ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

রুশো তাহের

রূপপুর নিয়ে পরমাণুভীতি

প্রকাশিত: ০৩:৪০, ৩০ অক্টোবর ২০১৬

রূপপুর নিয়ে পরমাণুভীতি

১৯৭৯ সালের ২৮ মার্চ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের থ্রি-মাইল আইল্যান্ড পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রে দুর্ঘটনা ঘটে। এতে আমেরিকাসহ পৃথিবীর মানুষের মধ্যে পরমাণুভীতি দেখা দেয়। যদিও ওই দুর্ঘটনায় তেমন কোন ক্ষয়ক্ষতিই হয়নি। এদিকে থ্রি-মাইলের দুর্ঘটনাকে নিয়ে নির্মিত হয় ‘দ্য চায়না সিনড্রোম’ নামে মুভি। যাতে দেখানো হয়েছিল থ্রি-মাইল আইল্যান্ডের দুর্ঘটনাকবলিত রি-এ্যাক্টর গলে চীন পর্যন্ত গর্ত সৃষ্টি করবে। ‘দ্য চায়না সিনড্রোম’ মুভির ওই দৃশ্য বাংলা সিনেমায় মারামারির মতো অবাস্তব হলেও মানুষের মনোজগতে পরমাণুভীতি সৃষ্টিতে তথা প্রজন্ম পরম্পরায় পারমাণবিক বিদ্যুত উৎপাদনে নেতিবাচক প্রচারণায় এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। বস্তুত, ১৯৮৬ সালে চেরনোবিল ও ২০১১ সালে জাপানের ফুকুশিমা দাইচির পারমাণবিক দুর্ঘটনাও মানুষের মধ্যে পরমাণুভীতি ছড়িয়ে দিতে সহায়ক ভূমিকা রাখছে। তাই শান্তিপূর্ণ কাজে পারমাণবিক শক্তির ব্যবহার সম্পর্কে যে কোন তথ্য প্রচার করে মানুষকে ভয় পাইয়ে দেয়া যায়। বিভ্রান্ত করা যায়; বিভ্রান্তি থেকে গণবিরোধিতা এবং এই ভিত্তিকে কাজে লাগিয়ে পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপন তথা কোন দেশের পারমাণবিক বিদ্যুত উৎপাদন ও ব্যবহারের যুগে পদার্পণে ষড়যন্ত্রও করতে পারে কোন কোন মহল। বাংলাদেশের রূপপুরে নির্মাণাধীন পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপন নিয়ে এ-রকম অনেক তথ্য প্রচার করছে কিছু মিডিয়া। যেখানে স্পষ্টত হরহামেশা দায়িত্বশীলতা ও সতর্কতার পরিবর্তে অজ্ঞতা ও মিথ্যাচার অনুশীলিত হচ্ছে। যেমন, শিরোনামের সঙ্গে সংবাদের বৈসাদৃশ্য, ভুল তথ্য পরিবেশন, মনগড়া ও অনুমাননির্ভর সংবাদ তৈরি করা প্রভৃতি। এর পেছনে রূপপুর নিয়ে গভীর কোন এজেন্ডার বাস্তবায়ন নেই এবং এটি নিছক-ই সংবাদ পরিবেশন- তা কিন্তু বলা যায় না। ‘তেজস্ক্রিয় বর্জ্য ফেরত নেবে না রাশিয়া’ এই শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে ‘পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয় ইউরেনিয়াম ২৩৮। আবার ওই প্রতিবেদকেরই লেখা আরেক প্রতিবেদনে ‘তেজস্ক্রিয় বর্জ্য নিয়ে সরকার উদ্বিগ্ন’ শিরোনামের সংবাদে উল্লেখ করা হয়েছে পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয় ইউনেরিয়াম-২৩৫। কোনটি সঠিক? এদিকে যদি বিশেষ মহলের উদ্দেশ্য থাকে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রের তেজস্ক্রিয় বর্জ্য রাশিয়া ফেরত নেবে না-এই শিরোনামেই কাজ হয়ে যাবে মানে রূপপুরবিরোধী সেন্টিমেন্ট বৃদ্ধি পাবে, মানুষ ভীত হয়ে যাবে। অনেকটা দ্য চায়না সিনড্রোম মুভির দৃশ্যের মতো, তাহলে বলতে হবে তারা প্রাথমিকভাবে সফল হয়েছে। কারণ ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ইতোমধ্যে দেশের ১০ বুদ্ধিজীবী রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপন চুক্তি বাতিলের দাবি জানিয়ে বিবৃতি প্রদান করেছেন। এখানে আরেকটি প্রসঙ্গের অবতারণা করতে চাই। সুন্দরবন ধ্বংস করে দেবে, জীববৈচিত্র্য বিনষ্ট হবে, নদীর পানি, মাটি, বায়ু- সবই দূষিত হয়ে যাবে এক মহাদূষণকারী রামপালে নির্মাণাধীন কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুতকেন্দ্র দ্বারা (রামপালবিরোধীরা এমনটাই দাবি করছে) এ রকম প্রচারণায় রামপালবিরোধীরা সরব। তাদের বক্তৃতা, বিবৃতি ও লেখায় আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের উদ্বৃতিও স্থান পাচ্ছে। এদিকে রামপালবিরোধী আন্দোলনে গতির সঞ্চার করেছে ইউনেস্কো। সংস্থাটি সরকারকে রামপালের ব্যাপারে রীতিমতো আল্টিমেটাম দিয়ে বসল। আর এই আল্টিমেটামকে শক্তিশালী অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে রামপালবিরোধীরা। কিন্তু ইউনেস্কো এ ধরনের আল্টিমেটাম প্রদানের অধিকার রাখে