ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সাদিক ইসলাম

শব্দ ও ভাষা

প্রকাশিত: ০৬:৫১, ২৮ অক্টোবর ২০১৬

শব্দ ও ভাষা

ভাষা একটি প্রবহমান ধারা। ভাষা পরিবর্তনশীল। নদীর জল ধারার মতো চলার পথে যা পায় তাই গ্রহণ করে ফেলে যায় পুরনোকে। সেই ভাষাই টিকে থাকে যে ভাষা অন্য ভাষা থেকে, পরিবর্তনশীল সময় থেকে নতুন শব্দ গ্রহণ করে এর কলেবর বাড়াতে পারে ও পারিপার্শ্বিক অন্য সব বিষয়কে ধারণ করতে পারে। ইংরেজী ভাষা আজ যেখানে এসেছে তাতে একে অনেক বড় পথ অতিক্রম করতে হয়েছে। পাঁচ শ’ অব্দে যখন ব্রিটেন জর্মনরা- এ্যাংলো, স্যাক্সন ও জুটসরা ইংল্যান্ড দখল করে নিল তখন ইংরেজী ভাষা সেই জর্মন থেকে প্রচুর শব্দ নিয়ে আরও প্রাণবন্ত হলো। এরপরে ইংরেজী ভাষা রোমান, ফ্রেঞ্চ ও স্প্যানিশ ভাষা থেকে এত বেশি শব্দ গ্রহণ করল যে এটি; কালের পরিক্রমায় একটি একেবারে নতুন ও শক্তিশালী ভাষা হিসেবে দাঁড়িয়ে গেল। এটি এখনও থেমে নেই ইংরেজী ভাষা প্রতিনিয়ত বদলাচ্ছে তা ব্রিটেনে বা আমেরিকায় দুটি দেশেই সমান তালে এবং নতুন অনেক শব্দ তৈরি হচ্ছে প্রতিনিয়ত তা ছাড়াও ইংরেজীতে আত্মীকৃত হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে নানা শব্দ। ইংরেজীকে বলা যায় এর বর্ধিষ্ণু স্বভাবের কারণে পৃথিবীর সবচেয়ে জীবন্ত ভাষা। যেমন এটি বাংলা থেকে ও এই উপমহাদেশ থেকেও অনেক শব্দ গ্রহণ করে চলছে। ইংরেজীতে ঘেরাও (মযবৎধড়), গুরু (মঁৎঁ), প-িত বা পা-িত (ঢ়ঁহফরঃ), মুঘল (সঁমযধষ) ইত্যাদি শব্দের আত্মীকৃত ঘটে এই উপমহাদেশ থেকে এই শতাব্দীতেই। এ ছাড়াও ব্রিটিশরা কলোনিয়াল যুগে যখন সমগ্র বিশ্ব শাসন করতে শুরু করল তখন তারা যেমন পৃথিবীর অনেক প্রান্তে তাদের নিজস্ব ভাষা রফতানি করল তেমনি ইংরেজীও সমগ্র বিশ্ব থেকে নানা ধরনের ভাষার সমন্বয় ঘটাল নিজ ভাষায়। আরবী, ইংরেজী, বাংলা ভাষা কালের পরিক্রমায় আরও শক্তিশালী হচ্ছে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কারণে আবার আমরা জানি প্রায় প্রতিদিন পৃথিবী থেকে একটি দুটি ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। সুমেরীয়, এলামাইট, এট্রুস্কান, ক্রীট দ্বীপের প্রাচীন ও সমৃদ্ধ ভাষা আজ আর টিকে নেই। আর ইংরেজী ভাষা নিয়ে মজার একটা কথা বলতে হয়- প্রশ্ন হচ্ছে ইংরেজী কোন দেশের ভাষা ব্রিটেন না আমেরিকার? আসলে ইংরেজী বর্তমানে ব্রিটেন বা আমেরিকার কোন দেশের ভাষাই নয় এটি আজ বিশ্বায়নের ভাষা। কারণ ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় যত না লোক ইংরেজী ভাষায় কথা বলে তার চেয়ে বাকি বিশ্ব বেশি ইংরেজী ব্যবহার করছে। শুধু এক ভারতে ব্রিটেন ও আমেরিকার মোট জনগোষ্ঠীর চেয়ে বেশি লোক কথা বলে ইংরেজীতে। তাই ইংরেজী