ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

প্রতি মাসে স্বামীর হাতে খুন ১৬ নারী

প্রকাশিত: ০৬:৪৫, ২৮ অক্টোবর ২০১৬

প্রতি মাসে স্বামীর হাতে খুন ১৬ নারী

প্রতিদিনই পত্রিকার পাতা উল্টালে নজরে পড়ে কোন না কোন হত্যা, আত্মহত্যা কিংবা অস্বাভাবিক মৃত্যুর মতো অনেক দুর্ঘটনা। দলীয় কোন্দলে হত্যাযজ্ঞ, ব্যক্তিগত শত্রুতার প্রাণসংহার, সহায়-সম্পত্তির বিরোধ বিবাদের কারণে প্রাণটা কেড়ে নেয়ার দুর্ঘটনা সব সময়ই আমাদের সামনে স্পষ্ট হচ্ছে প্রচার মাধ্যমের কল্যাণে। অসহায় এবং দুর্বল অংশ হিসেবে নারীদের ওপর এ ধরনের নৃশংসতার আঁচড়ও হরহামেশাই ঘটে যাচ্ছে। সম্প্রতি গণমাধ্যমের এসব তথ্য দিয়ে বিশেষ করে নারীদের ওপর বিভিন্ন ধরনের বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞের এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। জাতীয় ১২টি দৈনিক পত্রিকার সংবাদকে অবলম্বন করে সংগঠনটি নারী নির্যাতনের ওপর বিশেষ তথ্য প্রদান করে। ‘জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর’ পর্যন্ত ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনের সংখ্যাগত প্রতিবেদন’-এ তুলে ধরা হয়েছে মাসে ১৬ জন নারী খুন হন স্বামীর হাতে। এই সমীক্ষায় আরও দেখানো হয় চলতি বছরে প্রথম নয় মাসে ১৪৯ জন স্ত্রীকে খুন করে স্বামী। যার মাসিক গড় হয় ১৬। এতে আরও উঠে আসে শুধু স্বামীর হতেই নয়, শ্বশুরবাড়ির অন্য সদস্যদের হাতেও নারীরা হত্যাযজ্ঞের বলি হচ্ছে। এমন নারীর সংখ্যা মাসে ৩৪ জন। তার ওপর আছে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যার মতো মৃত্যু ঝুঁকিতে প্ররোচিত হচ্ছে যার সংখ্যা মাসে প্রায়ই ৩৯ জন। এই প্রতিবেদনটি এটাই স্পষ্ট করে আজও মেয়েরা ঘরে বাইরে কোথাও নিরাপদ নয়। ঘরে স্বামী-সংসারের অসহনীয় জ্বালা যন্ত্রণা আর বাইরে বখাটের উৎপাত সব মিলিয়ে নারী জাতির সামনে এক মহাবিপদ সঙ্কেত। কোন কারণে স্বামীর পছন্দমতো চলতে না পারলে স্ত্রীর ওপর যে ধরনের হামলা হয় তা যেমন স্ত্রীর ওপর যে ধরনের হামলা হয় তা যেমন বর্বরোচিত একইভাবে মানবতাবিবর্জিত। স্ত্রীর বাপের বাড়ি থেকে টাকা আনা, স্বামীর বাপের বাড়ি থেকে টাকা আনা, স্বামীর পরকীয়ায় বাধা দেয়া কিংবা নেশাগ্রস্ত স্বামীর ইচ্ছের বিরুদ্ধে যাওয়া এসব মিলিয়েই চলে গৃহবধূটির ওপর নৃশংস অত্যাচার। স্বামীর হাতে স্ত্রীর নিগৃহের ঘটনা তো একেবারে স্বাভাবিক। বাড়তি পাওনা হিসেবে জোটে শ্বশুর, শাশুড়ি, ননদ আর ভাসুর-দেবরের অমানুষিক-মানসিক আর শারীরিক পীড়ন আর ঘরের বাইরে মোকাবেলা করতে হয়। উন্মত্ত, বেপরোয়া, উদ্ধৃত