ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণে বাম গণতান্ত্রিক বিকল্প গড়ে ক্ষমতায় যেতে চায় সিপিবি

রাষ্ট্রের ঔদাসীন্যের সুযোগে জঙ্গীবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ২৯ অক্টোবর ২০১৬

রাষ্ট্রের ঔদাসীন্যের সুযোগে জঙ্গীবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রাজনৈতিক শূন্যতা ও রাষ্ট্রের উদাসীনতার সুযোগে উগ্র-জঙ্গীবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এই প্রেক্ষাপটে সাম্প্রদায়িকতা, সন্ত্রাস, মৌলবাদ ও জঙ্গীবাদ মোকাবেলায় ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি। সিপিবি নেতৃবৃন্দ বলেছেন, দেশের রাজনীতি এখন তিনটি ধারায় বিভক্ত হয়েছে। একদিকে মৌলবাদী ও উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান, অন্যদিকে এই অশুভ শক্তিকে মদদ দিচ্ছে কিংবা এই শক্তির সঙ্গে যুক্ত বিএনপি-জামায়াত জোট। সরকার কোন কোন ক্ষেত্রে মৌলবাদী শক্তির সঙ্গে আপোস করে টিকে আছে। আর বিরোধী দল হলো এক শ্রেণীর চাটুকার। তারা ক্ষমতা ধরে রাখতে সব পথেই চলে। এমন বাস্তবতায় রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণে বাম-গণতান্ত্রিক বিকল্প গড়ে ক্ষমতায় যাওয়ার প্রত্যয় ঘোষণা করেছেন পার্টির নেতারা। শনিবার রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পার্টির চারদিনব্যাপী একাদশ কংগ্রেসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব কথা বলেন। সম্মেলনে ১২ দেশের ২৬ জনের বেশি অতিথি অংশ নেন। এছাড়া পঁচিশের বেশি দেশের কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠানো হয়েছে। বেলা সোয়া তিনটার দিকে সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পর মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়। এর মধ্যেই বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় নেতারা। যদিও বৈরী আবহাওয়ার কারণে উদ্বোধনী অধিবেশন সংক্ষিপ্ত করা হয়। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন দলের সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, উপদেষ্টা মনজুরুল আহসান খান, উপদেষ্টা শহিদুল্লাহ চৌধুরী, জসিমউদ্দিন ম-ল, সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবু জাফর আহমেদ, হায়দার আকবর খান রনো প্রমুখ। উপস্থিত ছিলেন ওয়ার্কার্স পার্টি পলিটব্যুরো সদস্য বিমল বিশ্বাস, কামরুল আহসান, সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া, ঐক্যন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য, সাইফুল হক, মোশরেফা মিশু, ইসমাইল হোসেন, জোনায়েদ সাকি, ডাঃ শাহাদাত হোসেন, মফিজুল ইসলাম কামাল, আবুল মকসুদ ও কবি মোহন রায়হান প্রমুখ। মনজুরুল আহসান খান বলেন, বিএনপি-জামায়াত মিলে দেশে মৌলবাদ-জঙ্গীবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা লালন করছে। সরকার তাদের সঙ্গে নানা কায়দায় আপোস করে ক্ষমতায় টিকে আছে। বিরোধী দল আপোসকামিতায় বিশ্বাসী। এতে আমরা দিন দিন বিপজ্জনক অবস্থানের দিকে যাচ্ছি। মৌলবাদের সঙ্গে আপোস করে গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখা যাবে না। এমন বাস্তবতায় বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তোলার আহ্বান জানান তিনি। সমাপনী বক্তব্যে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, লুটপাট ও রুগ্নতার সুযোগ নিয়ে সাম্প্রদায়িকতা শেকড় গেড়েছে সমাজের প্রতিটি স্তরে। গণতান্ত্রিক চর্চা আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে। মত প্রকাশের ওপর বাধা আসছে। প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদের বদলে সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদী দেশসমূহের ওপর দেশকে নির্ভরশীল করে তোলা হচ্ছে। বিরোধী দল হিসেবে ভূমিকা পালনে বিএনপি চরমভাবে ব্যর্থ একথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, তারা যুদ্ধাপরাধী জামায়াতকে জোটসঙ্গী করেছে। সন্ত্রাসী কায়দায় মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করে ক্ষমতায় যেতে চেয়েছে। কিন্তু ক্ষমতায় থাকতে তাদের দুর্নীতি ও লুটপাটের কথা মানুষ ভোলেনি। বর্তমানে বিরোধী দলের ভূমিকা পালনে যে শূন্যতা বিরাজ করছে এজন্য আমাদের পার্টিকে প্রস্তুত থাকতে হবে। তিনি বলেন, রাজনৈতিবক শূন্যতা ও রাষ্ট্রের উদাসীনতার সুযোগে উগ্র-জঙ্গীবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তারা মুক্তচিন্তার বিপরীতে