ভাষার নিয়ন্ত্রণ এখন আর আমেরিকা বা ইংল্যান্ডের নেই যদিও ভাষাটি তাদেরই কাছে সংরক্ষিত। প্রায় প্রতিটি ভাষার চারটি স্তর থাকে যেমন ঋড়ৎসধষ (আনুষ্ঠানিক), ওহভড়ৎসধষ (অনানুষ্ঠানিক), ঈড়ষষড়য়ঁরধষ (কথোপকথনের) ও ঝষধহম (অশিষ্ট) ভাষা। যেমন বন্ধু হচ্ছে আনুষ্ঠানিক ভাষা আবার দোস্ত হচ্ছে অনানুষ্ঠানিক এবং যদি কেউ কারও বন্ধুকে কিরে ব্যাটা! বা কিরে মামা! বলে সম্বোধন করে তবে তা কথোপকথনের বা কিছুটা অশিষ্ট ভাষার কাছাকাছি রূপ নেয়। ব্রিটিশ ইংরেজীতে আমরা আনুষ্ঠানিক ভাষার প্রতি ঝোঁকটা দেখি বেশি আর আমেরিকানরা অনেক ফরমাল বা আনুষ্ঠানিক ক্ষেত্রেও কথোপকথনের ভাষা ব্যবহার করে। ধীরে ধীরে আমেরিকায় এমনকি আনুষ্ঠানিক পরিবেশেও অনানুষ্ঠানিক ভাষার ব্যবহার করতে দেখা যাচ্ছে। অশিষ্ট ভাষার ব্যবহার আমারিকান শুধু মুভিতে নয় প্রাত্যহিক জীবনে ব্যবহার করা একটা ফ্যাশান হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে ভাষার সৃষ্টি কিভাবে হলো ব্যাপারটি যেমন জটিল এর ব্যাকরণ বা গ্রামার সৃষ্টিটা ততটা জটিল নয়। আপাত বিশৃঙ্খল শব্দগুলোকে জানবার, পড়বার, শৃঙ্খলাভুক্ত করবার ও পাঠকের জন্য উপযোগী করে তুলবার প্রয়াস থেকে ব্যাকরণের সৃষ্টি। ব্যাকরণ কি সমস্ত ভাষাকে ধারণ করতে পারে? আসলে তা ব্যাকরণের পক্ষে সম্ভব নয় তবে এটি ভাষাকে সুষমা দান করে; ভাষাকে শিখবার একটা কলাকৌশল শেখায় ও বিরাট শব্দ ভা-ারকে একটা ধারায় নিয়ে আসে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে; তাই শব্দও যেমন পরিবর্তনশীল ব্যাকরণও তেমনি পরিবর্তনশীল হতে পারে সময়ের দাবিতে। শুধু একটা দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে বিভিন্ন নিত্যনতুন আধুনিক যন্ত্র ও গ্যাজেটের উদ্ভাবনের ফলে নতুন শব্দের উৎপত্তি ঘটছে এই শব্দগুলো এক শ’ বছর আগে হয়ত ছিল না। আর আমরা যেমন নতুন তৈরি পণ্যকে তা হোক আমেরিকা বা ইউরোপে গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছি তেমনি এদের নাম বা শব্দটিকেও ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছি। সারা বিশ্বে সাধারণত মোবাইল ফোন হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়। যদিও আমাদের দেশে এর একটি নাম মুঠোফোন দেয়া হয়েছে তা কিঞ্চিত মাত্র সাহিত্যেই সীমাবদ্ধ। কম্পিউটার ও মোবাইল এগুলো সাম্প্রতিক বহুল ব্যবহৃত আধুনিক আবিষ্কার। এগুলো তৈরি হওয়ার পাশাপাশি নতুন অনেক শব্দও ভাষার ভেতর ঢুকে পড়েছে। যেমন অন্যদিকে কম্পিউটারের কথাই ধরা যাক আমরা এর যুতসই কোন বাংলা সমার্থক শব্দ এখনও তৈরি করিনি- হয়ত একে গণনা যন্ত্র বলা যায় কিন্তু তা এখন গ্রহণযোগ্যতা পাবে কিনা তাতে সন্দেহ রয়ে গেছে। কম্পিউটার আসার পর এটাকে