যুবকদের অশ্লীল বাক্যবাণ থেকে শুরু করে হরেক রকমের নিপীড়ন। এখানেও এসব বিভ্রান্ত, বখাটে যুবকদের মতের বিরুদ্ধে গেলেই উপর্যুপরি চাপাতির আঘাত। কারও বা সাক্ষাত মৃত্যু কেউবা জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যায়। নারীদের ওপর এ ধরনের পাশবিক নির্মমতার ঘটনা আর কতদূর পর্যন্ত চলবে সে জবাব কারোরই জানা নেই। সমাজের অর্ধাংশ নারী জাতির অনেকেই এই নির্মম পরিস্থিতির শিকার। সমাজই নির্ধারণ করে কোন নাগরিকের সুস্থ এবং স্বাভাবিক চলার পথ। আর শ্রেণীবিভক্ত সমাজে অসহায় এবং নির্বিত্ত গোষ্ঠীরাই হয় সব থেকে অবহেলিত এবং নির্যাতিত। দুর্বল অংশ হিসেবে নারী জাতির ওপর এই দায় ভাগ বর্তায় অনেক বেশি। ধর্মীয় বিভাজনের কারণে ‘সংখ্যালঘু’ প্রত্যয়টি যে কত অযৌক্তিক এবং অবান্তর তা বলে শেষ করা যাবে না। এই অনাকাক্সিক্ষত শব্দটিও মানুষে মানুষে বৈষম্য তৈরি করে, সহজ মিলনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় যা এক ধরনের মানসিক নির্যাতনেরই নামান্তর। একটি সুস্থ, স্বাভাবিক সমাজ ব্যবস্থা দেশের সামগ্রিক জনগোষ্ঠীর জীবনধারাকে যদি সঠিক পথে চালিত করতে না পারে, নানা মাত্রিক অত্যাচার, নিপীড়ন যদি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো থাকে তাহলে বুঝতে হবে পুরো ব্যবস্থার ভেতরেই অসংহত কোন অপসংস্কার এমন শক্তভাবে গ্রথিত হয়ে আছে যার শেকড় উপড়ে না ফেললে সমাজ ঠিক পথে চলবে না। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আসবে, রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন জোরদার হবে, সাংস্কৃতিক অঙ্গন ও মোটামুটি তার ধারা অব্যাহত রাখবে কিন্তু সমাজে গ্রথিত কিছু পশ্চাৎপদ মূল্যবোধ মানুষকে তার মৌলিক অধিকার নিয়ে বাঁচার পথে বিঘœ সৃষ্টি করবে। এসব অপসংস্কার, পুরনো বিধি-নিষেধকে ভাঙতে না পারলে সব মানুষকে তার যথার্থ মর্যাদা এবং স্বাধীনতা দেয়া সম্ভব হবে না। শ্রেণীবিভাজন সমাজে নারী-পুরুষ সবাই কম-বেশি অসাম্য বৈষম্যের শিকার। সেখান থেকে বেরুতে না পারলে কারও জীবনই সুস্থির এবং সহজ পথে এগিয়ে যাবে না। সুতরাং প্রত্যেকের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সমাজের এমন দুর্ভেদ্য নিয়মনীতি যা কোনভাবেই মানুষের উপকারে আসে না তাকে সাহসের সঙ্গে অতিক্রম করতে হবে, প্রয়োজনে আঘাত করে ভাঙতে হবে। সমাজ সভ্যতা আর মানবিকতার সঙ্গে একান্ত নিবিড় মূল্যবোধকে জাগিয়ে তুলতে হবে, শাণিত করতে হবে যার মাধ্যমে এসব অপ্রতিরোধ্য বাধা সমূলে বিনাশ হবে। মানুষ তার স্বাধীনতা এবং সম্মান নিয়ে বাঁচার সাহস পাবে।
×