ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রেজওয়ানা আলী তনিমা

‘সুলতানার স্বপ্ন’, কল্পনা ও বাস্তবতা

প্রকাশিত: ০৬:৪৪, ২৮ অক্টোবর ২০১৬

‘সুলতানার স্বপ্ন’, কল্পনা ও বাস্তবতা

সুলতানা একরাতে তার শয়নকক্ষে বসে ছিল। অচেনা এক নারী তার কাছে এসে ভ্রমণের আহ্বান জানালে সে সাড়া দিয়ে বাইরে আসে এবং বিমূঢ় বিস্ময়ে আবিষ্কার করে সে আর তার পরিচিত জায়গায় নয় বরং নারীস্থানে অবস্থান করছে। এখানে নারীরা মুক্ত স্বাধীন, পুরুষরাই আবদ্ধ। আনন্দভরা ভ্রমণের মাঝে একসময় ছন্দপতন ঘটে, সুলতানা ফের নিজেকে শয্যাকক্ষে আবিষ্কার করে। এও বুঝতে পারে যে এতক্ষণ যা কিছু সে দেখছিল সবই স্বপ্নমাত্র। বাস্তবে সে এখনও জেনানার অন্তঃপুরিকা উন্মুক্ত সূর্যালোকের জগত যার জন্য নিষিদ্ধ। এটিই মহীয়সী রোকেয়া রচিত ‘সুলতানার স্বপ্ন’র গল্পকাহিনী। বেগম রোকেয়ার সম্পর্কে নতুন করে পরিচয় দেবার কিছুই নেই। নারীজাগরণের অগ্রদূত, নারীশিক্ষার পথপ্রদর্শক এসব উপমার আড়ালে তাঁর লেখা হয়েছে তাঁর সমাজসংস্কারের বাহন। তুলনামূলকভাবে সাহিত্যমূল্য, রচনার অভিনবত্ব অনেকটা আড়ালচাপা পড়েছে। ‘সুলতানার স্বপ্ন’ গল্পটি নারী আন্দোলনের দিকটি ছাড়াও আরও অনেকভাবে পর্যালোচনার দাবি রাখলেও তা নারীর নারীবাদী রচনা- এই বৃত্তের খোলসে বন্দী থেকে গেছে। যে যুগে মেয়েরা মাতৃভাষা বাংলা শিক্ষাই পেত না সে যুগেই চোস্ত ইংরেজীতে রচিত গল্পটিতে একটি শান্তিবাদ পরিলক্ষিত হয়- যুদ্ধ না, যুক্তি-বিদ্যা-বুদ্ধিই নারীস্থানের প্রেরণা। বিশ্বাস আর ভালবাসার মানবধর্মই মূলমন্ত্র। সামাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক সময়ের রোকেয়ার সে রাষ্ট্রচেতনা এখনকার অস্থির পৃথিবীতেও ভীষণ কাক্সিক্ষত। আধুনিক রাষ্ট্রগুলোর দিকে তাকালেও দেখি এখন মারণাস্ত্রের সক্ষমতা না বরং জ্ঞানের উৎকর্ষই শ্রেষ্ঠতার পরিচয়বাহক। ‘সুলতানার স্বপ্ন’ একটি প্রথমশ্রেণীর সায়েন্স ফিকশনও। মহৎ সাহিত্য শুধু সমাজ জাগরুক নয়, দূরদর্শীও বটে। তা যুগে যুগে মানুষকে অভাবিত সব আবিষ্কারে প্রচ্ছন্ন প্রেরণা দিয়েছে যা সচেতনভাবে ভাবতে সে সাহস পায় না। কালদর্শী দক্ষতায় শব্দে ভাষা পেয়েছে অমোঘ ভবিষ্যদ্বাণী যা পরে বাস্তবে পরিণত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ ১৯৬৮ সালে কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যিক আর্থার সি ক্লার্কের লেখা ‘২০০১: এ স্পেস ওডিসি’র- গ্যাজেটের কথা বলা যায়। এর মতো যন্ত্র আইপ্যাড বাজারে আসে ২০১০ সালে। এজন্যই হয়ত আইনস্টাইনও কল্পনার কাছে তার ঋণ স্বীকার করেছেন ‘কল্পনা জ্ঞানের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। জ্ঞান সীমাবদ্ধ, কল্পনা অসীম।’ ১৯০৫ সালে যখন বিদ্যুতবাতিই সবখানে পৌঁছায়নি তখনই রোকেয়া গল্পে একটি বিদ্যুত ও সৌরশক্তিনির্ভর রাষ্ট্রের কথা বলেছেন, কয়লা গ্যাস ফুরিয়ে যাবার আশঙ্কায় যে সৌরশক্তির দিকে আমরা এখন ঝুঁকছি। খ্রিস্টপূর্ব ২১২ সালে আর্কিমিডিসের সূর্যশক্তিকে দর্পণের সাহায্যে কেন্দ্রীভূত করে শত্রুকে ছত্রভঙ্গ করার গল্প কথিত আছে, যেটা অতিসম্প্রতি আসলেই কার্যকর সম্ভব প্রমাণিতও হয়েছে সেটিও প্রথাগত শিক্ষাহীন রোকেয়ার এ গল্পে এসেছে! এসেছে গোটা দেশকে একটি বৃহৎ বাগানে রূপ দেয়ার আইডিয়া যখন আরবান-ফার্মিংয়ের নামও কেউ শোনেনি, এমনকি জলবায়ু পরিবর্তন সমস্যা অধুনা হলেও সেকালে বসেই পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির কথা লিখেছেন তিনি। সবশেষে আবার ফিরে আসি নারীনত্রী রোকেয়ার কাছে। তাঁর লেখনী প্রথমতই নারীঅধিকার আদায়ের হাতিয়ার। লেখা দিয়েও যে বিপ্লবকে ছড়িয়ে দেয়া যায় তার প্রমাণ কার্ল মার্কস ও ফ্রেডেরিক এ্যাঙ্গেলসের ‘দি কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’। বেগম রোকেয়া নিজ গ-িতে উপমহাদেশীয় নারী আন্দোলনে অনন্য ব্যক্তিত্ব, যথাযথ চর্চা হলে বৈশ্বিক পর্যায়েও তাঁর নামটি উচ্চারিত হতে পারত। ‘সুলতানার স্বপ্ন’ গল্পটিতে নারীপ্রগতির পক্ষে ক্ষুরধার যুক্তির প্রয়োগ রয়েছে। পেশীশক্তির দাপটে পুরুষ নারীকে অবদমিত রাখতে চায়। এর বিরুদ্ধে তিনি লিখেছেন, সিংহ মানুষের চেয়ে বেশি শক্তিশালী, হাতির মস্তিষ্ক মানুষের চেয়ে বড় ও ভারি কিন্তু মানুষই তো সৃষ্টির সেরা। স্যাটায়ারিক্যাল নারী আধিপত্যের ফ্যান্টাসী হলেও গল্পে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে নারী ও পুরুষ উভয়েই বৃহৎ মানব সমাজের অংশ, লিঙ্গনির্বিশেষে মেধা মননের প্রয়োগ যাদের শ্রেষ্ঠত্বের আসল চাবিকাঠি। প্রাপ্য প্রচার না পাওয়া রোকেয়ার ক্লাসিক রচনাগুলো সম্পর্কে এখনকার পড়ুয়ারা কি ভাবছেন? বই বিষয়ক ওয়েবসাইট গুডরিডসে রিম নামের একজন লিখেছেন, এটা কেমন করে সম্ভব যে এমন একটি রচনা তেমন পাদপ্রদীপের আলোয় আসল না? ১৯০৫ সালে যখন নারীশিক্ষার কোন ব্যবস্থা ছিল না তখন নারী লিখিত সায়েন্সফিকশন তাও ইংরেজীতে সত্যি বিস্ময়কর, নারীর বিরুদ্ধে শোষণের প্রতিবাদে সার্থক গল্পটি ছোট হলেও শক্তিশালী। দীর্ঘ রিভিউয়ের শেষে তিনি আরও যোগ করেন, বেগম রোকেরার আরো অনেক স্বীকৃতি পাওয়া উচিত ছিল এবং এই গল্পটি আমি আরবিতে অনুবাদ করব। বস্তুত লক্ষ্য করলে দেখি, ‘সুলতানার স্বপ্নে’র কথক সুলতানা আসলে রোকেয়া নিজেই যে ভারত নারীর অবস্থান নিয়ে ভাবিত। মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েডীয় তত্ত্বানুসারে তাঁর অবচেতন অবদমিত মুক্তির ইচ্ছাই অবিশ্বাস্য দুঃসাহসী স্বপ্নের মোড়কে সত্যি হয়ে উঠেছে। এই নতুন শতকে বসে প্রশ্ন জাগে, তাঁর সেই জীবনব্যাপী সাধনার কতটুকু বাস্তব হয়েছে? এখন নারীরা প্রধানমন্ত্রী থেকে ট্রাফিক পুলিশ পর্যন্ত হচ্ছেন কিন্তু এখনও তো নিতু, রিশারা প্রাণ দিচ্ছে। এখনও ভারতে গণধর্ষণের শিকার জ্যোতি সিং-এর এক ধর্ষক সাফাই দেয়, মেয়েদেরই দোষ, তাদেরই ঘরের ভেতরে থাকা উচিত ছিল। এই অবস্থায় সুলতানার স্বপ্নের অচেনা নারীর উক্তি আমাদের বিবেক হয়ে তাড়া দেয়, যদি ক্ষতিকর মানসিক অসুস্থ কি হিংস্র পশুকে রুদ্ধ করে রাখা হয় তাহলে নারীলোলুপ নরপশুরা কেন মুক্ত থাকবে? এখনও যখন বখাটেদের উৎপাতে নির্যাতিতা নারীর পরিবারই সামাজিক বদনামের ভয়ে নিশ্চুপ থাকে তখন ‘সুলতানার স্বপ্ন’ দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখনও প্রাসঙ্গিক।
×