ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

এনামুল হক

উদ্ভিদ কেন ছদ্মবেশ নেয়

প্রকাশিত: ০৬:৪০, ২৮ অক্টোবর ২০১৬

উদ্ভিদ কেন ছদ্মবেশ নেয়

উদ্ভিদ মাত্রই এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকে। ওগুলোকে দেখতেও সুন্দর লাগে- কোনটা বেশি সুন্দর, কোনটি বা কম। অন্তত আমাদের এমনই লাগার কথা। কিন্তু আমরা হয়ত অনেকেই জানি না যে, কিছু কিছু অর্কিড ও অন্যান্য উদ্ভিদ শিল্পীর মতো। এরা নানা রূপ ধারণ করতে পারে। কোনটি কীটপতঙ্গের রূপ কোনটি জীবজন্তুর রূপ আবার কোনটি বিষ্ঠা ও অন্যান্য রূপও ধারণ করতে পারে। এমন ছদ্মবেশ ধারণের উদ্দেশ্য বিবিধ- কোন কোন ক্ষেত্রে নিজেদের ক্ষুধার্ত তৃণভোজীদের হাত থেকে রক্ষা করা আবার কোন ক্ষেত্রে পরাগায়নে সাহায্য করে নিজেদের বীজ ছড়িয়ে দেয়া। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে কোন কোন উদ্ভিদ তুখোর নকলবাজ এবং কেন? অর্কিড কে না ভালবাসে। কিন্তু শুধু মানুষই নয় অনেক কীটপতঙ্গও সত্যি সত্যি অর্কিডকে ভালবাসে। কীটপতঙ্গর অর্কিডের প্রতি এমন আকর্ষণের কারণ ছদ্মবেশ! এরিজোনার উদ্ভিদবিজ্ঞানী ক্যাটি প্রুডিক কিছু কিছু হ্যামার অর্কিড পরাগায়নের কাজে যেভাবে শোলতাদের প্রলুব্ধ করে তার জন্য সেগুলোর সরাসরি নাম দিয়েছেন ফাঁদ বা ফাঁস। এই জাতের অর্কিডদের একটা প্রধান পাপড়ি থাকে সেটাকে দেখতে লাগে থাইনাইন গোত্রের স্ত্রী জাতের শোলতার মতো এবং তা থেকে শোলতার যৌনদ্দীপক ঘ্রাণ নির্গত হয়। পুরুষ জাতের শোলতারা তখন আক্ষরিক ও আলঙ্কারিক উভয় অর্থেই কথিত স্ত্রী শোলতাকে তুলে নেয়ার জন্য সেখানে ছুটে আসে। তাদের মনে কোন রকম সন্দেহ জাগে না। পুরুষ শোলতার আগমন মাত্র স্ত্রী শোলতার রূপ ধারণ করা পাপড়িটি উর্ধমুখী ধাবিত হয়ে পুরুষ শোলতাকে হাতুড়ির ঘা মারার মতো করে ফুলের সেই অংশে ঠেলে দেয় যেখানে রয়েছে পরাগ। পরাগে মাখামাখি হয়ে পুরুষ শোলতা পরের অর্কিডের কাছে চলে যায় এবং এভাবে অর্কিডের প্রজননের কাজটা করে দেয়। অস্ট্রেলিয়ার ফ্লাইং ডাক অর্কিডগুলোও একই রকম কৌশলী। উত্তর ইউরোপে এক জাতের অর্কিড আছে। নাম ফ্লাই অর্কিড। ফুলটি দেখতে স্ত্রী জাতের ফিল্ড ডিগার শোলতার সুন্দর পৃষ্ঠদেশের মতো। তা দেখে পুরুষ শোলতা স্ত্রী শোলতার সঙ্গে মিলিত হওয়ার চেষ্টায় পুলের কাছে আকর্ষিত হয়ে ছুটে আসে। অস্ট্রেলিয়ায় বার্ড