ব্যবহারকেন্দ্রিক অনেক নতুন শব্দের সৃষ্টি হয়েছে যা একেবারে আনকোরা। অনেক পুরানো শব্দকে নতুন অর্থ দিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে তবে নতুন শব্দ সৃষ্টিই হয়েছে বেশি। যেমন পুরনো ডাটা থেকে এসেছে ডাটাবেজ, এমনি অনেক পুরনো শব্দ কম্পিউটারের বেলায় অন্য অর্থ নিয়ে ব্যবহৃত হচ্ছে যেমন রিনক, মিডিয়া, কী, মাদারবোর্ড, নেটওয়ার্ক, পেজ, ওপেন সাইট ইত্যাদি। হ্যাকার যখন কম্পিউটারের ক্ষেত্রে ব্যবহার করি অন্য ব্যঞ্জনার হ্যাকার বোঝায়। ডেস্ক ও টপ যুক্ত হয়ে নতুন শব্দ তৈরি হয়েছে ডেস্কটপ। আবার এ্যাক্রোবেট, ডাউনলোড, জাভা, ফায়ারওয়াল, এইচটিটিপি, নেটস্কেপ, স্পাম ইত্যাদি একেবারে নতুন কিছু শব্দের জন্ম দিয়েছে। তাহলে আমরা এই অত্যাধুনিক যুগের কথা যদি চিন্তা করি যেখানে প্রতিদিন আধুনিক যান্ত্রিক ও বৈজ্ঞানিক সভ্যতা বিজ্ঞানের আরও লাখ লাখ আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে অনেক নতুন শব্দ আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে এক করে দিচ্ছে সেগুলোও ভাষায় পরিবর্তন নিয়ে আসছে। পৃথিবীর চলমান ভাষাগুলোর মধ্যে যেগুলো এখনও টিকে আছে এগুলো হলো কেলটিক, ইটালিক, জর্মনিক, আলবেনিয়ান, আর্মেনীয়, তুখরিয়ান, বারটোস্লাভিক, গ্রিক ও ইন্দো-ইরানীয় ভাষাগুলো। এগুলোর সবগুলোর মূল উৎস ধরা হয় ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাকে। আর ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার সূত্রপাত পৃথিবীর কোন অঞ্চলে তা নিয়ে কেউ শক্ত কোন প্রমাণ দিতে পারেনি। তবে অনেকের মতে এটির সূত্রপাত এশিয়ার মধ্য অঞ্চলে- আমরা যদি ভাবি এটি আমাদের আশপাশ থেকে বা আমাদের দেশ থেকেই উৎপত্তি লাভ করেছে তাতেও কোন মতবিরোধ করার মতো কেউ নেই। কারণ যে সংস্কৃত ভাষা থেকে এর উৎপত্তি তার সঙ্গে বাংলা ভাষার অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। তবে ভারতীয় উপমহাদেশের সংস্কৃত ভাষা থেকে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার সূত্রপাতের একটা প্রমাণ দেয়া যেতে পারে। বাবা অর্থে পিঁতে শব্দটি সংস্কৃত কেউ কেউ বলে কালের যাত্রায় এটি এশিয়া থেকে ইউরোপে গিয়ে পিউতর রূপ ধারণ করে আর এর আরও পরে ইংরেজরা এই পিউতর থেকে ইংরেজীতে ফাদার (ঋধঃযবৎ) এই শব্দটির প্রচলন করে; তবে কি সংস্কৃত ভাষাই পৃথিবীর আদি ভাষা এবং অন্যান্য ভাষার উৎপত্তি স্থল? তা হলে আমরা বলতে পারি আমাদের এ অঞ্চল থেকে কথোপকথনের জন্য ভাষার সৃষ্টি? আপাত বিরোধপূর্ণ বিষয়টি হয়ত এক সময় জানা যাবে। এক সময় যে এই ভারতীয় উপমহাদেশ জ্ঞান চর্চার এক উর্বর ক্ষেত্র ছিল তা জ্যোতির্বিজ্ঞান থেকে জানা যায়। আকাশে উত্তরম-লে তারার যে ম-লীর