ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ইলিয়াস বাবর

জীবনানন্দের সময়ের কাছে

প্রকাশিত: ০৬:৫৩, ২৮ অক্টোবর ২০১৬

জীবনানন্দের সময়ের কাছে

‘কেন লিখি’তে জীবনানন্দ দাশ আমাদের জানান- ‘কিন্তু তবুও কবিতার উপর বাস্তবিক কোন ভার নেই। কারও নির্দেশ পালন করার রীতি নেই কবি মানসের ভেতর, কিংবা তার সৃষ্ট কবিতায়। অথচ সৎ কবিতা খোলাখুলিভাবে নয়, কিন্তু নিজের স্বচ্ছন্দ সমগ্রতার উৎকর্ষে শোষিত মানবজীবনের কবিতা, সেই জীবনের বিপ্লবের ও তৎপরবর্তী শ্রেষ্ঠতর সময়ের কবিতা। মহৎ কবির ভাবনা সূক্ষ্ম, হৃদয় আন্তরিক (আশা করা যেতে পারে), অভিজ্ঞতা সজাগ, ও চেতনা অবচেতনা ঐকান্তিকভাবে সক্রিয় থাকার দরুন ব্যবহারিক পৃথিবীতে এ রকম মানুষের কাছ থেকে জীবনের উন্নতিশীল ভাঙা-গড়ার কাজে শুভ ও সার্থক আত্মনিয়োগ দাবি করা যেতে পারে। কিন্তু প্রায়ই দেখা যায় কবিতা ও শিল্পসৃষ্টির ভেতরেই তিনি ঢের বেশি স্বাভাবিক ও স্মরণীয়- এমনকি অধিকতর মহৎ, বাস্তব কার্যক্ষেত্রে তেমন নয়।’ কথাটি খুব আধ্যাত্মিক শোনালেও মানুষ পৃথিবীতে আসে নির্দিষ্ট সময়ের সমষ্টি নিয়ে। পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে সময়ের সঠিক ব্যবহারের ব্যাপারে দারুণ সব কথাবার্তাও লেখা আছে। অথচ আমরা- যাচ্ছেতাই সময়ের অপচয়ে জীবনের আয়ু শেষে খসে পড়ি পৃথিবীর বাগান থেকে। মানুষ হিসেবে মরে যাই, মানব হওয়ার কোন ইচ্ছেই যেন বাসনা করি না! জীবনানন্দ দাশ ‘সময়ের কাছে’ কবিতায় মানুষের দিনলিপিই যেন আঁকেন তার রাজকীয় ভাষায়, স্পোর্জিত কাব্যচারিত্রে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়- ‘চিত্ররূপময়’ তো আছেই; আছে ইতিহাসের প্রতি সুবিচার এবং ইতিবাচকতায় মোড়া উদ্দীপক। ‘হাজার বছরের বাংলা কবিতা’য় যেমন দেখি- ‘জীবনানন্দ দাশের কবিতার প্রকরণের প্রধান বৈশিষ্ট্য গদ্যগন্ধ শব্দের ব্যবহারে কবিতার শরীরকে এক মায়ামুগ্ধ রূপে উপস্থাপন। ... বলা চলে তিরিশের দশকের কবিদের মধ্যে একমাত্র জীবনানন্দ দাশের কবিতাই সন্ধান দেয় গভীর থেকে গভীরতর মননের যাত্রী হওয়ার। তাঁর কবিতাই বাংলা কবিতাকে দিয়েছে নতুন পথের সন্ধান।’ বাংলা কবিতাকে নতুন পথের সন্ধান জীবনানন্দের সমগ্র কবিতাজুড়েই আছে। আমরা তার বিপুল ও বৈচিত্র্যময় কবিতা-বাগান থেকে কেবল ‘সময়ের কাছে’ কবিতাটিকেই নতুনভাবে পাঠ করতে পারি। এটাও তো সত্য সাহিত্যিক মান ধরে রাখা কবিতাগুলো বার বার পাঠে পুরনো হয় না বরং অন্তর্গত সৌন্দর্যে ছড়িয়ে যায় আগের বোধ, পূর্বাকার অভিজ্ঞতা। কবিতাটি শুরু হয়েছে এভাবেই- ‘সময়ের কাছে এসে সাক্ষ্য দিয়ে চলে যেতে হয়/কি কাজ করেছি আর কি কথা ভেবেছি/সেইসব একদিন হয়ত বা কোন এক সমুদ্রের পারে/আজকের পরিচিত কোন নীল আভায় পাহাড়ে/অন্ধকারে হাড়কঙ্করের মতো শুয়ে।’ কিছুই থাকে না একসময়; পুরনো চীনের মৃত্যুর পর ফিরে আসে নতুন চীন, তারও বিলয় হয় আপন নিয়মে এবং মানুষেরই শ্রমে-ঘামে জেগে উঠে নতুনতর চীন। বিশ্বাসী হোক আর অবিশ্বাসী- মৃত্যুর নিমন্ত্রণ কি আর কেউ ঠেকাতে পারে? কিন্তু মৃত্যুর পরেও কীভাবে জীবন্ত এবং শক্তিমান থাকা যায় তার দিকেই যেন জীবনানন্দের অন্বিষ্ট। যে কবিতাকে অপার্থিব বলে ধরে নেই প্রিন্টিংপ্রেসে তাও লুপ্ত হয় অথচ পেছনে পেছনে আসে ‘সমাপ্তিহীন ক্ষুধা’। মানুষের পাওয়া, না-পাওয়ার এক জীবনে আমরা দেখি সৃষ্টির আনন্দ, হারানোর বেদনা। তবুও হেমন্তের ফসল হয়ে আগামীর মানুষের কঙ্কাল; মানে নতুনের প্রতিনিধি হওয়ার সৌভাগ্যকে বরণ করে নিতে চায় কবি। আর নিজের পরিচয় ঘোষণা দেন এভাবে- ‘যারা সব পেয়ে গেছে তাদের উচ্ছিষ্ট/যারা কিছু পায় নাই তাদের জঞ্জাল;/আমি এই সব।’ জীবনানন্দের প্রথম দিককার কাব্যযাত্রায় নজরুলের প্রভাব স্বীকার করেও আমরা জীবনানন্দের অনন্য কাব্যভাষায় শুনি তারুণ্যের জয়গান। আশ্চর্য সব প্রতীক এবং উপমা আলোচ্য কবির কবিতায় ছড়িয়ে দিয়ে তিনি বলে যান আলোর কথা; ‘ডোডো পাখি’র কথা নয়! যুগসচেতনতা ও কাললিপ্ততা জীবনানন্দের কবিতার অন্যতম বৈভব এবং বিভা। তিনি কবিতার ধ্যানে ছাড়িয়ে যান অগ্রজ কবিদের ভাবনা-সীমা এবং অনুজদের জন্য রেখে যান অপার-উজ্জ্বল উদাহরণ। হয়ত এ কারণেই বাংলা কবিতার তরুণতর কর্মীদের উপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেন; বলা চলে মধুর বানে আচ্ছন্ন করেন জীবনানন্দই। এবং নিজের কবিতায় নিজের সার্বভৌমত্ব ও স্বাতন্ত্রবোধ ঘোষণা দেন- ‘সকলের মাঝে বসে/আমার নিজের মুদ্রাদোষে?/আমি একা হতেছি আলাদা?’ কবুল করতেই হয় জীবনানন্দের এ-একা থাকা হয়ে উঠে না তারই কাব্যগুণে; এ ব-দ্বীপে জীবনানন্দকেই অনুকরণ-অনুসরণ করে হাজার কবিতাকর্মী তবুও চূড়ান্ত অন্বেষণে তিনি একা থাকেন না? অবশ্যই। আর জেগে থাকে সাম্যবাদের চিন্তা। ‘মানবিকতার ভোর’ ডেকে আনতে কামনা করেন ‘এঞ্জেলো রুশো লেনিনের মনের পৃথিবী।’ এবং আঘাত- ‘সপ্রতিভ আঘাতের’ বিনিময়ে ‘অগ্রসর সূর্যলোক’ ফিরে চান কবি সামষ্টিক কল্যাণলাভে। রোমান্টিকতা ও ইতিহাসচেতনার সমন্বয়ে জীবনানন্দ আমাদের পর্যটন করান দ্রোহের সাগরে। সরাসরি নয়, একটু আড়াল রেখে- ইতিহাসেরই উপাদানে ভরে আমরা ‘সময়ের কাছে’ কবিতায় জেনে যাই জীবনানন্দের পূর্বাপর ইতিহাস-জ্ঞানের তথ্য এবং নির্জনতার ভেতরেও যে দ্রোহের তাবিজ বেছে দেন তারই প্রমাণ। পৃথিবীব্যাপী হাহাকার, রক্ত-রক্ত খেলা, মৃত্যুশব্দ সব কালিমা ঝেড়ে ফেলে ‘মানবিক জাতীয় মিলন’ ‘মানুষের চেতনার দিন’ বার বার ব্যক্ত করেন কবি। শেষপর্যন্ত বলেই দেন চূড়ান্ত পরিণতির চিত্র- ‘জয় অস্তসূর্য, জয়, অলখ অরুনোদয় জয়।’ বন্ধ্যা সময়ে, বিশেষত কুটিলতায় ভরা বাধাগ্রস্ত প্রগতির উল্লাস, নগ্ন সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, বলপ্রয়োগের অপচিন্তা- সব মিলিয়ে যাবতীয় নেতিবাচকতাকে বিদায় দিয়ে জীবনানন্দ মানুষের হয়েই কথা বলেন কবিতার শরীরজুড়ে। তিনি ভালই জানতেন মিথ্যার ফুলঝুরিই সবচেয়ে আকর্ষণীয় হয়। সবচেয়ে দামী হয় পতিত মানুষই! কত বছর আগে কবি বলেন- ‘যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা/যাদের হৃদয়ে প্রেম নেই- প্রীতি নেই- করুণার আলোড়ন নেই/পৃথিবী অচল তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।’ যে জীবনানন্দ জীবদ্দশায় কবি হিসেবে দাম পান না নিজ স্ত্রীর কাছে; সম্পাদক বরাবর অনুনয়মাখা চিঠি লিখতেন কবিতা ছাপাতে- তার অমন উজ্জ্বল পঙ্ক্তিগুলোর সত্যতা এবং শক্তি তো আমাদের চোখেরই সামনে আজ দৃশ্যমান! মনেপ্রাণে তিনি কবি; বোধের পরিপক্বতা না আসলে কেউ-ই এমন করে লিখতে পারেন না তার জাতিরই পরবর্তী ইহিতাস! তিনি জীবনানন্দ; তিনি মহত্তম কবি বলেই এটি সম্ভব হয়েছে। জীবনানন্দ দাশ সবচেয়ে বেশি পঠিত এবং জনপ্রিয় কবি বাংলাভাষায়। কিন্তু আমরা তার সমাজচিন্তা ও তৎসময়ের এ-দেশীয় বাস্তবতা, সামাজিক-রাজনৈতিক দৃশ্যের দিকে নজর দেব না, তা কী করে হয়? তিরিশে বিরাজমান ক্ষুধা-হাহাকার কিংবা স্বদেশ-চিন্তায় নিমগ্নতা সবটাই তো তার কবিতায় পাই দারুণভাবে। আমাদের সাহিত্যাকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্রদের নিয়েও হুজুগে চর্চাকে স্মরণ করে দিতেই