কি- এদিকটি বিবেচনা না করে রামপাল বিদ্যুতকেন্দ্রকে সরিয়ে নেয়ার আল্টিমেটামকে আন্দোলনের টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে নিয়ে লাফালাফি করছে রামপালবিরোধীরা। ব্যতিক্রম বাদ দিলে এরা রূপপুরও বিরোধী। তাই তাদের দায়িত্ব রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রের স্পেন্ট নিউক্লিয়ার ফুয়েল বা তেজস্ক্রিয় বর্জ্য রাশিয়া ফেরত নেবে কি না, ফেরত নেয়ার আগ-মুহূর্ত পর্যন্ত এর সংরক্ষণে কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে, রাশিয়া তার আগের অবস্থান থেকে সরে আসতে পারে কি না প্রভৃতি বিষয় নিয়ে লেখা এবং লেখার ভিত্তিতে বক্তৃতা-বিবৃতি প্রদানের আগে নির্মাণাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র সম্পর্কে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ)’র গাইডলাইন দেখে নেয়া কিংবা এ বিষয়ে সম্যক জ্ঞাত হওয়া। আসলে পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপন ও পরিচালনায় স্পেন্ট নিউক্লিয়ার ফুয়েল বা তেজস্ক্রিয় বর্জ্য সংরক্ষণ, ব্যবস্থাপনা ও পরিবহন কোন দেশজ বিষয় নয়, বরং এটি প্রতিবেশী, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ইস্যু। উল্লেখ্য, পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপনে আইএইএ’র গাইডলাইন অনুপুঙ্খ অনুসরণ করা হচ্ছে কিনা, তা-ও আইএইএ কর্তৃক নিবিড়ভাবে মনিটরিং করা হয়ে থাকে। স্পেন্ট নিউক্লিয়ার ফুয়েল পরিশোধন, পরিবহন ও সংরক্ষণ বিপুল ব্যয় সাপেক্ষ ও উচ্চতর প্রযুক্তিনির্ভর- এই চ্যালেঞ্জ আমলে নিয়েই বাংলাদেশ রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপনে আত্মনিয়োগ করছে। ২০০৯ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের উল্লেখ করার মতো বিচ্যুতি দেখা দিলে অগ্রগতির এতগুলো ধাপ পেরিয়ে আমরা আজকের পর্যায়ে আসতে পারতাম না। রূপপুর নিয়ে বাংলাদেশের বিচ্যুতি আইএইএসহ প্রতিবেশী, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গন-সবার নজরদারি এড়ানো সম্ভব নয়। এরপরও নির্মাণাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র নিয়ে ভীতি আমাদের পিছু ছাড়ছে না। আসলে এই ভীতি পরিকল্পিতভাবে ছড়ানো হচ্ছে । এদিকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রের স্পেন্ট নিউক্লিয়ার ফুয়েল ব্যবস্থাপনায় স্পষ্ট উল্লেখ আছে উভয় সরকার কোন কারণে ইন্টার গবর্নমেন্টাল এগ্রিমেন্ট (আইজিএ) বাতিল করলেও রাশান ফেডারেশন কর্তৃক স্পেন্ট নিউক্লিয়ার ফুয়েল রাশিয়া ফেরত নেয়া সংক্রান্ত বিধানটি আজীবন বলবৎ থাকবে। রাশিয়ান নিউক্লিয়ার মন্ত্রণালয় ইরানের স্পেন্ট নিউক্লিয়ার ফুয়েল ফেরত নেয়ার দৃষ্টান্তও রয়েছে। তারপরও রহস্যময় কারণে প্রচার করা হচ্ছে, ‘রাশিয়ার বর্তমান অবস্থান তেজস্ক্রিয় জ্বালানি বর্জ্য পরিবহনযোগ্য হওয়ার পর রাশিয়া তা ফেরত নিয়ে পরিশোধন করবে। এরপর তা বাংলাদেশে ফেরত পাঠাবে এবং তারপর থেকে তা বাংলাদেশকেই সংরক্ষণ করতে হবে।’ স্পেন্ট নিউক্লিয়ার ফুয়েল ফেরত নিয়ে পরিশোধনের পর তা বাংলাদেশে ফেরত পাঠাবে কি না তা রাশিয়ান সরকারের দীর্ঘ সময় সাপেক্ষ সিদ্ধান্তের বিষয়। পরন্তু রি-এ্যাক্টর প্রযুক্তির উত্তরোত্তর অগ্রগতির ফলে ২০৩০ সাল নাগাদ নিরাপত্তা ও কার্যকারিতার নতুন বারতা নিয়ে আসছে চতুর্থ প্রজন্মের রি-এ্যাক্টর। যেখানে জ্বালানি হিসেবে পূর্ববর্তী প্রজন্মের রি-এ্যাক্টরের স্পেন্ট নিউক্লিয়ার ফুয়েল ব্যবহৃত হবে। তাই স্পেন্ট নিউক্লিয়ার ফুয়েলর গুরুত্ব রাশিয়ার নিকট অপার। সুতরাং পরিশোধিত স্পেন্ট নিউক্লিয়ার ফুয়েল বাংলাদেশকে সংরক্ষণের প্রসঙ্গ আসছে কেন? এটা কি বাংলাদেশের জনগণকে ভয় পাইয়ে দেয়ার মাধ্যমে পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপনবিরোধী করে তোলার আরেক কৌশল? অন্তরালে থাকা কোন মহলের এ্যাসাইনমেন্ট বাস্তবায়নের অংশ? বস্তুত, এ-বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে কালক্ষেপণ না করে সজাগ হওয়ার সময় এসেছে। লেখক : বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক
×