ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

অপরাধবিষয়ক ত্রৈমাসিক সভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপি

পুলিশ-র‌্যাব বিরোধ নিজেদেরই মিটিয়ে ফেলতে হবে

প্রকাশিত: ০৬:০৫, ২৮ অক্টোবর ২০১৬

পুলিশ-র‌্যাব বিরোধ নিজেদেরই মিটিয়ে ফেলতে হবে

শংকর কুমার দে ॥ পুলিশ বাহিনী ও এলিট ফোর্স র‌্যাবের মধ্যে দ্বন্দ্ব-বিরোধ সৃষ্টি হলে নিজেদেরই মিটমাট করে ফেলতে হবে। কোনভাবেই যাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এ দুটি সংস্থার বিরোধ মিডিয়ায় প্রকাশ না পায়। পুলিশ সদর দফতরে বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত অপরাধবিষয়ক ত্রৈমাসিক সভায় এ ধরনের কথা বলেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের আইজি একেএম শহীদুল হক। র‌্যাব ও পুলিশের দ্বন্দ্ব-বিরোধ প্রকাশ্যে আসার ঘটনার পর একই দিনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজামান খান কামালের সঙ্গে দেখা করেছেন র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দফতর সূত্রে এ খবর জানা গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার সকাল দশটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত পুলিশ সদর দফতরে ত্রৈমাসিক অপরাধ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। পুলিশের আইজি একেএম শহীদুল হকের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজামান খান কামাল। পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ প্রধান, সিআইডি প্রধান, এ্যাডিশনাল আইজিপিগণ, রেঞ্জ ডিআইজি, পুলিশ কমিশনার, ডিসি ও এসপি পদমর্যাদার কর্মকর্তারা সভায় উপস্থিত ছিলেন। সভায় উপস্থিত পুলিশ কর্মকর্তাদের উদেশে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জমান খান কামাল ও পুলিশের আইজি একেএম শহীদুল হক র‌্যাব ও পুলিশের মধ্যে দ্বন্দ্ব-বিরোধ দেখা দিলে তা যেন নিজেরই মিটমাট করে ফেলে তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। কোনভাবেই যাতে এ ধরনের বিরোধের কথা মিডিয়ায় প্রকাশ না পায় সে বিষয়ে নির্দেশ দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপি। এছাড়াও বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে সাক্ষাত করেছেন র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ। তার সাক্ষাতের পর সাংবাদিকরা তাকে নব্য জেএমবি, তানভীর চৌধুরীর আস্তানায় অভিযান ও ইতালীয় নাগরিক হত্যাকা-ের বিষয়ে প্রশ্ন করেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আমি যা বলেছি, তথ্যপ্রমাণ নিয়েই বলেছি। এ নিয়ে বিভ্রান্তির কিছু নেই। আমি কোন পাল্টা মন্তব্য করব না। ও ফাঁদে পা দিতে পারে। কিন্তু আমি কোন ফাঁদে পা দেব না। র‌্যাব প্রধান পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট প্রধান মনিরুল ইসলামকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘ও আমার জুনিয়র অফিসার। আমার স্নেহের। ওর বিরুদ্ধে কিছু বলতে চাই না।’ সম্প্রতি ইতালির নাগরিক সিজার তাভেলা হত্যাকা- ও নব্য জেএমবির কথিত বাংলাদেশী প্রধান সারোয়ার জাহান ও তামিম চৌধুরীর নারায়ণগঞ্জের জঙ্গী আস্তানায় অভিযান পরিচালনা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দুই সংস্থাÑ র‌্যাব ও কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের পক্ষে দেয়া দুই ধরনের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য নিয়ে নানামুখী আলোচনা ও তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে- কার বক্তব্য সঠিক। এ প্রেক্ষাপটে বৃহস্পতিবারও নিজেদের অবস্থানে অনড় থেকে এ ধরনের মন্তব্য করেছেন র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ। গত বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর গুলশানে দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হন ইতালীয় নাগরিক সিজার তাভেলা। হত্যাকা-ের ৯ মাস পর গত ২৭ জুন এ মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে মামলার তদন্ত সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ-ডিবি। অভিযোগপত্রে ঢাকা মহানগর বিএনপি নেতা ও সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার এমএ কাইয়ুমসহ সাতজনকে অভিযুক্ত করা হয়। এ মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হওয়ার পর গত শুক্রবার র‌্যাবের এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থার মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ বলেন, সিজার তাভেলা হত্যাকা-ে নিউ জেএমবি বা নব্য জেএমবি জড়িত। নিউ জেএমবি বা নব্য জেএমবির বাংলাদেশের প্রধান সারোয়ার জাহানই কথিত আবু ইব্রাহীম আল হানিফ। আবু হানিফ ওরফে আব্দুর রহমান ওরফে সারোয়ার জাহানের বাসা থেকে উদ্ধারকৃত নথিপত্রে এসব তথ্য জানা গেছে বলে জানান র‌্যাব প্রধান। পুলিশের এলিট ফোর্স র‌্যাবের এ বক্তব্যের পর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হওয়ার পর গত বুধবার কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান ও সিজার তাভেলা হত্যা মামলার অন্যতম তদারক কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম বলেন, ফৌজদারি মামলার তদন্ত আসলে পরিচালিত হয় সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে। এখানে রচনা বা ক্রিয়েটিভ ওয়ার্ক করার সুযোগ নেই। সিজার তাভেলা মামলাও ফৌজদারি কার্যবিধির সব নিয়ম মেনেই তদন্ত করা হয়েছে। অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে একদল পেশাদার অফিসার তদন্তকারী কর্মকর্তাকে সাহায্য করে তদন্ত সম্পন্ন করেছেন। তদন্তে যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করা হয়েছে। এ মামলার আনুষ্ঠানিকভাবে বিচারকাজও শুরু হয়েছে। কোন দায়িত্বশীল ব্যক্তি বিচারাধীন বিষয় নিয়ে কোন মন্তব্য করতে পারেন না বলেও জানান পুলিশ কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম। পুলিশ কর্মকর্তা মনিরুল ইসলামের এ বক্তব্যের পর সরকারের উচ্চপর্যায়েও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। এ প্রেক্ষাপটে বৃহস্পতিবার সকালে র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ তার বক্তব্যের সপক্ষে তথ্যপ্রমাণাদি নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। র‌্যাব প্রধান বেনজীর আহমেদের কাছে সম্প্রতি সৃষ্ট বিভ্রান্তি প্রসঙ্গে সাংবাদিকরা জানতে চান। শুধু ইতালীয় নাগরিক সিজার তাভেলাই নয়, আব্দুর রহমান ওরফে সারোয়ার জাহান নামে যাকে র‌্যাবের পক্ষ থেকে নিউ জেএমবির বাংলাদেশী প্রধান আবু ইব্রাহীম আল হানিফ বলে দাবি করা হয়েছে, তাও নাকচ করে দিয়েছেন কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ইউনিট- সিটিটিসি প্রধান মনিরুল ইসলাম। সিটিটিসি ইউনিটের প্রধান বুধবার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, তাদের তদন্তে সারোয়ার জাহান নিউ জেএমবির তৃতীয় সারির একজন নেতা বলে উঠে এসেছে। গুলশান হামলার মাস্টারমাইন্ড তামিম চৌধুরীর ইমিডিয়েট পরের সারির নেতা সারোয়ার জাহান। উল্লেখ্য, গত ৮ অক্টোবর আশুলিয়ায় র‌্যাবের এক অভিযানে পাঁচতলা থেকে লাফিয়ে পড়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় আহত হয় আব্দুর রহমান। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সে মারা যায়। র‌্যাব তার প্রকৃত পরিচয় সারোয়ার জাহান এবং সে-ই কথিত আবু ইব্রাহীম আল হানিফ বলে দাবি করে। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ইউনিট- সিটিটিসি প্রধান মনিরুল ইসলাম নারায়ণগঞ্জে নব্য জেএমবির প্রধান সমন্বয়ক তামিম আহমেদ চৌধুরীর জঙ্গী আস্তানায় অভিযান চালানো ও কথোপকথন প্রসঙ্গে বলেছেন, রাতের বেলায় নয়, ভোরে অভিযান পরিচালনা করেছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। র‌্যাব প্রধান বলেছিলেন, রাতের বেলায় তামিম আহমেদের আস্তানায় অভিযান চালানোকালে কথিত নব্য জেএমবি প্রধান আবদুর রহমানের সঙ্গে তামিম আহমেদের ক্ষুদেবার্তা বিনিময় হয়, যা পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট কর্মকর্তা অস্বীকার করেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দফতরের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, র‌্যাব ও পুলিশের মধ্যকার দ্বন্দ্ব-বিরোধ প্রকাশ্যে আসার পর পুলিশ সদর দফতর থেকে ১০ দফা নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে, যা নিয়ে পুলিশ সদর দফতরে অনুষ্ঠিত ত্রৈমাসিক অপরাধবিষয়ক সভায়ও আলোচনা হয়েছে।
×