ক্লিন্টন সিলি ‘এ্যাপোয়েট এ্যাপার্ট’ রচনা করেন? কিংবা তার জীবনানন্দ নিয়েই পিইচডি ডিগ্রী নেয়া? বুদ্ধদেব বসু, ভূমেন্দ্র গুহ, আবদুল মান্নান সৈয়দ, গোপালচন্দ্র রায়, হরিশংকর জলদাশ, ফারুক মঈনউদ্দীন প্রমুখ লেখকের জীবননান্দ-গবেষণা আমাদের আশার আলো দেখায় এবং আরও বেশি; আমাদেরই নমস্য সাহিত্যিকদের নিয়ে কাজ করার প্রেরণাই দেন। এর মাধ্যমে কি শুধুমাত্র একজন সাহিত্যিকই উঠে আসেন? তার সময়ের স্বদেশ, বিশেষ দিক এবং মানসচিন্তার গভীরেও ডুব দেয়ার সুযোগ আসে নতুনতর গবেষণায়। জীবনানন্দ দাশ নিজেও তার সময়ের অনেক কবি নিয়ে লিখেছেন এমনকি বিশ^সাহিত্যের খ্যাতিমান অনেক কবি নিয়েও তার মূল্যবান গদ্য লক্ষ্য করি আমরা। আশার কথা জীবনানন্দের কবিতা নিয়ে তো বটেই গদ্য নিয়েও কাজ হচ্ছে এখন এবং তা উন্নত মান বজায় রেখেই; এক্ষেত্রে গল্পকার সাহিত্যপত্রিকার সম্পাদক মাসউদ আহমাদের নাম আমরা অনায়াসেই নিতে পারি। আমাদের প্রয়োজনেই আমার নিবিড় পাঠ নেব জীবনানন্দের; অন্যান্য মহৎ সাহিত্যিকদেরও। ‘সময়ের কাছে’ কবিতাটি খুব দীর্ঘ নয় অথচ ‘নতুন তরঙ্গে রৌদ্রে বিপ্লবে মিলন সূর্যে মানবিক রণ’ বলে জীবনানন্দ আমাদের ঝিমিয়ে পড়া মানবিক সত্তাটিকেই যেন জাগিয়ে দেন। ‘মিলন সূর্যে মানবিক রণ’ সৃষ্টি করার জন্য তরুণ প্রজন্মকে অবশ্যই পাঠ নিতে হবে জীবনানন্দ। আলোচ্য কবিতাতেই আমরা স্বাভাবিকভাবে লক্ষ্য করি- কবির চোখ সাম্যবাদের দিকে; ইতিহাসের উপাদান থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনের দিকে যাওয়ার প্রেরণা রেখে যান আমাদের জন্য; সবসময় নিজেকে সময়ের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর যে শুভপ্রয়াস আমরা আলোচ্য কবিতায় দেখি তাও অনন্যসুন্দর এক ব্যাপার বটে। এ রকম আরও অনেক কবিতা আমরা জীবনানন্দের কবিতা-ভুবনে পাব তবে ‘সময়ের কাছে’ কবিতাতেই বোধহয় তিনি তরুণের জয়ও জেগে উঠাকে শৈল্পিকভাবে বাসনা করেন। এ কবিতার ভেতর দিয়েই কি তিনি তার পূর্বেকার কাব্যভঙ্গিটিও বদলে নেন একটু করে! তাও জাতি হিসেবে আমাদের হুজুগিপনা আর আলস্যপ্রিয়তাকে স্মরণে রেখে! আমরা জীবনানন্দ দাশের কবিতা সেইসঙ্গে গদ্যভা-ারেও ঘুরে আসব আমাদেরই ঘুম ভাাঙানোর জন্য, মানবিক মানুষ আর মানবিক রণ উদ্বোধনের জন্য। তবে কবিতা দিয়েই শুরু হোক গেড়েবসা আঁধার তাড়ানোর আলোকজ্জ্বল সম্ভাবনা।
×