেখালেন খুলনার এ ডানহাতি অফস্পিনার। বাংলাদেশ দলের অন্যতম ভরসা ও আস্থার নাম স্পিন। এই স্পিনারদের নিয়েই প্রতিপক্ষকে অনেকবার দেশের মাটিতে নাকানি-চুবানি খাইয়েছে বাংলাদেশ দল। তবে এবার ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে নির্ভরযোগ্য বাঁহাতি স্পিনার সাকিব আল হাসানের সঙ্গে আরেক নির্ভরতার নাম ছিলেন স্পেশালিস্ট স্পিনার তাইজুল ইসলাম। তবে সবাইকে ছাপিয়ে নিজেকে অন্য রকমভাবে বিশ্ব ক্রিকেটে আবির্ভূত করলেন মিরাজ। মাত্র ১৮ বছর ৩৬১ দিন বয়সে অভিষেক টেস্টের প্রথম ইনিংসে ৮০ রানে ৬ উইকেট শিকার করলেন যা দেশের পক্ষে রেকর্ড এবং বিশ্বরেকর্ডের দিক থেকে তৃতীয় সেরা। আর স্পিনারদের মধ্যে থেকে সেটি ছিল বয়স বিবেচনায় শহীদ আফ্রিদির (১৮ বছর ২৩৫ দিন) পরেই বিশ্বরেকর্ডের তালিকায় অবস্থান। কিন্তু চট্টগ্রাম টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে নিজেকে সেভাবে মেলে ধরতে পারেননি মিরাজ। মাত্র ১ উইকেট নিয়েছিলেন। তবে বল হাতে আবার জ্বলে উঠলেন মিরপুর শেরেবাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামে শুক্রবার শুরু হওয়া সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে। বাংলাদেশ মাত্র ২২০ রানে গুটিয়ে যাওয়ার পর প্রথমদিনের শেষ ভাগে বল হাতে দুরন্ত হয়ে ওঠা মিরাজ নিজ দলের অবস্থানকে খুব বেশি বাজে হতে দেননি। দুই উইকেট নিয়েছিলেন ৬.২ ওভারে ২৬ রান দিয়ে। ইংল্যান্ড ব্যাট করতে নামার পর প্রথম ওভারেই বল হাতে নিয়েছিলেন উইকেট। পরে তিনি এ্যালিস্টার কুক ও গ্যারি ব্যালান্সকে সাজঘরে ফেরান। প্রথমদিন দ্রুত ৫০ রান করলেও তিন উইকেট হারিয়ে তেমন স্বস্তি পায়নি ইংল্যান্ড। সেই অস্বস্তিটা আরও দুঃশ্চিন্তাময় করেছেন মিরাজ শনিবার. দ্বিতীয়দিনের শুরুতেই। মঈন আলীকে বোল্ড করে দেন। পরে জিমি বেয়ারস্টোকেও এলবিডব্লিউ’র ফাঁদে ফেলে বাংলাদেশকে নিয়ন্ত্রণ এনে দেন। অভিষিক্ত জাফর আনসারিকে সাজঘরে পাঠিয়ে আবার ইনিংসে ৫ উইকেট নেয়ার কৃতিত্ব দেখান। ক্যারিয়ারের শুরুতে ৫ উইকেট এবং পরের ম্যাচেও ৫ উইকেট শিকারের বিরল এক নজির গড়ে ফেলেন সঙ্গে সঙ্গে। অবশ্য শেষ করেছেন ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠা ক্রিস ওকসকেও শিকার করে। সবমিলিয়ে ২৮ ওভারে ৮২ রানে ৬ উইকেট। এখন পর্যন্ত টেস্ট ইতিহাসে ১৫৫ বোলার অভিষেকেই ৫ উইকেট শিকারের নজির দেখিয়েছেন। এর মধ্যে স্পিনারের সংখ্যা ৪৪ জন, বাংলাদেশীই ৭ জন! তারা কেউ ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় টেস্টে ৫ উইকেট নিতে পারেননি। বাংলাদেশের বাকি ৬ জন তো ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় টেস্টে সেরা বোলিং ৩ উইকেট শিকার (মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ- ৩/৪৪)। তবে অভিষেক টেস্টে ৬ উইকেট নেয়ার সংখ্যাটা অনেক কমÑ মাত্র ৫৯ জন। এরচেয়েও কম ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ম্যাচেও ৫ উইকেট বা তারচেয়ে বেশি শিকার তুলে নেয়ার ঘটনা। কারণ অভিষেকে দারুণ উজ্জ্বলতা ছড়ালেও পরে অধিকাংশই হারিয়ে গেছেন। এমনটা বিশ্ব ক্রিকেটের ইতিহাসে আর মাত্র দুই স্পিনারই করে দেখাতে পেরেছেন। প্রথম নজিরটা দেখিয়েছিলেন ১৯২৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার লেগব্রেক গুগলি বোলার ক্ল্যারেন্স গ্রিমেট। সে বছর ফেব্রুয়ারিতে সিডনি টেস্টে অভিষেকেই চমক দেখিয়ে দুই ইনিংসে ৪৫ রানে ৫ এবং ৩৭ রানে ৬ উইকেট নিয়ে ধসিয়ে দিয়েছিলেন চিরশত্রু ইংল্যান্ডের ইনিংস। তাদের বিরুদ্ধেই লিডসে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় টেস্ট খেলতে নেমে প্রথম ইনিংসে ৮৮ রানে ৫ এবং দ্বিতীয় ইনিংসে ৫৯ রানে ২ উইকেট শিকার করেন। ৫৮ বছর লেগেছিল কোন স্পিনারের এই অসামান্য বিরল নৈপুণ্য ছোঁয়ার জন্য। ১৯৮৩ সালের আগস্টে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে বাঁহাতি অর্থোডক্স নিকোলাস গ্র্যান্ট কুক লর্ডসে অভিষেক টেস্টে ৩৫ রানে ৫ ও ৯০ রানে ৩ উইকেট নেয়ার পর ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় টেস্টে নিয়েছিলেন ৬৩ রানে ৫ এবং ৮৭ রানে ৪ উইকেট। এ দুটিই শেষ সেরা নৈপুণ্য কোন স্পিনারের অভিষেক ও ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ম্যাচে। ৩৩ বছর পর তাদের ছুঁয়ে ফেললেন মিরাজ! আরেকটু গভীরে গেলে আসলে নতুন এক ইতিহাসই রচনা করলেন টেস্ট ক্রিকেটে। টেস্ট ইতিহাসে ৩২ জন ডানহাতি স্পিনার অভিষেকে ৫ উইকেট নিতে পারলেও ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ম্যাচে সেটা পারেননি তারা। মিরাজ বিশ্বের প্রথম ডানহাতি স্পিনার হিসেবে সেই নজির গড়লেন। আর কোন অফস্পিনার এই কৃতিত্ব দেখাতে পারেননি। অফস্পিনারদের বিশ্বরেকর্ড গড়ে ফেললেন তাই মিরাজ। বাংলাদেশের কোন বোলার অভিষেক যেমনই হোক ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ম্যাচে আর সেই একই উজ্জ্বলতা ধরে রাখতে পারেননি। দেশসেরা এবং অফস্পিনার হিসেবে বিশ্বসেরা নৈপুণ্য দেখালেন তরুণ মিরাজ।
×