মানুষ হত্যা করে ত্রাস সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশে ক্রিয়াশীল উগ্রবাদী শক্তি একদিকে যেমন ভিন্ন ধর্মাবলম্বী, মুক্তচিন্তার মানুষ, সংস্কৃতিকর্মী, বিদেশী অতিথিদের হত্যা করছে, তেমনি সমাজদেহে ছড়িয়ে দিচ্ছে বিষবাষ্প। সিপিপি বরাবরই এই মৌলবাদী শক্তির বিপরীতে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে আপোসহীন সংগ্রামে লিপ্ত। সৈয়দ আবু জাফর আহমেদ বলেন, ভাত, কাপড়, জমি কাজ ও সমাজতন্ত্রের অঙ্গীকার নিয়ে আমরা আজ সমবেত হয়েছি। একই সঙ্গে আমরা সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, দুর্নীতি, লুটপাটতন্ত্র ও গণতন্ত্রহীনতার বিরুদ্ধে দৃঢ় সংকল্প ও সংগ্রামের অঙ্গিকার নিয়ে সমবেত হয়েছি। সরকারের সমালোচনা করে তিনি বলেন, চলমান উন্নয়নের জন্য গণতন্ত্র আজ বাক্সবন্দী। নির্বাচনের নামে প্রহসন চলে। চলে রাষ্ট্রীয় ও দলীয় সন্ত্রাস। এ সবই নাকি মুখ বুজে সহ্য করতে হবে, কারণ উন্নয়ন দরকার। আমরা বলতে চাই কমিউনিস্ট পার্টি কোনভাবেই কোন অজুহাতেই গণতন্ত্র বাতিল বা সীমিত করার ষড়যন্ত্র মেনে নেবে না। তিনি বলেন, দেশে এখন যা চলছে তা হলো নিকৃষ্ট পুঁজিবাদ। একদিকে দুর্নীতি আর টাকা পাচার অন্যদিকে দেশে কোন বিনিয়োগ নেই। কর্মসংস্থান হয় না। সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করলেও সাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শকে নানাভাবে টিকিয়ে রেখেছে। সংবিধানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম রেখে দেয়াই এর বড় উদাহরণ। মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদানের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এজন্য ভারতের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। কিন্তু গঙ্গা-তিস্তাসহ প্রায় সকল অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে ভারত বাংলাদেশকে বঞ্চিত করেছে। সীমান্তে মানুষ হত্যা হচ্ছে। আমরা এ ব্যাপারে সোচ্চার। সরকার ভারতের স্বার্থের কাছে জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়েছে। এমনকি দুই দেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান মিলে রামপাল বিদ্যুত প্রকল্প স্থাপনের যে চেষ্টা চালাচ্ছে তাতে সুন্দরবন ধ্বংস হয়ে যাবে। আমরা সর্বশক্তি দিয়ে তা প্রতিরোধ করবই। সম্মেলনে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিআই) সম্পাদক রাজ্যসভা সদস্য ডি রাজা, সিপিএম পলিটব্যুরো সদস্য নীলোৎপল বসু, সিপিআইর (এমএল) সাধারণ সম্পাদক কে এন পিল্লাই রামচন্দ্র, শ্রীলঙ্কার কমিউনিস্ট পার্টির নেতা প্রেমাদারা দিশানায়েকে, পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা পীরজাদা আহমেদ বক্স, ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা অধ্যাপক জন ফস্টার, জার্মানির মার্কসিস্ট লেনিনিস্ট পার্টির নেতা টমাস বেইসেনক্যাম্প, ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট পার্টির ভাইস প্রেসিডেন্ট ন্যুয়েন টুয়ান ফং, রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির নেতা আলেকজান্ডার পোতাপভ, নেপালের অর্থমন্ত্রী নেপাল কমিউনিস্ট পার্টির (ইউএমএল) স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য সুরেন্দ্র প্রসাদ পা-ে, নেপালের কমিউনিস্ট পার্টির (মশাল) সাধারণ সম্পাদক মোহন বিক্রম সিং, নেপালের প্রাক্তন উপ-প্রধানমন্ত্রী চিত্রা বাহাদুর কেসি। সিপিবির দশম কংগ্রেস হয়েছিল ২০১২ সালের ১১-১৩ অক্টোবর। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ৪ বছর পর এবারের কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এবার সারাদেশের ৬৮৩ প্রতিনিধি কংগ্রেসের প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন, যার মধ্যে ২১৭ নারী ও ১৭ আদিবাসী। এর বাইরে ১০৮ জনকে পর্যবেক্ষক মনোনীত করা হয়েছে। ৯৯ প্রবীণ কমরেডকে জানানো হয়েছে বিশেষ আমন্ত্রণ। এদের নিয়ে আজ শনিবার সকাল সাড়ে নয়টা থেকে গুলিস্তানের কাজী বশির মিলনায়তনে শুরু হবে রুদ্ধদ্বার সাংগঠনিক অধিবেশন। একইদিন বিকেল তিনটায় বিদেশী প্রতিনিধিদের নিয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘সাম্রাজ্যবাদ, নয়া উদারনীতিবাদ ও ধর্মীয় মৌলবাদ’ বিষয়ক এক আন্তর্জাতিক সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে। ২৯-৩০ অক্টোবর সন্ধ্যায় মহানগর নাট্যমঞ্চে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে কংগ্রেসের সমাপ্তি ঘটবে।
×