ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নুরুল করিম নাসিম

জার্নাল

প্রকাশিত: ০৬:৫৪, ২৮ অক্টোবর ২০১৬

জার্নাল

লাল সালু এমন তো নয় যে, এর আগে যাইনি। এর আগেও বেশ ক’বার গেছি সেখানে। ভাল লেগেছে। অপার্থিব প্রশান্তিতে মন ভরে গেছে। তখন আমার সঙ্গে ছিলেন এই এলাকার একজন কলেজশিক্ষক। আমার গাইড হিসেবে। আগের দিন তিনি টেলিফোন করলেন। এবার একাই গেলাম। এক’ বছরে এই অঞ্চল, এর মানুষজন, এখানকার সংস্কৃতির সঙ্গে অনেকটা পরিচয় হয়েছে। মাথার সিঁথির মতো একটা পাকা সরু সুন্দর পরিচ্ছন্ন রাস্তা চলে গেছে মূল অট্টালিকা পর্যন্ত। চারদিকে সবুজ দীর্ঘকায় গাছপালা। পথের দু’ধারে সবুজের সমারোহ। পথটাকে আলোছায়ার রহস্য ঘিরে রেখেছে। গাছপালা থেকে উঠে আসছে এক ধরনের বনজ গন্ধ। ঠিক সন্ধ্যার আগে আমি পৌঁছলাম। তিনি নিচে ছিলেন। আমি ঢুকলাম তার কক্ষে। বৈঠকখানায় তিনি বললেন, চেয়ারটা টেনে কাছে এসে বসুন। যেন তিনি আমাকে খুব গোপন কোন কথা বলবেন। তারপর অনেক কথা। তিনি একসময় প্রথম দিককার বুয়েটের ছাত্র ছিলেন। তার বাবা মারা যাওয়ার পর তিনি এখন এই বিশাল খানকাশরিফের দায়িত্ব পালন করছেন। আগের দিন টেলিফোন করে ইফতারের দাওয়াত দিয়েছিলেন। তিনি আমাকে দোতলায় নিয়ে গেলেন। সেখানে অনেকগুলো টেবিলে অসংখ্য লোক বসে আছেন। আমাকে তিনি কক্ষের শেষ প্রান্তে নিয়ে এলেন। সেখানে লাইব্রেরি। সম্প্রতি করেছেন। বুকশেলফ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন। বললেন, আপনার গল্পগ্রন্থ ‘যে যায় সে যায়’ এবং উপন্যাস ‘যে শহরে এখন শেষ রাত’ এবং বিশ্ব সাহিত্যের ওপর ৪টি বই রাখা হয়েছে। আমি তখন ভাবছি অন্য কথা। বুকশেলফে পঁচিশ খ- বরীন্দ্র রচনাবলীর পাশে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘১০১ গল্প’, সৈয়দ শামসুল হকের উপন্যাস ‘বালিকার চন্দ্রযান ও অন্যান্য, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের চিলেকোঠার সেপাই ও খোয়াবনামা। অসংখ্য সাম্প্রতিক কিছু ইংরেজী বইও দেখলাম। মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা একটা চমৎকার সংগ্রহ রয়েছে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম তার বাবার মাজারের ওপর লাল গিলাফের ওপর আলো ঝিকিমিক করছে। তিনি একদিন এই অরণ্যঘেরা অজ পাড়াগাঁয়ে ধর্মপ্রচারের জন্য এসেছিলেন। তিনি আজ বেঁচে নেই। তার আধুনিক মনস্ক ছেলে এখন গদিনশিন। তিনি মুক্তমনের মানুষ, শিক্ষিত মানুষ, নিঃস্বার্থ এক সমাজকর্মী সৈয়দ গোলাম মুরসালিন। সুরেশ্বর মাজারের খাদেম। সারা জীবন একাকী এসব কাজ নীরবে করে গেছেন, বিয়ে করেননি। অবসর সময়ে ইংরেজী উপন্যাস ও ধর্মবিষয়ক বই পড়েন। মহাত্মা গান্ধীর অন্যান্য এক্সিপেরিমেন্ট উইথ ট্রুথ অঘ ঊঢচঊজওগঊঘঞ ডওঞঐ ঞজটঞঐ জওহরলাল নেহরুর এখওগচঝঊঝ ঙঋ ডঙজখউ ঐওঝঞঙজণ. মূল গ্রন্থ এবং বাংলা অনুবাদও শোভা পাচ্ছে তার এই গ্রন্থাগারে। কবি কায়সুল হক চলে গেলেন কবি ও সম্পাদক কায়সুল হক এই পৃথিবী থেকে নীরবে চলে