ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সিনেমা দেশ ও সমাজের গল্প বলে

প্রকাশিত: ০৬:২৭, ২৯ অক্টোবর ২০১৬

সিনেমা দেশ ও সমাজের গল্প বলে

একটা সময় ছিল যখন বাবা-মা তার এগারো বছরের ছেলেকে সিনেমা হলে পাঠিয়েছে রাজ্জাক-ববিতা অভিনীত ছবির আগাম টিকিট কাটতে। তারপর সপরিবারে সিনেমা দেখে এসে খাবার টেবিলে চলতো সেই সিনেমার বিচার বিশ্লেষণ, গল্প-আড্ডা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিবার বলতে তখন ছিল দাদা-দাদি, চাচা-চাচি, চাচাত ভাই-বোনদের নিয়ে যৌথ পরিবার। সপরিবারে সিনেমা দেখে এক সঙ্গে কাটানো সেই মুহূর্তও ভাল লাগার অনুভূতি। পারিবারিক বন্ধনকে আরও সুদৃঢ় করেছে, পারস্পরিক ভাব বিনিময়ের সুযোগ করে দিয়েছে। কোন কোন সিনেমার গল্প বা দৃশ্য পুরো পরিবারকে কাঁদিয়েছে, হাসিয়েছে, ভাবিয়েছে। চিন্তার জগতকে প্রভাবিত করত, অনুভূতিকে নাড়া দিয়েছে। পরিবারের সবাইকে নিয়ে নির্মল বিনোদনের প্রধান মাধ্যম ছিল সিনেমা। এটি বাঙালী মধ্যবিত্ত ঘরের সাধারণ গল্প সত্তর এবং আশির দশক জুড়ে। এই গল্পের শেষ পরিণতি শুরু হয়, নব্বই দশকের শেষের দিকে বাংলা সিনেমায় অশ্লীলতার সূত্রপাত দিয়ে। দুলাভাই দুলাভাই, চল সিনেমা দেখতে যাই, সিনেমার নাম নাকি ‘তোমাকে চাই’ অথবা ‘দুলাভাই একনা কতা কবার চাও, অমপুর মুই যাবার চাও, ছায়াছবি দেখিয়া আনু হয়’ রংপুর অঞ্চলের ভাওয়াইয়া গানের এই কলি থেকে বোঝা যায় একটা সময় সিনেমা দেখার বড় অনুষঙ্গ ছিল দুলাভাই। দুলাভাইয়ের কাছে শ্যালক-শ্যালিকাদের প্রধান আবদার ছিল সিনেমা দেখাতে নিয়ে যাওয়া। দুলাভাইরাও মহানন্দে বউ, শ্যালক-শ্যালিকা পরিবেষ্টিত হয়ে রিক্সা বা গরুর গাড়িতে চেপে ছুটেছে সিনেমা দেখতে। আত্মীয়তার এ বন্ধন আর আনন্দের কোন তুলনা নেই। কিন্তু এখন এ দৃশ্য বিরল। দু’ যুগ আগেও গ্রামগঞ্জে পূজা বা কোন উৎসব উপলক্ষে শুরু হতো আর এক ছোট্ট উৎসব। পাড়ার মাঝ বরাবর বিশাল সাদা চাদর টাঙানো হতো। রোজ রাতে দেখানো হতো বাংলা ছায়াছবি। দুষ্প্রাপ্য বায়োস্কোপ এসে ধরা দিত পাড়ায়। ‘সিনেমা’ দেখা নিয়ে ছিল হাজার বিধি-নিষেধ। মনে করা হতো সিনেমা দেখলে তার কুপ্রভাব পড়তে পারে। কলেজে না ওঠা অবধি ফিল্ম দেখার অনুমতি মেলেনি। নিষেধ না মেনেই পাড়ার ছেলেরা লুকিয়ে সিনেমা দেখেছে। সিনেমা দেখা সম্পর্কে অতীত বর্তমান নিয়ে রংপুর সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাবেক সভাপতি টিভি ও মঞ্চ অভিনেতা বিপ্লব প্রসাদ বলেন, সিনেমা সমাজের দর্পণ। দেশকে জানার সহজ উপায় হল সেই দেশের সিনেমা দেখা। কারণ সিনেমার মাঝেই দেখা যায় সে দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা, সংস্কৃতি, ধর্ম ও জীবনধারা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যদি আমরা সত্তর কিংবা আশির দশকের সিনেমার দিকে তাকাই, তাহলে কিন্তু আমরা বাংলাদেশকে দেখতে পাব, দেখতে পাব বাংলাদেশের সমসাময়িক বিষয়। কিন্তু নব্বই দশক থেকে বাংলা সিনেমায় ছন্দপতন ঘটেছে। তখন পরিচালকরা কপি সিনেমায় আগ্রহী হওয়ায় আমরা হারাতে লাগলাম বাংলাদেশকে। বর্তমানের প্রেক্ষাপট চিন্তা করলে আমরা দেখি, বাংলাদেশের বেশিরভাগ সিনেমা হয়ত তামিল, তেলেগু, হলিউড কিংবা কোরিয়ান সিনেমার কপি। মৌলিক গল্পের ছবি নেই বললেই চলে। আবার কিছু কিছু মৌলিক গল্পের সিনেমায় থিম কপি কিংবা চিত্রনাট্যে বিদেশী ছবির ছাপ পাওয়া যায়। এরকম নানা কারণে বাংলা সিনেমার চরম দুঃসময় চলছে। সিনেমা হল একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। চলচ্চিত্রের এই দুরবস্থার জন্য সরকারী- বেসরকারী পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব, সিনেমা হলের দুরবস্থা, ভাল চলচ্চিত্র নির্মিত না হওয়া, আর্থিক সঙ্কট, আধুনিক প্রযুক্তির অভাব, চলচ্চিত্র শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের অভাবকে দায়ী করেন তিনি। তিনি বলেন, হলে দর্শক নেই বলে বাংলাদেশে সিনেমাপ্রেমীর সংখ্যা কমেনি বরং বেড়েছে। ইন্টারনেট সহজ লভ্যতার এই যুগে বাংলাদেশের সিনেমাপ্রেমীরা এখন আর শুধু বাংলা বা হিন্দী সিনেমায় আটকে নেই, ভাল সিনেমা দেখার জন্য তারা এখন হলিউড ছাড়িয়েও যেতে পারে ইরানিয়ান বা কোরিয়ান সিনেমার কাছে। এই সময়ে বাংলাদেশী সিনেমাকে চাঙ্গা করতে হলে অনেক পরিবর্তন দরকার। সব থেকে বেশি দরকার এই প্রজন্মের দর্শককে সিনেমা হলমুখী করা। আর সিনেমাপ্রেমী এই দর্শককে হলমুখী করতে হলে ‘ভাল’ সিনেমা নির্মাণের বিকল্প নেই। দর্শক সিনেমা হলে যায় না সে দোষ দর্শকের নয়, সিনেমার। ভাল সিনেমা দর্শক টানবেই। -আব্দুর রউফ সরকার, রংপুর থেকে
×