ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ঢাকার কাছেই মিনি রাঙ্গামাটি

টিলার ওপর বাড়িঘর সবুজ স্নিগ্ধ প্রকৃতি- প্রাণ জুড়িয়ে যায়

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ২৯ অক্টোবর ২০১৬

টিলার ওপর বাড়িঘর সবুজ স্নিগ্ধ প্রকৃতি- প্রাণ জুড়িয়ে যায়

মীর আব্দুল আলীম ॥ রূপগঞ্জ নাম থেকেই বোঝা যায় রূপের বাহার। বহু বছর আগে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি এই রূপগঞ্জের রূপে মুগ্ধ হয়েছিলেন বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা। আর তাতেই তিনি রূপসী নামে অভিহিত করেন এলাকাটিকে। স্থানীয়রা মনে করেন, তখন থেকেই রূপগঞ্জের নাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রূপগঞ্জের রূপ ইবনে বতুতাকেই মুগ্ধ করবে তা কি করে হয়? নিশ্চিত বলতে পারি, এখানে এলে আপনিও মুগ্ধ হবেন, প্রাণ জুড়িয়ে যাবে। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ছায়া নিবিড় মনোমুগ্ধ পরিবেশে আপনার দৃষ্টি আটকে যেতে চাইবে। চোখের পলক ফেলা আপনার জন্য হয়ত কষ্টসাধ্য হবে। এখানে না এলে আর বনের ভেতরে শেয়াল, বাগঢাস, গুইশাপ, শাপ, ঘুঘু আর নানা পাখির কিচির মিচির শব্দ নিজ কানে না শুনলে জীবনে হয়ত অপূর্ণতা থেকে যাবে। এখানকার উঁচু-নিচু টিলার ওপর বাড়িঘর ও কৃষি ফসলী আবাদ দৃশ্য দেখলে মনে হবে এ যেন রাঙ্গামাটির কোন গ্রাম। উঁচু টিলায় দাঁড়িয়ে ভাববেন, হ্যাঁ এটা তো সেই রাঙ্গামাটিই। আপনিই বলবেন, এটা আরেক মিনি রাঙ্গামাটি। রাজধানী ঢাকার কোলঘেঁষা স্যাটেলাইট শহর রূপগঞ্জের কথাই বলা হচ্ছে। কেবল দেশে নয়, এশিয়ার সর্ববৃহৎ স্যাটেলাইট শহর হবে রূপগঞ্জের ‘পূর্বাচল’। গাছপালা, টিলা, খালবিল বিলীন করে দ্রুত তৈরি হচ্ছে এই আধুনিক শহর। এখনকার প্রকৃতির অনেকটা বিলীন হলেও ছিটেফোঁটা যে সৌন্দর্য আছে তাতে এখনও যে কেউ মুগ্ধ হবেন। পূর্বাচল প্রকল্পের বাইরে এলাকাগুলোর প্রকৃতি এখনও অক্ষত আছে। এই প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য, সবুজ স্নিগ্ধ নিসর্গে যেন হারিয়ে যেতে মন চায়। এখানকার টিলা-নালা আর সমতলে গড়া জিন্দাপার্কের সৌন্দর্যও আপনাকে পাগল করে দেবে। প্রকৃতির কি নেই এখানে? দ্বীপের অনুভূতি, বনজঙ্গলের আবেশ আর ঝাউবনের মিশেল স্বাদ পাবেন এখানে। জিন্দাপার্কের আশপাশের এলাকাগুলোর প্রকৃতিও আপনাকে বিমোহিত করবে। কোন কোন স্থান তো আপনার কাছে মনে হবে যেন রাঙ্গামাটি। রোদে বৃষ্টিতেও গাছের মাচাংয়ে লতাপাতার ছায়ায় নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে কিছুটা সময় বিশ্রামও নিতে পারবেন। এলাকা জুড়ে দেখা যাবে, নানা নাম না জানা গাছগাছালি। হিড়নাল মাজার এলাকায় রয়েছে শিন্নিœ গাছ নামের অচিন গাছ। জঙ্গলেও রয়েছে এমন অচিন গাছ। যে গাছের নাম বলতে পারে না কেউ। তবে গাছগুলোর বিশাল আকৃতি দেখে আরও উৎসুক হয়ে পড়েন দর্শনার্থীরা। হিড়নাল এলাকার শিন্নি গাছের ফল অতি মিষ্টি এবং বিশালাকার। একই গ্রামের শতাধিক বৃহৎ আকৃতির পর্যাপ্ত জায়গা জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা বটগাছ দেখতে প্রতিদিন উৎসুক জনতার ভিড় চোখে পড়ার মতো। টিলার ওপর বাড়িঘর ও কৃষি ফসলী আবাদ দৃশ্য দেখলে মনে হয় এটা যেন রাঙ্গামাটির কোন গ্রাম। টিলায় কাঁঠাল বাগান, বাঁশঝাড়, জামগাছ, বটগাছ, আম বাগানগুলোর ছায়ায় দিন দুপুরে হেঁটে প্রাকৃতিক অবলোকনে