ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

টেংরাটিলা ক্ষতিপূরণ মামলা

বিরোধ নিষ্পত্তির অনুরোধ জানিয়ে নাইকো চেয়ারম্যানের চিঠি

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ৩০ অক্টোবর ২০১৬

বিরোধ নিষ্পত্তির অনুরোধ জানিয়ে নাইকো চেয়ারম্যানের চিঠি

রশিদ মামুন ॥ আলোচনার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির অনুরোধ জানিয়ে সরকারকে চিঠি দিয়েছে কানাডিয়ান বহুজাতিক কোম্পানি নাইকো রিসোর্স লিমিটেড। আইনমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা এবং বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে নাইকোর পক্ষে অনুরোধের কথা জানিয়েছেন কোম্পানিটির বোর্ড চেয়ারম্যান। ওই চিঠিতে বলা হচ্ছে, নাইকো এবং বাংলাদেশ কোন পক্ষের জন্যই এ ধরনের বিরোধ জিইয়ে রাখা শুভ ফল বয়ে আনবে না। নাইকো বোর্ডের চেয়ারম্যান ক্রিস এইচ রুডের লেখা চিঠিটি গত বুধবার বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ে পৌঁছালে ওই দিনই বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য জ্বালানি সচিবকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। নাইকো বাংলাদেশের আদালত এবং ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর সেটেলমেন্ট অব ইনভেস্টমেন্ট ডিসপিউটে (ইকসিড) বিচারাধীন সকল বিষয়ের নিষ্পত্তি চায়। প্রসঙ্গত, এর আগেও নাইকোর সঙ্গে এক দফা অনানুষ্ঠানিকভাবে লন্ডনে জ্বালানি বিভাগের তরফ থেকে সমস্যা সমাধানের জন্য আলোচনায় বসা হয়। তখন নাইকো বিষয়টিকে পাত্তা দেয়নি। কোম্পানিটি আন্তর্জাতিক সালিশী আদালতের (ইকসিড) রায় তাদের পক্ষে যাবে বলে মনে করেছিল। তবে গত ২৫ মার্চ ইকসিডে দুর্নীতির মাধ্যমে নাইকো খনি ইজারা দেয়ার অভিযোগ করে বাপেক্স। এতে নয় হাজার ২৫০ কোটি টাকা বা ১১৭ কোটি মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণ দাবি করে টেংরাটিলা ক্ষেত্রের জন্য। ওই অভিযোগের ভিত্তিতে ২৬ মে এ সংক্রান্ত আরও তথ্য চেয়ে একটি আদেশ দেয় ইকসিড। সরকার এ তথ্য ইকসিডের কাছে পাঠিয়েছে। এছাড়া ইকসিডের প্রতিনিধিরা অভিযোগের পর টেংরাটিলা পরিদর্শন করেছেন। এর পরেই চিত্র বদলাতে শুরু করে। এখন এসে নাইকো সুর নরম করে আলোচনায় বসার আগ্রহ দেখাচ্ছে। গত বুধবার বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য জ্বালানি সচিব নাজিম উদ্দিন চৌধুরীকে নির্দেশ দেন। চিঠিতে রুড বলেছেন, নাইকো এবং বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে কিছু বিরোধ তৈরি হচ্ছে। এখানে বাংলাদেশ সরকার ও নাইকোর মতদ্বৈততা তৈরি হয়েছে। নাইকো বোর্ড ও বিনিয়োগকারীদের সবাই মনে করে, এ বিরোধ বাংলাদেশ সরকার অথবা নাইকো কারও জন্যেই ভাল হবে না। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বীরবিক্রম এবং বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে অথবা তাদের নির্ধারিত প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক করার জন্য চিঠিতে সময় চাওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়, আমরা আশা করি আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত এ সমস্যার সমাধান করা যাবে। নাইকো বোর্ডের চেয়ারম্যান গত জুলাইয়ে নাইকো বোর্ডের পরিবর্তনের কথা তুলে ধরে বলছেন, আগের ব্যবস্থাপনা কমিটির সঙ্গে বর্তমান ব্যবস্থাপনা কমিটির পার্থক্য রয়েছে। চিঠিতে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে নাইকোর গ্লোবাল কনসোর্টিয়াম গঠনের কথা উল্লেখ করেছেন, যারা নাইকোতে বিনিয়োগ করছেন। চিঠিতে আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত কিছু প্রতিষ্ঠানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। জানা যায়, নাইকো দরপত্র ছাড়াই ছাতক গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়নের জন্য একটি প্রস্তাব