অর্কিড নামে আরেক জাতের অর্কিড আছে। উদ্ভিদ তাত্ত্বিক নাম চিলোগ্লোটিস রিফ্লেক্স। এরও শোলতার মতো চেহারা ও ঘ্রাণ আছে। তবে কৌশলের দিক দিয়ে এরা আরও এক কাঠি সরেস। এক জাতের স্ত্রী শোলতার কোন পাখনা থাকে না এবং তারা মাটির কাছাকাছিই থেকে পুরুষদের আকৃষ্ট করার জন্য ফেরোমোন নামে যৌনদ্দীপক ঘ্রাণ ছাড়ে। এদের কারণে বার্ড অর্কিডও মাটিতে জন্মে। এক গবেষণায় দেখা গেছে বার্ড অর্কিডদের মাটি থেকে ওপরে জন্মানো হলে তারা পুরুষদের আকর্ষিত করতে পারে না। কারণ সম্ভবত এই যে পুরুষ শোলতারা জানে স্ত্রী শোলতা কখনও উড়তে পারে না। তবে অর্কিড বা ফুলেরাই যে শুধু ছলাকলার আশ্রয় নিয়ে প্রতারিত করে তা নয়। কিছু কিছু মাল্টিস আছে দেখতে অর্কিডের মতো। প্রুডিক জানিয়েছেন যে কামনার ফুল ভাইস উভয় আমেরিকায় জন্মে। এর পাতায় হলদে রঙের ছোট ছোট দাগ বা বিন্দু থাকে যা দেখতে এই ফুলের প্রধান শিকারি হেলিকোনিয়াস প্রজাপতির ডিমের মতো। এই বিন্দুগুলোকে নিজেদের ডিম বলে ভ্রম করে স্ত্রী প্রজাপতি ওই ফুলের পাতায় ডিম পাড়তে বসে না। এক স্ত্রী প্রজাপতি যেখানে ডিম পেরেছে অন্য স্ত্রী প্রজাপতি সেখানে ডিম পাড়তে বসে না। ফলে ওখানে প্রজাপতির ডিম থেকে শুয়াপোকাও হয় না এবং এভাবে চতুর ফুলগাছটি নিজেকে শুয়াপোকার হাত থেকে রক্ষা করে। বলাবাহুল্য, এসব শুয়াপোকা বেশ কচমচ করে ওই ফুলগাছের পাতা খেয়ে থাকে। দক্ষিণ আফ্রিকায় কেপ রেসটিও নামে এক লতা গাছ আছে যার বীজ এন্টিলোপের বিষ্ঠার মতো। এই দেখে ডাং বিটলস পোকারা সেখানে আকৃষ্ট হয় এবং তাদের মাধ্যমে বীজ এক জায়গা থেকে নতুন এক জায়গায় স্থানান্তরিত হয়। প্রুডিক আরও জানিয়েছেন যে দক্ষিণ-পশ্চিম আমেরিকায় ওয়াটসনস পাইপভাইন ফুলের কোন কোনটি আকার ও রূপে ইঁদুরের কানের রূপ ধারণ করে এবং এক ধরনের বাসি পুরনো গন্ধ বিকিরণ করে। উদ্দেশ্য বেলেমাছির দ্বারা নিজেদের পরাগায়ন ঘটানো। বেলেমাছিরা রক্তচোষা হয়ে থাকে। পাইপভাইন ফুলের শিরাবহুল ইঁদুরের কাপের মতো টিউব দেখে তারা ইঁদুরের কান ভেবেই তা থেকে রক্ত চুষে খাবার লোভে গুটি গুটি পায়ে ঢোকে এবং সারা রাতের জন্য সেখানে আটকা পড়ে থাকে। পরদিন সকালেই কেবল তারা ছাড়া পায়। কিন্তু ততক্ষণে তাদের সারা গা পরাগে ছেয়ে গেছে। এভাবেই ফুলগাছটির পরাগায়ন ও বংশবিস্তার ঘটে। সূত্র : ন্যাশনাল জিওগ্রাফি
×