ক্লান্তি আসে না। রাজধানীর ইটপাথরের গ-ি থেকে বেরিয়ে অনেকে আসেন এখানে মিনি রাঙ্গামাটির স্বাদ নিতে। পূর্বাচল ঘেঁষা এলাকায় আছে প্রাকৃতিক পরিবেশে উঁচুনিচু টিলার সমাহার। এসব টিলায় কৃষকদের আবাদ করা ফসল ‘জুম চাষীদের’ কথা মনে করিয়ে দেয়। টিলা বেয়ে ওপরে উঠতে গেলে মনে পড়ে যায় রাঙ্গামাটির পাহাড় ভ্রমণের স্বাদ। উঁচু টিলায় দাঁড়িয়ে অনেক দূর পর্যন্ত সবুজের মনকাড়া সৌন্দর্যে যে কোন ভ্রমণপিপাসু আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাবেন। শুধু নামেই নয়, রূপগঞ্জের যে রূপ আছে তা এখানে না এলে টের পাওয়া যাবে না। রাজধানীর এয়ারপোর্ট রোড থেকে তিন শ’ ফুট রাস্তা যেখানে এসে মিশেছে, সেখান থেকে মাত্র ২০/২৫ মিনিটের পথ। ডেমরা থেকে মাত্র এক কিলোমিটার এবং মতিঝিল থেকে সাত কিলোমিটার পূর্বে আর রাজধানীর বসুন্ধরা থেকে তিন শ’ ফুট রাস্তা ধরে মাত্র ২০/২৫ মিনিট এলেই অপার সৌন্দর্য আপনার কাছে ধরা দেবে অবলীলায়। ডেমরা সুলতানা কামাল শীতলক্ষ্যা সেতু পেরিয়ে তারাব নোয়াপাড়া এবং রূপসী এলাকা। সেতুর কোলঘেঁষেই অবস্থান ইতিহাস ঐতিহ্যের জামদানি পল্লীর। রাজধানীর খুব কাছের মসলিন শিল্পের স্মৃতি জাগানিয়া এ পল্লীতে অন্তত একবারের জন্য হলেও ঘুরে আসতে পারেন। এখন সেই মসলিন নেই, আছে জামদানি, আছে রূপগঞ্জের রূপ। আর এ রূপ আপনাকে সত্যিই মুগ্ধ করবে। পিকনিক স্পট, মিনি চিড়িয়াখানা, শিল্পকর্ম, স্থাপত্য সবই আছে এখানে। আছে সুসজ্জিত বাহারি ইঞ্জিনচালিত নৌযানে শীতলক্ষ্যা নদী ভ্রমণের সুযোগ। রূপগঞ্জ সদর ইউনিয়নের ‘সরকার বাড়ির টেক’ নামে পরিচিত উঁচুনিচু টিলায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ঘুরতে আসেন ভ্রমণ পিপাসুরা। পিতলগঞ্জ গ্রামের নীলচাষীদের ধ্বংসাবশেষ কুটি বাড়িটিও দেখতে ভোলেন না রূপগঞ্জে ঘুরতে আসা অতিথিরা। মধুখালী এলাকায় মোগলানের টেক, গুতিয়াব এলাকার টিলাগুলোর মনকড়া দৃশ্যে মুগ্ধ হন যে কোন অতিথি। রূপগঞ্জের পূর্বাচলের জিন্দা এলাকায় অগ্রপথিক পল্লী সমিতির (অপস) জিন্দাপার্ক। দুই শ’ বিঘা জমির ওপর গড়ে তোলা হয়েছে বিশাল পার্ক। টিলা আর লেকবেষ্টিত এ পার্কের ভেতরে আছে দ্বি-পুকুর। লেকে নৌকায় চড়ে ভ্রমণের সুযোগ। পার্কের ভেতরেই রয়েছে মার্কেট, সেখানে সব ধরনের কেনাকাটা করতে পারে দর্শনার্থীরা। আছে লাইব্রেরি, ক্যান্টিন, প্রাণিজগত। পার্কের ৫০ ভাগজুড়ে আছে লেক। লেকের পাড়ে ফুলের বাগানে নিরিবিলি চুটিয়ে আড্ডা দেয়ার মতো জায়গা রয়েছে। এখানকার লাভলেক প্রেমিক- প্রেমিকাদের জন্য আকর্ষণীয় স্থান। পুরো পার্কে পুকুর, লেক ছাড়া রয়েছে ঘনসবুজ অরণ্যে ঘেরা ছোটবড় টিলা। পার্কে আছে বাংলো, রেস্টুরেন্ট, দোলনা। আছে সবুজ ঘাসে ঢাকা শিশুদের খেলার মাঠ। লেকে ঘুরে বেড়ানোর জন্য ১০টি নৌকা রয়েছে। আছে চিকিৎসার জন্য ফ্রি ক্লিনিক। শূটিং ও পিকনিকেরও এক অনন্য স্থান জিন্দাপার্ক। তারাব পৌরসভার নোয়াপাড়ার জামদানি পল্লী, কায়েতপাড়ার ওয়াসার জমিতে ঘনবসতি চনপাড়া পল্লী, ফন্ডল্যান্ড পার্ক। ভূলতার মাছুমাবাদের ঐতিহাসিক দিঘী, তিয়াবোর দীঘির পারের দীঘি এবং রঘুরামপুরের দীঘিগুলোও দেখার মতো। তাছাড়াও কায়েতপাড়া এলাকার জাহাজ নির্মাণ শিল্প দেখা যেন কিছু না দেখাকে দেখে নেয়ার অভিজ্ঞতা অর্জন। এখানকার রূপ বৈচিত্র্য সিলেট, রাঙ্গামাটির চেয়ে ভৌগলিকভাবে কম হলেও প্রাকৃতিক দৃষ্টিকোন কোন অংশেই কম নয়।
×