ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

কোথাও দৈনিক, কোথাও মাসিক ভিত্তিতে ভাড়া নিচ্ছে প্রভাবশালীদের লোকজন

ফুটপাথ দখল করে ব্যবসা ॥ সড়কে গ্যারেজ, গাড়ি মেরামত

প্রকাশিত: ০৬:০৫, ২৮ অক্টোবর ২০১৬

ফুটপাথ দখল করে ব্যবসা ॥ সড়কে গ্যারেজ, গাড়ি মেরামত

আরাফাত মুন্না ॥ আশির দশকের বাংলা সিনেমা দেখলে যে কেউ বলবেন আহ ঢাকা। সেই চিত্রের সঙ্গে বর্তমানকে মেলালে হতাশ মানুষ একটা কথাই বলবেন- কি ছিল আর কি হয়েছে! গত দুই দশকে রাজধানী ঢাকার আয়তন বাড়ার তুলনায় মানুষ বেড়েছে অনেক। স্বল্প আয়তনে বিপুল জনগোষ্ঠীর বসবাসের ফলে সৃষ্টি হচ্ছে নানান নাগরিক সমস্যার। নাগরিকদের সুবিধার্থে নেয়া অনেক উদ্যোগেই সুফল মিলছে না। বরং অভিশাপ হয়ে উঠছে। ধরা যাক ঢাকার ফুটপাথের কথা। কোথাও কি এই ফুটপাথে মানুষের পা পড়ার সুযোগ আছে? অলিগলিতে চায়ের দোকান আর বড় রাস্তার পাশে হকারদের হরেক মালের পসরা। মানুষ হাঁটবে জায়গা কোথায়? নগরবাসীর দুর্ভোগের তালিকায় প্রতিদিন যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন নাম। অনেক দুর্ভোগ লাঘবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ চেষ্টাও চালান। দু’চারদিনের জন্য পরিত্রাণও মেলে। কিন্তু সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতেই আবার সেই পুরনো চিত্র। রাজধানীর ফুটপাথ দখলে এ দুর্ভোগ যেন আরও তীব্র হয়েছে। যানজটে নাকাল রাজধানীবাসী হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছাতে চাইলেও তা পারছেন না। পথচারীদের ফুটপাথ দখল করে ব্যবসা করছেন প্রভাবশালীরা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ফুটপাথগুলোতে যারা ব্যবসা করছেন তাদেরও ওই জায়গার ভাড়া দিতে হচ্ছে। কোথাও দৈনিক বা কোথাও মাসিক ভিত্তিতে। দৈনিক বাংলা মোড় থেকে পল্টন মোড় পর্যন্ত যানজট দেখে বাস থেকে নেমে হেঁটে যাচ্ছিলেন সিদ্দিকুর রহমান নামের এক ব্যক্তি। কথা বলে জানা গেল তিনি ব্যবসায়ী। সিদ্দিকুর জনকণ্ঠকে বলেন, পুরো রাস্তায় যানজট। ফুটপাথ দিয়ে যে হেঁটে যাব তারও কোন পরিস্থিতি নেই। রাজধানীর ফুটপাথগুলোর বেশির ভাগই নানাভাবে বেদখল হয়ে গেছে। আরেক পথচারী রাজু বেপারী বলেন, ফুটপাথ এখন দখলদারদের হাতে। রাস্তার দু’পাশে যে সমস্ত ফুটপাথ আছে তা বর্তমানে হকারদের দখলে, তাদের দোকানে সারাদিন ভিড় লেগে থাকে। যার ফলে পথচারীদের হাঁটার কোন সুযোগ নেই। আর এসব ফুটপাথ দখল হয়ে যাওয়ার কারণে বেশিরভাগ পথচারীই রাস্তায় দিয়ে হেঁটে যায়, ফলে সারাদিন যানজট লেগে থাকে। সরেজমিন দেখা গেছে, কেবল ফুটপাথ নয়, রাস্তার প্রায় পুরোটাই হকারদের দখলে। ফল মূল, শাক-সবজি শাড়ি-চুড়ি কি নেই! ধাক্কা খেতে খেতে এর মধ্যেই চলতে হচ্ছে পথচারীদের। মঙ্গলবার গুলিস্তান এলাকা ঘুরে দেখা যায়, স্টেডিয়াম প্রান্ত থেকে ফুলবাড়িয়া এলাকার সংযোগ সড়কগুলো সম্ভব সব উপায়ে দখল করা হয়েছে। কয়েকটি সড়কে দখলদারিত্বের মাত্রা এমনই যে, সেখানে রিকশা বা গাড়ি চলা তো দূরের কথা, হেঁটে পার হতেও হিমশিম খেতে হয়। যাত্রীবাহী ও মালবাহী যানবাহনের অবৈধ পার্কিংয়ের কারণে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের নিচে গুলিস্তান অংশের সড়কে এখন আর অন্য বাহন চলাচলের উপায় নেই। সংযোগ সড়কগুলোর এই দশার কারণে গুলিস্তানে অস্বস্তিকর যানজট লেগেই থাকে। অথচ এই গুলিস্তানেই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কার্যালয়, ফায়ার সার্ভিসের প্রধান কার্যালয়সহ বহু গুরুত্বপূর্ণ সরকারী দফতর রয়েছে। সেইসঙ্গে তৈরি পোশাক, জুতাসহ বিভিন্ন পণ্যের পাইকারি বাজার থাকায় প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষকে গুলিস্তানে আসতে হয় এবং পোহাতে হয় ভোগান্তি। পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দিনভর যানজট লাঘবের চেষ্টা করতে দেখা গেলেও বেদখল রাস্তা নিয়ে তারা নির্বিকার। হকারদের দাপটে যান চলাচলের জায়গা নেই রাজধানীর মহানগর নাট্যমঞ্চ থেকে গোলাপশাহ মাজারমুখী সংযোগ সড়কে। একই পরিস্থিতি দেখা গেল একটু দক্ষিণে নবাবপুর রোড থেকে ফুলবাড়িয়া যাওয়ার সংযোগ সড়কটিতে। উপরে ফ্লাইওভার, নিচে হকারদের দখলে পুরো রাস্তা। ফুলবাড়িয়া থেকে ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে বঙ্গবাজারে যাওয়ার সড়কটি পরিণত হয়েছে মহানগর ও ঢাকার পার্শ্ববর্তী এলাকায় চলাচলকারী বাসের ‘গ্যারেজে’। সেখানে গাড়ি রেখে কলকব্জা খুলে মেরামত চলে। চালক ও তাদের সহকারীরা বাস থামিয়ে বিশ্রাম নেন। বৃহস্পতিবার ওই সড়কে ঘুরে দেখা যায়, ঢাকা-ধামরাই রুটের ঢাকা পরিবহন, শুভযাত্রা পরিবহন, গ্রামীণ সেবা, গাজীপুর রুটে গাজীপুর পরিবহন, গুলিস্তান আব্দুল্লাহপুর (১৩২), প্রভাতী বনশ্রী পরিবহন, গোপালগঞ্জ রুটের মধুমতি পরিবহন, ইমাদ পরিবহনের অর্ধশতাধিক বাস সড়ক আটকে দাঁড়িয়ে। এর অনেকগুলোতে চলছে মেরামতের কাজ। ফুলবাড়িয়া সিটি সুপার মার্কেটের তানিশা সুজের স্বত্বাধিকারী মাসুম শেখ জনকণ্ঠকে বলেন, গত ১০ বছর ধরে এই এলাকায় তিনি ব্যবসা করেন। শুরু থেকেই ফুটপাথগুলোর অবৈধ দখলদারিত্বের এই চিত্র তিনি দেখে আসছেন। সরেজমিন আরও দেখা গেছে, গুলিস্তান, বায়তুল মোকাররম, জিপিও, পুরানা পল্টন, মতিঝিল, দিলকুশা, ফার্মগেট এলাকার ফুটপাথ বহুকাল থেকে হরেক পণ্যের স্থায়ী বাজারে পরিণত হয়েছে। ফুটপাথ দিয়ে চলাচল দুঃসাধ্য। কোথাও কোথাও ফুটপাথ ছাড়িয়ে মূল সড়কের ওপর বসে গেছে পণ্যের পসরা। ফলে পথচারীদের ভোগান্তি আর সড়কের যানজট তীব্র হলেও প্রতিকার নেই। গুলিস্তান সিনেমা হলের সামনের ফুটপাথজুড়ে পলিথিনের ছাউনি টাঙিয়ে বসেছে সারি সারি তৈরি পোশাকের দোকান। শার্ট, প্যান্ট, বাচ্চাদের পোশাক, থ্রিপিসÑ সবই মিলবে এখানে। জিপিওর সামনের ফুটপাথের গ্রিলের সঙ্গে পুরনো কোট-টাই ঝুলতে দেখা যাবে সারা বছর। কুমিল্লার আমির আলী এখানে কোট বিক্রি করেন। তিনি জানান, এখানে দিনপ্রতি লাইন ফি ৭০ টাকা। বায়তুল মোকাররম মসজিদ মার্কেটের পশ্চিম পাশের ফুটপাথে পাওয়া যাবে কার্পেট, বিদেশী ভ্রমণ ব্যাগ, থানকাপড়, জুতা, কম্বল, আতর, টুপিসহ হরেকরকম গৃহস্থালি উপকরণ। এখানে বড় পসরায় দৈনিক লাইন ফির বদলে মাসিক ভাড়া দিতে হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কার্পেট বিক্রেতা জানান, ভাড়া দিতে হয় মাসে চার হাজার টাকা। কারা