ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

রাজধানীতে বড় সমাবেশ করতে চায়

মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা বিএনপির

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ২৯ অক্টোবর ২০১৬

মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা বিএনপির

শরীফুল ইসলাম ॥ মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে বিএনপি। এজন্য প্রথমেই রাজধানীতে একটি বড় ধরনের সমাবেশ করতে চায় দলটি। অনুমতি পেলে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই সমাবেশ করতে চায়, তা না হলে নয়াপল্টন দলীয় কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের রাস্তায় বড় একটি সমাবেশ করে নেতাকর্মীদের দলীয় কর্মসূচীতে সক্রিয় করার কথা ভাবছে বিএনপি হাইকমান্ড। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে বিএনপি কার্যত মাঠের রাজনীতিতে নেই। বিশেষ করে গত বছর টানা ৯২ দিনব্যাপী নেতিবাচক আন্দোলন করতে গিয়ে রাজনৈতিকভাবে চরম বেকায়দায় পড়ার পর বলতে গেলে এক প্রকার নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে দলটি। ১৯ মার্চ জাঁকজমক জাতীয় কাউন্সিল করে ৫৯১ সদস্যের ঢাউস কমিটি দিয়েও দলকে মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় করতে পারেননি বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। বরং দলের ভেতর এখন নানামুখী সমস্যা দেখা দিয়েছে। মাঝে মধ্যে ইস্যুভিত্তিক কিছু ঘরোয়া কর্মসূচী পালন করলেও এসব কর্মসূচীতে দলের নেতাকর্মীদের তেমন উপস্থিতি ঘটে না। এর ফলে এসব কর্মসূচী সফল হয় না। সূত্রমতে, রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অথবা বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বড় ধরনের শোডাউন করে ৭ নবেম্বর ‘বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ পালন করতে চায় বিএনপি। ওই দিন এ কর্মসূচী পালন করতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান কিংবা বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে অনুমতি না পেলে ঘরোয়াভাবেই এ কর্মসূচীটি পালন করবে। সেক্ষেত্রে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসকে কেন্দ্র করে বড় ধরনের সমাবেশ করার প্রস্তুতি নেবে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অথবা বিএনপি কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করার অনুমতি পেলে রাজধানীসহ আশপাশের এলাকা থেকে বিপুলসংখ্যক লোক জড়ো করে বড় ধরনের শোডাউন করে সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের দলীয় কর্মকা-ে চাঙ্গা করার চেষ্টা করবে বিএনপি। ঢাকায় একটি বড় ধরনের সমাবেশ করতে পারলে ঘন ঘন আরও কিছু কর্মসূচী পালন করে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া সারাদেশের বিভিন্ন জেলা সফরে গিয়ে সমাবেশ করা শুরু করবেন। আর আগামী বছরের মধ্যভাগে আবার ঢাকায় একটি বড় ধরনের জনসভা করে দলের নেতাকর্মীদের আরও গতিশীল করার চেষ্টা করবেন। এরপর আস্তে আস্তে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি জোরদার করে দলকে নির্বাচনমুখী করবেন। সেই সঙ্গে আগেভাগেই প্রতিটি সংসদীয় এলাকায় যোগ্য প্রার্থী ঠিক করে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ের ফসল ঘরে তোলার চেষ্টা করবেন। এদিকে মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার পাশাপাশি সর্বস্তরে দলের কমিটি পুনর্গঠনের কাজও চালিয়ে যাবে বিএনপি। এজন্য ইতোমধ্যেই কিছু কর্মপরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। তৃণমূলে দল পুনর্গঠনের জন্য ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহানের নেতৃত্বে দলের কিছু কেন্দ্রীয় নেতাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে একেক করে বিএনপির ১১টি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনকেও পুনর্গঠন করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, এটা ঠিক বিভিন্ন কারণে বিএনপি মাঠের রাজনীতিতে তেমন সক্রিয় নেই। তবে শীঘ্রই কিছু সুনির্দিষ্ট কর্মসূচী নিয়ে মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় হবে বিএনপি। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ ভেন্যুতে রাজনৈতিক সমাবেশ করার জন্য সরকারের অনুমতি পাওয়া যাচ্ছে না। অনুমতি পেলেই রাজধানীতে বড় ধরনের সমাবেশ করে দলীয় নেতাকর্মীদের গতিশীল করার চেষ্টা করা হবে। এছাড়া বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াসহ সিনিয়র নেতারা বিভিন্ন জেলা সফর করে দলকে গতিশীল করবেন। সেই সঙ্গে সর্বস্তরে দল পুনর্গঠনের কাজ শেষ করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি জোরদার করা হবে। তবে আমরা সরকারকে বলছি যেন নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন করে অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিএনপিই ক্ষমতায় আসবে। সেজন্যই নির্বাচনের আগে মাঠের রাজনীতি গতিশীল করার পাশাপাশি সর্বস্তরে দলকে ঢেলে সাজানো হবে। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের জাঁকজমক জাতীয় কাউন্সিল ও দলের নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনে বিএনপিও নড়েচড়ে বসেছে। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা নিজ দলের নেতাকর্মীদের দলে সক্রিয় হওয়ার নির্দেশ দেয়ায় বিএনপির হাইকমান্ডও নতুন উদ্যমে দলের নেতাকর্মীদের নির্বাচনমুখী করার কথা ভাবছে। বর্তমানে বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে যে হতাশা তৈরি হয়েছে সেটা কিভাবে দ্রুত দূর করা যায়, সে কৌশলও খোঁজা হচ্ছে বলে জানা গেছে। এজন্য বিএনপির থিঙ্কট্যাংক হিসেবে পরিচিত কিছু বুদ্ধিজীবীর পরামর্শ নেয়া হচ্ছে। এদিকে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমনসহ দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের নামে হওয়া মামলাগুলো থেকে কিভাবে পরিত্রাণ পাওয়া যায় ভেতরে ভেতরে সে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপি। এ নিয়ে সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করতে দেশ-বিদেশে বিভিন্ন মহলের সঙ্গে বিএনপি হাইকমান্ড নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন বলে জানা গেছে। এসব মামলার ব্যাপারে সমঝোতায় পৌঁছতে প্রয়োজনে সরকারকে রাজনৈতিকভাবে কোন কোন বিষয়ে ছাড় দিতেও বিএনপি রাজি আছে। তবে সমঝোতা হতে হলে সরকারী দলের সঙ্গে যে বিএনপির আলোচনা প্রয়োজন সে বিষয়টিকে মাথায় রেখেই তারা বারবার সংলাপের কথা বলছেন। সরকারী দলের পক্ষ থেকে সংলাপের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করার পরও বিএনপি সংলাপের দাবি থেকে সরে আসছে না। এ দাবি অব্যাহত থাকবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, আগে বেশ কয়েক বার রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকার পরও এখন টানা ১০ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি আর বেশিদিন ক্ষমতার বাইরে থাকতে চায় না। তাই দলটির আপাতত লক্ষ্য যে ধরনের সরকারের অধীনেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন হোক না কেন পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়া। তাতে অংশ নিয়ে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করা। কোন কারণে ক্ষমতায় যেতে না পারলেও যেন সম্মানজনক আসন পেয়ে জাতীয় সংসদে বিরোধী দল হিসেবে শক্ত অবস্থান নেয়া যায়। আর তাহলে ঘরে বাইরে সরকারকে চাপে ফেলে রাজনৈতিকভাবে এগিয়ে যেতে পারলে তার পরের নির্বাচনে ক্ষমতায় যাওয়ার পথ প্রশস্ত হবে। তাই পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়ার চেষ্টা করবে বিএনপি। বর্তমান সরকারের কাছ থেকে মোটামুটি নিরপেক্ষ নির্বাচন হবেÑ এমন নিশ্চয়তা পেলে সংবিধানের আলোকে প্রধানমন্ত্রীর অধীনেই নির্বাচনে যাবে বিএনপি। এজন্য দলের নেতাকর্মীদের মানসিক প্রস্তুতিও রয়েছে বলে জানা গেছে। প্রসঙ্গত, ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর ক্ষমতা হারানোর পর টানা দুই বছর রাজনৈতিকভাবে চরম বৈরী পরিস্থিতি মোকাবেলা করে বিএনপি। এ সময় দলের অনেক সিনিয়র নেতাকে বিভিন্ন মামলার আসামি হয়ে জেলও খাটতে হয়। তবে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নিবাচনে অংশ নিয়ে বিরোধী দল হিসেবে সংসদে যাওয়ার সুযোগ পায় তারা। কিন্তু ২০১৩ সালে ২০ দলীয় জোটের ব্যানারে নেতিবাচক আন্দোলন কর্মসূচী পালন করতে গিয়ে আবারও কঠোর সমালোচনার মুখে পড়ে বিএনপি। সূত্রমতে, বিএনপির বেশিরভাগ নেতাকর্মী মনে করেন, সর্বস্তরে দল গুছিয়ে ভোটের রাজনীতিতে নিজেদের শক্তিশালী অবস্থান টিকিয়ে রাখার জন্য পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলকে অংশ নিতে হবে। তবে কিভাবে মোটামুটি সুষ্ঠু নির্বাচন করার ব্যবস্থা করা যায়, সেজন্য সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছতে হবে। প্রয়োজনে সরকারকে কিছুটা ছাড়ও দিতে হবে। কিন্তু বিএনপির যেসব নেতা অতীতে মন্ত্রী-এমপি হয়ে অগাধ অর্থ-সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। তারা এখন বাকি জীবন আরাম-আয়েশে কাটানোর জন্য দলের জন্য কোন ঝুঁকি নিতে চান না। তারা এখন দলের বড় বড় পদ বাগিয়ে নিয়ে নিজ নিজ ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করলেও দলীয় কর্মকা-ে বেশি সক্রিয় হতে চান না। এমনকি নির্বাচনে যাওয়ার ব্যাপারেও তারা তেমন একটা আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। বরং সরকারী দলের নেতাদের সঙ্গে গোপন আতাত করে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা নিচ্ছেন। তবে এসব নেতাদের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রেখেই দলীয় হাইকমান্ড ভবিষ্যত কর্মসূচী নির্ধারণ করছেন। বিএনপি সূত্র জানায়, দলীয় হাইকমান্ড সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখেই পরবর্তী কর্মকৌশল নির্ধারণের চেষ্টা করছেন। এর মাধ্যমে নেতাকর্মীদের সক্রিয় করে দলকে এগিয়ে নিতে চান। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী এক বছরের মধ্যেই সর্বস্তরে দলের কমিটি পুনর্গঠন করে দলকে পুরোদমে নির্বাচনমুখী করতে চান তারা।
×