ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শিল্পাচার্যের নামে নতুন কক্ষ জাদুঘরে

ত্রুটিপূর্ণ উপস্থাপনা, তবু অমর সৃষ্টির আলোয় উদ্ভাসিত গ্যালারি

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ৩০ অক্টোবর ২০১৬

ত্রুটিপূর্ণ উপস্থাপনা, তবু অমর সৃষ্টির আলোয় উদ্ভাসিত গ্যালারি

মোরসালিন মিজান ॥ জয়নুল আবেদিনের ছবি বহুকাল ধরেই প্রদর্শিত হচ্ছে জাতীয় জাদুঘরে। তবে এখন বিশেষ আয়োজন। স্বতন্ত্র গ্যালারি। মহান শিল্পীর নব উপস্থাপনা। বলার অপেক্ষা রাখে না, এমন একটি উদ্যোগের খুব প্রয়োজন ছিল। সময়ের দাবি কর্তৃপক্ষ ধরতে পেরেছে। বাস্তবায়ন করেছে উদ্যোগ। ৩৫ নম্বর গ্যালারিটি এখন ‘শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন গ্যালারি।’ কিংদন্তি শিল্পীর আঁকা ছবি দিয়ে সাজানো গ্যালারির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হলো শনিবার। জয়নুল আবেদিনের বিপুল চিত্রসম্ভার বহু বছর ধরেই জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। মোট ছবি সংখ্যা ৮০৭। গ্যালারিতে প্রদর্শিত হতো ৪১টি। কিন্তু পৃথিবী বিখ্যাত শিল্পীর ছবির জন্য আলাদা কোন গ্যালারি ছিল না। অভাবটি পূরণ হলো শনিবার। এদিন বিকেলে গ্যালারির উদ্বোধন করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। এ সময় উপস্থিত ছিলেন জাদুঘরের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান বরেণ্য শিল্পী হাশেম খান, জাদুঘরের মহাপরিচালক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী প্রমুখ। গ্যালারির কিউরেটিংয়ের কাজ করেছে দৃক গ্যালারি। মূল দায়িত্বে ছিলেন রেজাউর রহমান। জয়নুল আবেদিন তাঁর চিন্তায় কাজে আধুনিক ছিলেনÑ এই যুক্তিতে গ্যালারিকে আধুনিক এবং অভিজাত একটি চেহারা দেয়ার ওপর জোর দিয়েছেন তিনি। দেয়ালের রং বদলে অন্ধকার করেছেন। ছবির ফ্রেমও আগের মতো নেই। ডার্ক করা হয়েছে। কমানো হয়েছে গ্যালারির আলো। এভাবে নব সাজে সজ্জিত কক্ষে চার ভাগে ভাগ করে উপস্থাপন করা হয়েছে জয়নুল আবেদিনকে। পূর্বে প্রদর্শিত শিল্পকর্মগুলো যথারীতি রাখা হয়েছে। নতুন যোগ হয়েছে আরও চারটি। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সংযোজন জয়নুল আবেদিনের বিখ্যাত চিত্রকর্ম ‘মনপুরা’। ৩০ ফুট দৈর্ঘ্যরে ছবি। উপকূলীয় অঞ্চলের ঝড় জলোচ্ছ্বাস নিজ চোখ দেখে এসে এই স্ক্রল চিত্র অঙ্কন করেছিলেন শিল্পাচার্য। এর পর থেকে অনন্য এই শিল্পকর্ম জাদুঘরে সংরক্ষিত হচ্ছিল। একাধিকবার অস্থায়ী প্রদর্শনী হলেও, এবারই প্রথম স্থায়ী প্রদর্শনীর আওতায় এলো ‘মনপুরা’। বৃত্তাকার একটি ফ্রেমে বন্দী করে ছবিটি শূন্যে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। বৃত্তের ভেতরে প্রবেশ করে উপরের দিকে তাকালে ছবিটি দৃশ্যমান হয়। বাকি ছবিগুলোও নতুনভাবে বিন্যস্ত করা হয়েছে। কখনও পাশাপাশি সাজানো। কখনও গুচ্ছাকারে বা উপরে নিচে স্থাপন করা হয়েছে। ফ্রেমগুলোতে দামী গ্লাস। ছবি ও নিদর্শনের পাশাপাশি দেয়ালে জয়নুল আবেদিনের কাজের বৈশিষ্ট্য সংক্ষিপ্ত আকারে লিপিবদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। শিল্পীর জীবনের পথপরিক্রমা সম্পর্কেও ধারণা দেয়ারও চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। এ কারণে গ্যালারিতে রাখা হয়েছে শিল্পাচার্যের ব্যবহৃত তুলি, খগের কলম, রংয়ের টিউব ও স্প্যাচুলাসহ চারটি স্মৃতি নিদর্শন। সব দেখে অর্থ শ্রম ঘাম বিনোয়োগের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়। কিন্তু যারা ছবি আঁকার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত, দেশের যারা খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী তারা এই নতুন উপস্থাপনায় খুশি হতে পারেননি। খুঁটিয়ে দেখে বলেছেন, ঘোরতর ত্রুটি আছে। অসন্তোষ এমনকি ক্ষোভ লক্ষ্য করা গেছে তাদের মাঝে। দেশের প্রখ্যাত শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার গ্যালারি ঘুরে যত দেখছিলেন ততোই তার ভুরু কুঁচকে যাচ্ছিল। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, একটি জাতির শ্রেষ্ঠতম শিল্পীর জন্য যে গ্যালারি হওয়া উচিত, তাঁর ছবি প্রদর্শনের যে ব্যবস্থা হওয়া উচিত, সেটি এখানে হয়নি। সম্মানটা, মনে হচ্ছে, তাঁকে দেয়া যায়নি। এ কাজের সঙ্গে যারা যুক্ত ছিলেন তারা সম্মানের বিষয়টি হয়ত বুঝতেই পারেননি। দেয়ালের ছবিগুলো কেমন যেন জমে গেছে। স্পেস নেই। অকারণে ছবির যে ভিড়, ভাল লাগেনি। সমন্বয়টাও সেভাবে হয়নি। ফ্রেম এবং পেছনের দেয়ালের রংয়ের সঙ্গে ছবির সম্পর্ক আরও ভাল হওয়া উচিত ছিল বলে মত দেন তিনি। তবে একদমই মানতে পারছিলেন না ‘মনপুরা’ ছবির উপস্থাপনা। সে কথা জানিয়ে বলেন, একটা গোলের মধ্যে ছবিটি দেখতে খুব খুবই দৃষ্টিকটু লাগছে। এটি শিল্পাচার্যের অসম্মানজনক উপস্থাপনা। আমি তো ছবিটি দেখতেই পারছি না। যেটুকু দেখেছি, একেবারেই ভাল লাগেনি। ছবিটির উপস্থাপনার ঢং পরিবর্তন করার জোর দাবি জানান তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন শিল্পী নিসার হোসেনও গ্যালারি দেখে খুশি হতে পারেননি। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, ছবির উপরে যেসব গ্লাস লাগানো হয়েছে সেগুলোর অনেক দাম। ছবিকে প্রটেক্ট করবে। কিন্তু এই কাঁচতো ছবির অরিজিনালিটি নষ্ট করে দিয়েছে। পৃথিবীর বিখ্যাত অনেক জাদুঘর আমি ঘুরেছি। ছবি রক্ষায় এমন কাঁচের ব্যবহার দেখিনি। তিনি বলেন, আবেদিন স্যার তো বালি মিশিয়ে ওয়াটার কালার করেননি। এখানে ছবি দেখে তা-ই করেছেন বলে মনে হচ্ছে। কিছু ছবি আবার পায়ের কাছে নেমে এসেছে। তিনি জানতে চান, এটা কী ধরনের সম্মান? এই শিল্পীও সবচেয়ে বেশি ক্ষোভ প্রকাশ করেন ‘মনপুরা’র উপস্থাপনা নিয়ে। বলেন, ‘মনপুরা’ ছবির যে বিশাল ভিউ এখানে তার ছিটেফোঁটাও নেই। অসামান্য এই শিল্পকর্মটি সম্পূর্ণ ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ভূমিভাগের দৃশ্য দেখতে হচ্ছে আকাশ দেখার মতো করে। ফলে রিয়েল ফিলটা একদমই পাওয়া যাচ্ছে না। বিকৃত উপস্থাপনা মেনে নেয়া কঠিন। শিল্পাচার্য বাবার নামে গ্যালারি। দেখতে এসেছিলেন কনিষ্ঠ সন্তান মইনুল আবেদিনও। তিনিও মাথার ওপরে ঝুলন্ত বৃত্তের ভেতরে দাঁড়িয়ে চোখ বড় করে ফেলেন। প্রতিক্রিয়া জানিয়ে জনকণ্ঠকে বলেন, ‘মনপুরা’ ছবির টোটাল উপস্থাপনা এখানে নেই। পুরো ছবিটা এক দৃষ্টিতে দেখা যায় না। আই লেভেলে নেই। এটা দেখে খুব খারাপ লাগছে। ছবিটি সঠিকভাবে উপস্থাপন করার দাবি জানান তিনি। সংস্কৃতিমন্ত্রীর বক্তব্যেও বিষয়টি ওঠে আসে। স্বীকারোক্তি করে মন্ত্রী বলেন, গ্যালারির কাজটি আমরা খুব দক্ষতার সঙ্গে করতে পেরেছি বলে মনে করি না। উপস্থাপনার কিছু বিষয়ের সঙ্গে আমরা একমত হতে পারিনি। অচিরেই উপস্থাপনার ত্রুটি দূর করা হবে বলে আশ্বস্ত করেন মন্ত্রী। তবে এত অভাব অভিযোগের পরও জয়নুলের ছবি আলোকিত করে রেখেছে অন্ধকার গ্যালারিটিকে। বার বার দেখা ছবি। তবুও একেবারে কাছে গিয়ে বিস্ময় নিয়ে দেখছেন শিল্পপ্রেমীরা। জয়নুলের দুর্ভিক্ষ সিরিজের ছবিগুলো যেন ইতিহাসের স্মারক। শিল্পের সূক্ষ্ম সুন্দর তুলির টানে মূর্ত হয়ে উঠেছে। জলরংয়ের রঙে চোখ আটকে যায়। দিন শেষে তাই মনে হয়, জয়নুল আবেদিনের ছবিই গ্যালারির উদ্ভাসিত আলো।
×