দেয় ১৯৯৮ সালে। সরকার ওই প্রস্তাব যাচাই-বাছাই করে তিনটি নির্দেশনা দেয়। এর মধ্যে বাপেক্স ও নাইকো যৌথভাবে কোম্পানি গঠনের মাধ্যমে গ্যাসক্ষেত্র সমীক্ষা করে প্রান্তিক গ্যাসক্ষেত্র নির্ধারণ করবে। নাইকো এর ভিত্তিতে যে প্রস্তাব দেবে তার ওপর উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করা হবে। ওই দরপত্রে নাইকোর থেকে কেউ আকর্ষণীয় প্রস্তাব দিলে তারাই গ্যাসক্ষেত্রটি পাবে। কিন্তু যৌথ কোম্পানি গঠনের সময়ই বাপেক্স মতামতে জানায়, ছাতককে প্রান্তিক গ্যাসক্ষেত্র হিসেবে ঘোষণা করা যাবে না। কারণ সেখানে কোন গ্যাসই তোলা হয়নি। এ মতামত উপেক্ষা করে ২০০৩ সালের ১৬ অক্টোবর নাইকো ও বাপেক্স যৌথ মূলধনী কোম্পাানি গঠন করে। ওই বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমদের আইনী পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ‘মওদুদ আহমেদ এ্যান্ড এ্যাসোসিয়েট’ ছাতককে প্রান্তিক গ্যাসক্ষেত্র হিসেবে ঘোষণা করা যায় বলে অভিমত দেয়। পরবর্তীতে নাইকো ২০০৫ সালে ছাতকে কূপ খনন করতে গিয়ে দুই দফা বিস্ফোরণ ঘটায়। দেশের গ্যাসক্ষেত্র কেলেঙ্কারির মধ্যে নাইকো কেলেঙ্কারি অন্যতম। গ্যাসক্ষেত্রটির প্রায় সব গ্যাস পুড়ে যাওয়ার পাশাপাশি আশপাশের সম্পদের বিপুল ক্ষতি হয়। সরকার এ ক্ষতিপূরণ আদায়ের চেষ্টা করলে নাইকো আন্তর্জাতিক আদালতে যায়। ওই সরকারের জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী একেএম মোশাররফ হোসেনকে নাইকো সংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। কানাডিয়ান পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে ওই সময় মোশাররফ হোসেনকে এক লাখ ৯০ হাজার কানাডিয়ান ডলার দামের একটি গাড়ি ও বিদেশে সফরের জন্য নগদ পাঁচ হাজার ডলার ঘুষ দিয়েছে নাইকো। জানা গেছে, ২০০৬ সালে রয়েল কানাডিয়ান পুলিশ ওই অভিযোগের তদন্ত শুরু করে। ওই তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নাইকো ছাতক গ্যাসক্ষেত্রের কাজ পাওয়ার জন্য একজন লবিস্টকে ১০ লাখ ডলার ঘুষ দিতে সম্মত হয়েছিল। ওই সময়ে কিছু অর্থের লেনদেন হয়েছিল বলে কানাডিয়ান পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনে বেরিয়ে আসে, যা নিজের দেশে আরও ঝুঁকির মুখে ফেলে নাইকোকে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় খালেদা জিয়া গ্রেফতার হওয়ার পর ২০০৭ সালের ৯ ডিসেম্বর তার বিরুদ্ধে তেজগাঁও থানায় মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), যা আলোচিত নাইকো মামলা নামে পরিচিত। পরের বছরের ৫ মে বিএনপি চেয়ারপার্সনসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে দেয়া অভিযোগপত্রে বলা হয়, ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনটি গ্যাসক্ষেত্র পরিত্যক্ত দেখিয়ে কানাডীয় কোম্পানি নাইকোর হাতে ‘তুলে দেয়ার’ মাধ্যমে আসামিরা রাষ্ট্রের প্রায় ১৩ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকার ক্ষতি করেছেন। এছাড়া নিম্ন আদালতে বাপেক্সের নাইকো সংক্রান্ত একটি মামলা রয়েছে। এছাড়াও নাইকো নিয়ে পৃথক রিট রয়েছে হাইকোর্টে। অন্যদিকে নাইকোর দায়ের করা অভিযোগে গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর ইকসিড নাইকোর ফেনী গ্যাসক্ষেত্রের গ্যাসের মূল্য পরিশোধ বাবদ ২১৬ কোটি টাকা (২৭ মিলিয়ন বা ২৭০ কোটি ডলার) দেয়ার নির্দেশ দেয়। এ অর্থ ২০০৪ সালের নবেম্বর থেকে ২০১০ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সরবরাহ করা গ্যাসের দাম। এর সঙ্গে ২০০৭ সালের ১৪ মের পরবর্তী সময়ের জন্য নির্ধারিত হারে সুদ পরিশোধ করার নির্দেশ দেয় ইকসিড। তবে দেশের আদালতে চলমান মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় সরকার ওই অর্থ পরিশোধ করেনি। একই সঙ্গে গত জুলাই থেকে নাইকোর বাঙ্গুরা গ্যাসক্ষেত্রের বিল দেয়া বন্ধ রাখা হয়েছে।
×