মাঝে সপ্তর্ষিম-ল (ধ্রুব তারাকে কেন্দ্র করে ঘোরে) এর অবস্থান তা এই উপমহাদেশের সাতজন ঋষির (ক্রতু, পুলহ, পুলস্ত্য, অত্রি, অঙ্গিরা, বশিষ্ঠ, মরীচি) নামেই হয়েছিল দ্বিতীয় শতকে টলেমি আবিষ্কার করার অনেক পূর্বেই আমাদের এই অঞ্চলের জ্যোতির্বিবদরা এই তারকা ম-লী আবিষ্কার করেন। তাই পৃথিবীর ভাষাগত ব্যাকরণের শুরু যে আমাদের এখান থেকে বা এই অঞ্চল থেকে হতে পারে সেটিও অনুমানযোগ্য কারণ পুলহ এই ঋষি ও জ্যোতির্বিদ ভাষাগত ব্যাপারে যথেষ্ট দক্ষ ছিলেন তা অতীন্দ্র মজুমদারের ভাষা তত্ত্ব বইটি থেকে জানা যায়। আবার আমরা যদি ইংরেজী ব্যাকরণ, প্রবাদ, প্রবচন ইত্যাদি লক্ষ্য করি তবে দেখতে পারব এ দুটোর মাঝে ব্যাপকহারে গঠনগত মিল রয়েছে। পদ, কাল, ক্রিয়ার ও বিশেষণের ব্যবহার, কারক, সমন্ধ পদের ব্যবহারে ইংরেজী ও বাংলা ব্যাকরণের অনেক সাদৃশ্য বিদ্যমান যা চিনা ব্যাকরণের সঙ্গে বাংলা ব্যাকরণের নেই; তাই ইংরেজী ও বাংলা ব্যাকরণ যে আরেকটিকে অনুসরণ করেছে বা এদের মূল বা উৎস যে এক তা বোঝাই যায়। আর্যরা ইরান দিয়ে এই উপমহাদেশে প্রবেশ করে এবং তারা এখানকার ভাষা আত্মসাত করে নতুন ভাষার সৃষ্টি করে ও তা প্রচলিত হতে থাকে। বেদ ভাষায় রচিত ঋক্বেদ আর্যদের এক অনবদ্য লেখনী তা অবশ্যই এই এলাকার ভাষা দিয়ে প্রভাবিত ছিল- ম্যাক্স মূলার এটি ইংরেজীতে অনুবাদ করেন- তার ভাষায় ‘মানুষ পাঠ্য ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাচীনতম বই হচ্ছে এই ঋক্বেদ।’ মূলার অনুবাদ করার হাজার বছর আগে যে এই ঋক্বেদ প-িতরা ইউরোপে নিয়ে যায়নি তা কি কেউ হলফ করে বলতে পারবে? কিন্তু এটা সত্য যে ভাষা কোন নির্দিষ্ট স্থানে বদ্ধ হয়ে থাকার বিষয় নয় মানুষও যেমন সঞ্চারণশীল তেমনি ভাষাও সঞ্চারণশীল। ভাষা একটি মিশ্ররূপ কালে কালে তা পরিবর্তিত হয় এর সঙ্গে মিশ্রণ ঘটে নানা ভাষার নানা শব্দের। ঐতিহাসিকভাবে জানা যায় দ্রাবিড় উপজাতি বাংলা নামে পূর্বাঞ্চলে বসবাস করত সেখান থেকে যে ভাষার জন্ম পরবর্তীতে তা হয়ত বাংলা ভাষা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে; মূলত মানুষের ইতিহাসের সঙ্গে ভাষার ইতিহাসও জানা কঠিন। মাগধী, সংস্কৃত, পালি ইত্যাদি ভাষা যেমন আমাদের উপমহাদেশের প্রাচীনতম রূপ তা বলা যায় এমনিভাবে সব অঞ্চলের ভাষার একটা পরিবর্তনশীল ধারা আছে যেটি থেকে এটি আধুনিক রূপ ধারণ করে। বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে ভাষার পরিবর্তনটা ভীষণই দ্রুত। ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পর থেকে কি ইংরেজী ভাষার বিস্তার লাভ আমরা বন্ধ করতে পেরেছি? কিংবা তা যে একটা ভাষার জন্য সম্ভব বা সমীচীন নয় তা আমরা উপলব্দি করতে পারি। ভাষা শুধু এক বিশেষ জাতি গোষ্ঠী এক স্থান থেকে এক স্থানে নিয়ে আসে না ব্যবসা, বাণিজ্য, সাহিত্য, শিক্ষা, পড়াশোনা, শিল্প ইত্যাদি নানা বিষয় ভাষাকে এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে ছড়িয়ে দেয়। আবার একটা জাতির ভাষা শুধু তার নিজের ভাষা নয় এটি কোন না কোন উপায়ে অন্য ভাষাকে প্রভাবিত করবে; কারণ আমরা কি সীমানা দিয়ে ভাষাকে আটকে রাখতে পারি? সময়ের পরিক্রমায় মিশ্রণ ঘটে ঘটে ভাষা একটা নির্দিষ্ট স্থানে দাঁড়ায়। কখন কোন কারণে একটি বা অনেক ভাষা থেকে নতুন একটি ভাষার ব্যুৎপত্তি লাভ ঘটবে তা বলা মুশকিল। যেমন বিশ্বায়ন ইংরেজী কথ্য ভাষাকে একটি সমরূপতা দান করছে আর এটি ঘটছে অন্তর্জাল বা ইন্টারনেটের কারণে। ইন্টারনেটে আমরা যদি ফেসবুকের বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কথাই চিন্তা করি আমরা লক্ষ্য করব এখানে শত শত দেশের কোটি কোটি মানুষের সমাগম ঘটছে। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দুটি ভিন্ন দেশের যোগাযোগের একমাত্র ভাষা ইংরেজী। তাই এখানে একটা ইংরেজী ভাষার ব্যবহার হচ্ছে যা দিয়ে ভিন্নভাষী বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠী একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। এর ফলে ইংরেজী বিভিন্ন ভাষাভাষী লোকের মাধ্যমে মিথষ্ক্রিয়ায় পুরো বা খাঁটি ইংরেজী নয় এমন এক নতুন ভাষার জন্ম দিচ্ছে যা শুধু এই নেট ব্যবহারকারীরাই বুঝতে পারে এটি না থাকছে ইংরেজী না অন্য ভাষা- ইংরেজীর মাঝে অনেক আরবী, বাংলা, নাইজিরিয়ান, ফরাসী ও অন্যান্য দেশের ভাষা ঢুকে পড়ে নতুন এক ইংরেজী ভাষার সৃষ্টি করছে। যদিও এটি তথ্য আদান প্রদান, ভাব বিনিময়ের এক কথ্য ভাষা তবু যেহেতু এটি প্রচুর সংখ্যক জনগোষ্ঠী ব্যবহার করছে তাই এটি একটি ফেসবুকিয় ইংরেজী হয়ে যাচ্ছে। একদিন হয়ত এটিও ভাষা হিসেবে স্থান করে নেবে নয়ত মূল ইংরেজীতে এর প্রভাব ফেলবে। যেমন ‘লিনডা’ মানে সুন্দর এটি জার্মান-আলবেনিয়ান ভাষা কিন্তু ফেসবুকের কল্যাণে এটি এখন পৃথিবীর সবার কাছে পরিচিত ও বহুল ব্যবহৃত একটি শব্দ হয়ে গেছে এবং ইংরেজী ভাষায় প্রবেশ করেছে। এমনিভাবে আরও হাজার হাজার নানা-দেশী শব্দ ইংরেজীতে ও অন্যান্য ভাষায় প্রবেশ করছে ফেসবুক বা এমন আরও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম দ্বারাও এভাবে নতুন একটি ইংরেজী ভাষা বিকশিত হচ্ছে। আরেকটি বিষয় যা গুরুত্বপূর্ণ ইন্টারনেট ছাড়াও ব্যবসা, বাণিজ্য, শিক্ষা, সাংস্কৃতিক, অফিসিয়াল অনেক কারণে ইংরেজী বর্তমান বিশ্বে যোগাযোগের একমাত্র ভাষা হিসেবে মর্যাদা লাভ করেছে; কিন্তু এখানেও তা দ্রুত পরিবর্তন লাভ করছে বিভিন্ন ভাষার সঙ্গে মিথষ্ক্রিয়া করে এটি একটি একরৈখিক বা সমরূপতা (টহরভড়ৎসরঃু) লাভ করছে তাই ব্রিটিশ বা আমেরিকান ইংরেজী নয় মজা করে বলা হয় একটা ব্যাড ইংরেজী (ইধফ ঊহমষরংয) ভাষাই একসময় বিশ্বায়নের যোগাযোগের একমাত্র ভাষা হিসেবে দাঁড়িয়ে যাবে। নীরবে ও পরোক্ষভাবে বাংলা ভাষাতেও বিশেষ করে ইংরেজী ভাষা বিরাটভাবে এর প্রভাব বিস্তার করেছে ও করছে। যেমনটি করেছিল সরাসরি কলোনিয়াল যুগে; তখন মানুষ ইংরেজী ব্যবহার করত আভিজাত্য দেখাতে; এমনিভাবে এটি ধীরে ধীরে সাধারণ্যে ছড়িয়ে যায়। এ ছাড়াও যা আগে বলা হয়েছে দাফতরিক কারণেও ইংরেজী বহুলভাবে আমাদের ভাষায় প্রবেশ করেছে। এটি খারাপ কী মন্দ তা বিষয় নয় এ ব্যাপারে দ্বিমত থাকতে পারে তবে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন যে ভাষা ও অন্য ভাষা থেকে যত বেশি গ্রহণ করতে পারবে সে ভাষাই টিকে থাকবে। তাই বাংলা ভাষা যে ইংরেজী, আরবী, ফারসী, পর্তুগিজ, জাপানি, বার্মিজ ভাষা থেকে অনেক শব্দ গ্রহণ করেছে তা আমাদের ভাষার দুর্বল দিক নয় শক্তিশালী দিকের ইঙ্গিত দেয়। এক সময় ইউরোপিয়ানরা আমাদের থেকে ব্যাকরণ শিখেছে আজ যে শব্দগুলো দিচ্ছে তা আমাদেরই প্রাচীন দানের পরিশোধ নয় কি? চেয়ার, টেবিল, কম্পিউটার, ডাইনিং রুম, ড্রয়িং রুমের বাংলা করা এখন প্রয়োজনীয়তার মধ্যে পড়ে না কারণ এগুলো এখন বাংলাই হয়ে গেছে; যেমনভাবে ইদানীং দিনকালে হাজার হাজার ইংরেজী শব্দ বাংলা হয়ে যাচ্ছে। আমরা প্রতিবছর ক্যাম্ব্রিজ ও আমেরিকান ডিকশোনারিগুলোতে অনেক নতুন শব্দের সংযোজন দেখি; সময় এসেছে আমাদের বহুল ব্যবহৃত ও আপামর জনগোষ্ঠী যে বাইরে থেকে আসা শব্দগুলো ব্যবহার করছে; বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে রিক্সাওয়ালা পর্যন্ত; তা বাংলা ভাষার অন্তর্গত করে নেয়ার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কোন রিক্রা চালককে যদি বলা হয় বিশ্ববিদ্যালয় যাবা সে বোঝে না কারণ ভার্সিটি শব্দটির সঙ্গে সে বেশি পরিচিত। টায়ার্ড কথাটি অনেক ধান কাটা কৃষককে বলতে শোনা যায় বা ভ্যান গাড়িওয়ালাকে আবার গ্রামের মেয়ে তার বান্ধবীকে বলে তাড়াতাড়ি রেডি হয়া আইসো; প্রস্তুত শব্দটি তার কাছে এখানে অনেক বেশি কঠিন। এমনিভাবে বাংলা কথোপকথনে জার্নি, গেস্ট, ডিরেকশন, ট্রাই, ইউজ, ইউজফুল, এক্রপেরিয়েনস, স্পিড, ফাইন, নাইস, এক্রপার্ট, এনজয়, রেডি, এ্যালার্ট, ফল্ট, পে (টাকা পে করা) রিস্কি, রিস্ক, কমান্ড, কোয়ালিটি, রাফ, চেঞ্জ, টাইম, স্মার্ট, গুড, রাইট, হেভি, লোড, ওয়ে, রাইটার, রিসেন্টলি, কুইকলি, ফাস্ট, হিউজ, উইক (দুর্বল), স্ট্রং, ফাইট এনার্জি ইত্যাদি শত শত বা হাজার হাজার শব্দ আমজনতার ভাষা হয়ে গেছে তাই এগুলোকে বাংলা ভাষায় একীভূত করে নেয়া বর্তমান টাইমের ডিমান্ড।
×