স্টাফ রিপোর্টার ॥ যুদ্ধাপরাধীদের কবরগুলোকে সাধারণ কবরের মতো না দেখে একাত্তরের ঘাতকদের কবর হিসেবে দেখার দাবি জানিয়েছেন শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সন্তানরা। একাত্তরে রাজাকার আলবদররা যাদের নির্মমভাবে খুন করেছিল, তাদের নামের তালিকা ওসব কবরে টাঙ্গিয়ে দেয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা। প্রজন্ম ’৭১ আয়োজিত এক অনুষ্ঠান থেকে এ দাবি জানানো হয়।
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সন্তানদের সংগঠন প্রজন্ম ’৭১-এর রজতজয়ন্তী আজ শনিবার। এ উপলক্ষে একদিন আগে শুক্রবার রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে বিশেষ অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠান উপলক্ষে বীর মুক্তিযোদ্ধা, শহীদজায়া ও শহীদ পরিবারের সদস্যরা একত্রিত হয়েছিলেন। বৃষ্টিবিঘিœত আয়োজনে যোগ দিয়েছিলেন সাধারণ মানুষও। সংগঠনের ২৫ বছর পূর্তির আবেগঘন সময়টি নানা আয়োজনে উদযাপন করা হয়। অলোচনা পর্বে অংশ নিয়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি কর্নেল (অব) শওকত আলী বলেন, মুক্তিযুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি। সোনার বাংলা গড়ার সংগ্রাম চলছে। এ সংগ্রামে আমাদের সঙ্গে আছে শহীদ পরিবারের সন্তানরা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধরে রাখার যুদ্ধে শেষ দিন পর্যন্ত সকলকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান তিনি।
ডাঃ সারওয়ার আলী বলেন, ১৯৭১ সালে বাঙালী জাতিকে মেধাশূন্য করার সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র নিয়ে মাঠে নেমেছিল পাক বাহিনীর দোসররা। রাজাকার আলবদর গোষ্ঠী বুদ্ধিজীবীদের খুঁজে খুঁজে নির্মমভাবে হত্যা করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কিছুকাল এরা আত্মগোপনে ছিল। কিন্তু ’৭৫ পরবর্তী সময়ে আবারও সাপ হয়ে ছোবল দিতে শুরু করে। এ অবস্থায় অপশক্তির বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্মকে নতুন করে যুদ্ধ করতে হয়। প্রজন্ম ’৭১ কে সেই যুদ্ধের অঙ্গীকারবদ্ধ সংগঠন উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখনও স্বাধীনতাবিরোধীরা নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এদের প্রতিহত করতে শহীদ সন্তানদের সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হবে।
মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক হারুন হাবীব বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আজকে গভীরভাবে লক্ষ্য করি, এই ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রামে প্রজন্ম ’৭১ জোরালোভাবে ছিল। এখনও আছে। বাংলাদেশকে সঠিক জায়গায় নিতে হলে গন্তব্যে পৌঁছাতে হলে শহীদ সন্তানদের কাজ করে যেতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক গোলাম কুদ্দুছ স্মৃতিচারণ করে বলেন, রায়েরবাজারে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের আগে ১৯৯২ সালে এখানে জোটের বিজয় উৎসব আয়োজন করা হয়। সেদিন ফয়েজ আহমদের উপস্থিতিতে পিতা হারানোর বেদনার কথা তুলে ধরেন শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. আলীম চৌধুরীর কন্যা নীপা। দেশে তখন স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীরা মন্ত্রী হয়েছে। তাদের গাড়িতে শহীদের রক্তভেজা পতাকা। নীপা দুঃখ করে বলছিলেন, আমার বাবার খুনীরা আমার সামনে দিয়ে পতাকা উড়িয়ে চলে যাচ্ছে। এদের বিচার হচ্ছে না। তিনি বিচার দাবি করেছিলেন। আজ সেই বিচার হয়েছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সরকার শত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করেছে। এতে নীপার কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, শহীদের স্বপ্নের দেশ গড়তে পারলে এ বেদনা সম্পূর্ণ লাঘব হবে।
শহীদজায়াদের পক্ষে বক্তব্য রাখেন শ্যামলী নাসরীন চৌধুরী। গর্ব করেই তিনি বলেন, আমাদের সন্তানদের অনেক চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। এরপরও বাবাদের নীতি আদর্শ থেকে তারা একচুলও বিচ্যুত হয়নি। নীতি আদর্শে অবিচল থেকেছে। সমাজের অনেক কিছুই বদলে গেছে। অনেক মানুষ নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু শহীদের সন্তানরা তাদের পিতামাতার আদর্শ বুকে সযতেœ লালন করে যাচ্ছে। নীতিহীনদের সঙ্গে কোনদিন আপোস করেনি।
প্রজন্ম একাত্তরের সদস্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন শহীদুল্লাহ কায়সারের কন্যা শমী কায়সার। তখন তুমুল বৃষ্টি। এই বৃষ্টির মধ্যেই নিজের দাবি তুলে ধরে তিনি বলেন, কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে। ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। এটা আমাদের জন্য স্বস্তির বিষয়। কিন্তু ঘাতকদের কবরে তাদের সন্তানরা ‘শহীদ’ শব্দটি লিখে দিচ্ছে। এটা ভয়ঙ্কর প্রতারণা। একাত্তরের ঘাতকদের কবরের ফলকে তাদের ঘৃণ্য ইতিহাস লিপিবব্ধ করে রাখার দাবি তার। তিনি বলেন, একাত্তরে তারা যাদের হত্যা করেছে তাদের নামের তালিকা ওসব কবরে টাঙ্গিয়ে দিতে হবে। ইতিহাস বিকৃতি রোধ করতেই এমন উদ্যোগ নেয়া প্রয়াজন বলে মত দেন তিনি।
সাংবাদিক সিরাজউদ্দীন হোসেনের সন্তান তৌহীদ রেজা নূর বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশবিরোধীরা স্বজ্ঞানে আলবদর ও আলশামস বাহিনী গঠন করেছিল। তারা তালিকা করে আমাদের বাবাদের অপহরণ করে নিয়ে যায়। নির্মমভাবে খুন করে। রায়েরবাজার কাঁটাসুরসহ বিভিন্ন জায়গায় শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মরদেহ পাওয়া গেছে। রায়েরবাজারে খুঁজে পাওয়া যায় শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন, ডাঃ আব্দুল আলিম, ডাঃ ফজলে রাব্বির মরদেহ। অসংখ্য গলিত মরদেহের মধ্য থেকে আমাদের কারও কারও বাবার মরদেহ শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। আমার বাবা সিরাজউদ্দীন হোসেন, শমী কায়সারের বাবা শহীদুল্লাহ কায়সার, তন্ময় মুনীরের বাবা মুনীর চৌধুরীর মরদেহ শনাক্ত করা যায়নি। বাবা হারানোর সেই দুঃসহ স্মৃতি এখনও বয়ে চলেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশই আমাদের শেষ আশ্রয়।
এর আগে বিকেলে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। উপস্থিত সকলে একসঙ্গে গানÑ আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি...। এরপর মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। তবে তুমুল বর্ষণের কারণে অনুষ্ঠানের কার্যক্রম মারাত্মক ব্যাহত হয়। সন্ধ্যায় বৃষ্টি কমলে আয়োজন করা হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন ডাঃ নুজহাত চৌধুরী।