এই লাইন ফি বা ভাড়া তোলে জানতে চাইলে তিনি জানান, লোক আছে। তবে এই টাকা কারা নেয়, কোথায় যায় তা তিনি জানেন না। মাসে বা প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা লাইনম্যানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে তারা নিশ্চিন্তে ব্যবসা করছেন। অন্য কোন চাঁদাবাজি নেই বলে জানান এই এলাকার ফুটপাথের ব্যবসায়ীরা। পুরানা পল্টন মোড় থেকে দৈনিক বাংলার মোড় হয়ে একেবারে মতিঝিল শাপলা চত্বর পর্যন্ত পথের দক্ষিণ পাশের ফুটপাথজুড়ে পোশাক, ফল, জুতা, ব্যাগের পসরা। আর উত্তর পাশের পসরা শুরু হয়েছে পুরনো বই দিয়ে। তারপর ফলের দোকান। নাম প্রকাশ না করে এখানকার আরেক বিক্রেতা জানান, প্রায় ২৫-৩০ বছর থেকে তিনি ব্যবসা করছেন এখানে। পুরনো ব্যবসায়ী বলে তাকে কোন লাইন ফি দিতে হয় না। মাসে শুধু বিদ্যুতের খরচ দিতে হয় ৫০০ টাকা। কিছু দূরের এক ফল বিক্রেতা জানান, তার লাইন ফি দৈনিক ৫০ টাকা। দিলকুশার জীবনবীমা ভবনের সামনে থেকে একেবারে আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাংক পর্যন্ত চলে গেছে হরেক পণ্যের পসরা। এখানে ফুটপাথ ছাড়িয়ে পসরা বসেছে সড়কের ওপরও। বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন ভবনের সামনে থেকে পিপলস ইন্স্যুরেন্স ভবন পর্যন্ত সড়কজুড়ে বিশাল কাঁচাবাজার। দিলকুশা-মতিঝিল এলাকার ফুটপাথের ওপর বেঞ্চ-টেবিল পেতে অনেক ‘ভাতের হোটেল’ গড়ে উঠেছে। বলাকা ভবন, কৃষি ব্যাংক ভবন, রূপালী ব্যাংক ভবনের পাশের ফুটপাথজুড়ে এসব ভাতের হোটেল জমজমাট থাকে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের পূর্ব দিকের গেটের দুই পাশে পোশাক আর মৌসুমী ফলের পসরা। হোটেল পূর্বাণীর সামনে থেকে পেট্রোলপাম্প পর্যন্ত ফুটপাথ ও রাস্তার ওপর বসে যায় শাকসবজির বাজার। প্রতিদিন লাইন ফির বিনিময়ে চলে ফুটপাথের এই কারবার। গুলিস্তান, মতিঝিল, দিলকুশা হয়ে পল্টন পর্যন্ত বিশাল এলাকার ফুটপাথ ও সড়কের ওপর কত দোকান বসছে এবং প্রতিদিন কত লাইন ফি উঠছে তার পরিসংখ্যান পাওয়া কঠিন। তবে এই অবৈধ দখলে পথচারীদের পড়তে হচ্ছে প্রচ- দুর্ভোগে। যানজট হচ্ছে তীব্র। বছরের পর বছর এই অবৈধ কারবার চলছে চোখের সামনে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, প্রতিকার করার কেউ নেই। তবে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনই ফুটপাথ দখল মুক্ত করতে বিভিন্ন সময়ে উচ্ছেদ অভিযান চালায়। তবে তাতে কোন কাজ হয় না। স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের প্রভাবে উচ্ছেদের পর পরই আবার দখল হয়ে যায় ফুটপাথ। এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন জনকণ্ঠকে বলেন, ফুটপাত দখলমুক্ত করতে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা রয়েছে। আমরা আদালতের নির্দেশ মতো ফুটপাথ দখল মুক্ত করতে কাজ করছি। বিভিন্ন সময়ের উচ্ছেদ অভিযানের পরক্ষণেই তা আবার দখল হয়ে যাচ্ছে কেনÑ এমন প্রশ্নের জবাবে সাঈদ খোকন বলেন, উচ্ছেদ অভিযানের পর আবার দখল হয়ে যাচ্ছে এটা ঠিক। এ জন্য দরকার সম্মিলিত উদ্যোগ। আমরা অবশ্যই চেষ্টা করছি এর সমাধান কিভাবে করা যায়।
×