গেলেন। তাকে প্রথম দেখি বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউর জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের একটি অনুষ্ঠানে সত্তর দশকের শেষের দিকে। অনেক বছর পর বেক্সিমকো ধানম-ি থেকে ‘শৈলী’ নামে একটি পাক্ষিক সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করা শুরু করে। কুয়াতইল ইসলাম ছিলেন তার একান্ত সহযোগী এবং সম্ভবত সহ-সম্পাদক। তখন আজকের মতো এত সাহিত্য পত্রিকা ছিল না। বেসরকারী উদ্যোগে এবং কবি কায়সুল হকের সুসম্পাদনায় পত্রিকাটি অল্প সময়ে বেশ পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছিল। সেখানে দূরের হাওয়া শিরোনামে পূর্ণপৃষ্ঠার একটি বিশ্বসাহিত্য বিষয়ক কলাম আমাকে নিয়মিত লিখতে হতো। এর বাইরে কোন কোন বিশেষ সংখ্যায় গল্প, প্রবন্ধ ও ভ্রমণ কাহিনীও লিখেছি। সবটাই কায়সুল ভাইয়ের অনুপ্রেরণায়। আজ এ রকম সম্পাদক হাতেগোনা দু’একজন ছাড়া আর তেমন কাউকে বাংলাদেশে খুঁজে পাওয়া যায় না। কবি কায়সুল হককে তখনই আমার জানার সুযোগ হয়। সেই সময়ে আমি গ্রীন রোডের একটি বাসায় সপরিবারে ভাড়া থাকি। মা ও অন্য ভাইয়েরা থাকেন নারিন্দার বেগমগঞ্জ লেনের আমাদের নিজেদের বাড়িতে। একদিন বিকেলে কায়সুল ভাই কুয়াতইল ইসলামকে নিয়ে আমার বাসায় এসে হাজির। ড্রইংরুমে ঢুকেই বললেন, নাসিম কফি খাওয়াও। সেদিন কফি খেতে খেতে বেশ ক’ঘণ্টা তুমুল আড্ডা হয়েছিল। তিনি কলকাতার কবি ও কথাসাহিত্যিকদের কথা বললেন। কলকাতার পত্রপত্রিকার গল্প বললেন। কথা প্রসঙ্গে রশীদ করিম, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, মোস্তফা নূরউল ইসলাম, আবু রুশদ এবং শামসুর রাহমানের কথা এলো। আজ একমাত্র মোস্তফা নূরউল ইসলাম ছাড়া আর কেউ বেঁচে নেই। কারও সম্পর্কে তিনি কটু মন্তব্য করেননি, কোন পরচর্চাও করেননি। সে সব লেখক ও তাদের লেখা বিষয়ে তিনি সেদিন অবিশ্রান্ত যে কথা, যে স্মৃতিচিত্র তুলে ধরেছিলেন তা রেকর্ড করে রাখলে, কিংবা নোটপ্যাডে টুকে রাখলে একটি চমৎকার লেখা তৈরি করা যেত। কবি কায়সুল হক ছিলেন প্রচারবিমুখ। তার হাত দিয়ে তৈরি হয়েছে আজকের অনেক কবি-সাহিত্যিক। বেঁচে থাকতে তার মূল্যায়ন হয়নি। মৃত্যুর পরে তাকে নিয়ে হাতেগোনা কয়েকটি দৈনিকের সাহিত্য সাময়িকী পাতায় দায়সারা গোছের লেখা ছাপা হয়েছে। কিন্তু যারা তাকে গভীরভাবে জানেন, যারা তাকে খুব কাছে থেকে দেখেছেন, তাদের লেখা আমাদের চোখে পড়েনি। দৈনিক পত্রিকার কিংবা মাসিক সাহিত্য-পত্রিকার সম্পাদকরা ইচ্ছে করলে তাঁকে নিয়ে বিশেষ আয়োজন করতে পারতেন, কিন্তু তা করেননি। আমাদের দেশের অসংখ্য চ্যানেল কবি ও সম্পাদক কায়সুল হককে নিয়ে চমৎকার সব অনুষ্ঠান সাজাতে পারত। আজকের দর্শকরা একটি সময়, একজন কবি, একজন সম্পাদককে সেইসব অনুষ্ঠানে খুঁজে পেতেন। জাতি হিসেবে আমরা খুব অকৃতজ্ঞ। তিনি বেঁচে থাকতে আমরা তাকে প্রাপ্য সম্মান দিতে পারিনি। মৃত্যুর পরে কি তাকে আমরা তার প্রত্যাশিত সম্মানটুকু দিতে পারব?
×