ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ মুনাফিকের কথা ও কাজ ভিন্ন

প্রকাশিত: ০৪:০১, ২৮ অক্টোবর ২০১৬

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ মুনাফিকের কথা ও কাজ ভিন্ন

সাধারণত মুনাফিক শব্দের অর্থবোধক শব্দসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- কপট, বিশ্বাসঘাতক, দ্বিধাগ্রস্ত, সন্দিহান, দুমুখো ইত্যাদি। প্রিয়নবী সরওয়ারে কায়েনাত খাতামুন্নাবিয়িন হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম মুনাফিকের আলামত বা লক্ষণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন, ‘আলামাতুল মুনাফিকি ছালাছুন ইযা হাদ্দাসা কাযাবা ওয়া ইযা ওয়া’আদা খালাফা ওয়া ইযা উ’তুমিন খানা’। মুনাফিকের লক্ষণ তিনটি- যখন কথা বলে তখন তা মিথ্যা বলে, ওয়াদা করে তা ভঙ্গ করে এবং আমানতের খিয়ানত করে। (বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ)। এই হাদিস শরীফ থেকে মুনাফিকদের চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্য সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আর তা হচ্ছে, মিথ্যাচার, প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করা এবং আমানত খিয়ানত করা। মুনাফিক মুখে আল্লাহ্ রসূলের কথা বলে, বেশভূষাতেও খাঁটি মুসলিম বলে মনে হয়; কিন্তু তারা শয়তানি চক্রের দোসর হিসেবে তৎপরতা চালায়, তারা মানবিক মূল্যবোধকে অপমানিত করে। প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামকে মক্কিজীবনে কাফির-মুশরিকদের মুকাবিলা করতে হয়েছে, কিন্তু ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মদীনা মনওয়ারায় হিজরত করে আসার পর তাঁকে ইয়াহুদী এবং সেখানকার কিছু লোক যারা বাইরে ইসলাম গ্রহণকারী হলে গোপনে ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী ছিল তাদের মুকাবিলা করতে হয়। লোক দেখানো ইসলামে দাখিল হওয়া এই লোকরাই মুনাফিক হিসেবে পরিচিত হয়। এরাই ইয়াহুদী এবং মক্কার কাফির-মুশরিকদের সঙ্গে আঁতাত করে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে পড়ে। এই মুনাফিকদের সরদার বা নেতা ছিল আবদুল্লাহ ইবনে উবাই। সে চেয়েছিল মদীনার কর্তৃত্ব নিজে গ্রহণ করতে। বাইরে সে হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের একান্ত আপনজন হিসেবে জাহির করত আর তলে তলে ইসলামের ক্ষতি হয় এমন সব কাজ করত। আল্লাহ্ জাল্লা শানহু এই মুনাফিকদের চেহারা উন্মোচন করে দিয়ে প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করে ইরশাদ করেন- ‘ওয়ামিনাননাসি মায়ইয়া কুলু আমান্না বিল্লাহি ওয়াবিল ইয়াওমিল আখিরি ওয়ামাহুম বি মু’মিনীন। ইউখাদিউনাল্লাহ ওয়াল্লাযিনা আমানু ওয়া মা ইয়াখদাউনা ইল্লা আনফুসাহুম ওয়ামা ইয়াশ উরুন।’ আর মানুষের মধ্যে এমন কিছু লোক রয়েছে যারা বলে, আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর প্রতি এবং শেষ দিবসের প্রতি; আদতে তারা মুমিনদের অন্তর্ভুক্ত নয়। আল্লাহকে এবং মুমিনদের ওরা প্রতারিত করতে চায়, অথচ ওরা নিজেরাই নিজেদের যে প্রতারিত করে তা ওরা বুঝে উঠতে পারে না। (সূরা বাকারা : আয়াত ৮-৯)। আল-কুরআনে মুনাফিকুন (মুনাফিকবৃন্দ) নামে একটি সূরা-ই আছে। ১১ খানা আয়াতে কারিমা বিশিষ্ট এই সূরাতে মুনাফিকদের সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। আল্লাহ জাল্লা শানহু তাঁর প্রিয় হাবীব হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করে ইরশাদ করেন মুনাফিকরা আপনার নিকট এসে বলেÑ ‘আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি নিশ্চয়ই আল্লাহর রসূল।’ আল্লাহ্ তো জানেনই যে, আপনি নিশ্চয়ই তাঁর রসূল এবং আল্লাহ্ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, মুনাফিকরা অবশ্যই মিথ্যাবাদী। ওরা ওদের শপথগুলোকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে এবং ওরা আল্লাহর পথ হতে মানুষকে নিবৃত্ত করে। (সূরা মুনাফিকুন : আয়াত ১-২)। এই সূরাতেই মুনাফিকদের আরও কিছু চিহ্ন তুলে ধরা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে : (হে রসূল) আপনি যখন তাদের দেখেন তাদের দেহাকৃতি আপনার নিকট প্রীতিকর মনে হয় এবং ওরা যখন কথা বলে তখন আগ্রহের সঙ্গে তাদের কথা শুনবেন। যদিও ওরা দেয়ালে ঠেকানো কাঠের স্তম্ভসদৃশ। (সূরা মুনাফিকুন : আয়াত-৪)। এতে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, মুনাফিকদের বেশভূষা, আচার-আচরণ মনোমুগ্ধকর হয়, তাদের কথাবার্তাও আকর্ষণীয় হয়, তাদের বাচনভঙ্গি লোককে আকৃষ্ট করে, তাদের চেহারাসুরত দেখে বোঝা যায় না যে তাদের বাইরের অবস্থা অন্তরের অবস্থার সম্পূর্ণ বিপরীত, তারা বাহ্যিক দিকটা সুন্দর ও মনোহর করে রাখে আর তাদের অন্তর মিথ্যা, প্রতারণা, বিদ্বেষ ও শয়তানি অভিসন্ধির কলুষতায় পরিপূর্ণ। হযরত ইমাম রাযী (রহ.) উল্লিখিত আয়াতে কারিমার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন- মুনাফিক সরদার আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাই, মুগিস ইবনে কায়েস ও ওয়াজেদ দৈহিক গঠনে সৌন্দর্যে দামী দামী পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধানে খুবই আকর্ষণীয় ছিল। যুগে যুগে নিত্যনতুন মুনাফিকের আবির্ভাব হয়েছে এবং হচ্ছে, যারা ইসলামের কথা বলে বটে কিন্তু ইসলামের আদর্শ থেকে, সৌহার্দ্য ও পরিচ্ছন্নতার আদর্শ থেকে তারা বিচ্যুত থাকে। তারা অশান্তি ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে কর্তৃত্ব গ্রহণের চেষ্টা করে; যেমনটা করেছিল মুনাফিক সরদার আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাই। এদের সম্পর্কে কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে- ‘ওয়া ইযাকিলালাহুম লা তুফসিদু ফিল আরদ, কালু ইন্নামা নাহনু মুসলিহুন, আল্লা ইন্নাহুমহুমুল মুফসিদুন ওয়ালা কিল্লা ইয়াশ উরুন।’ তাদের যখন বলা হয়, পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি কর না, তারা বলে আমরাই তো শান্তি স্থাপনকারী। সাবধান! এরাই তো অশান্তি সৃষ্টিকারী, কিন্তু এরা বুঝতে পারে না। (সূরা বাকারা : আয়াত ১১-১২)। কুরআন মজীদে আরও ইরশাদ হয়েছে- ‘যখন তারা মুমিনগণের সংস্পর্শে আসে তখন বলে, আমরা ঈমান এনেছি, আর যখন তারা নিভৃতে তাদের শয়তানদের সঙ্গে মিলিত হয় তখন বলে, আমরা তো তোমাদের সঙ্গেই রয়েছি, আমরা শুধু তাদের (মুমিনদের) সঙ্গে ঠাট্টা তামাশা করে থাকি।’ (সূরা বাকারা : আয়াত-১৪)। যাদের কথায় এবং কাজে বৈপরিত্য থাকে তাদের সম্পর্কে আল কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে- ‘ওয়া আন্নাহুম ইয়াকুলুনা মালা ইয়াফ’ আলুন।’ আর তারা যা বলে তা করে না। (সূরা শু’আরা : আয়াত-২২৬)। মুনাফিকরা মিথ্যাচার রোগ দ্বারা আক্রান্ত। এই রোগ তাদের এমনভাবে পেয়ে বসে যে তার খপ্পর থেকে তারা রেহাই পেতে পারে না। যে কারণে আল্লাহ্ জাল্লাহু শানুহু ইরশাদ করেন- ‘ফি কুলুবিহিম মারাদুন্।’ তাদের অন্তরে রয়েছে ব্যাধি। (সূরা বাকারা : আয়াত-১০)। আর এই ব্যাধি আক্রান্ত লোকদের জন্য রয়েছে কষ্টদায়ক শাস্তি। ইরশাদ হয়েছে- ‘ওয়ালাহুম আযাবুন আলীম, বিমাকানু ইয়াকযিবুন।’ আর তাদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি, কারণ তারা মিথ্যাবাদী (ঐ)। ইরশাদ হয়েছে- ‘আম হাসিবাল্লাযিনা ফি কুলুবিহিম মারাদুন আললায়ইখরিজাল্লাহু আদগানাহুম।’ যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে তারা কি মনে করে যে, আল্লাহ্ কখনো ওদের বিদ্বেষ ভাব প্রকাশ করে দেবেন না? (সূরা মুহম্মদ : আয়াত-২৯)। বস্তুত যারা মুনাফিকী করে এবং দুমুখোনীতি গ্রহণ করে তাদের এই অমার্জনীয় অপরাধের শাস্তি দুনিয়াতেই শুরু হয়ে যায়। পরিণামে তাদের অপমানিত হতে হয়, লাঞ্ছিত হতে হয়। মুনাফিককে কেউ প্রকৃত অর্থে সম্মান করে না। হযরত আবু হুরায়রা রাদি আল্লাহু তা’আলা আন্হু থেকে বর্ণিত একখানি হাদিসে আছে- ‘হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তাজিদুনা শাররাননাসি ইয়াওমাল কিয়ামাতি যাল ওয়াজহায়নিল্লাযি ইয়াতি হাউলায়ি বিওয়াজহিন ওয়া হাউলায়ি বিওয়াজহি।’ কিয়ামতের দিন সেই মানুষটাকেই সবচেয়ে মন্দ গাবে যে দুমুখো। সে এক মুখে এদের নিকট যায় এবং অন্য মুখে তাদের দিকে যায়। (বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ)। এই হাদিসখানিতে স্পষ্ট ভাষায় মুনাফিকদের সবচেয়ে মন্দ মানুষ বলা হয়েছে। এরা সব মানুষের কাছে ঘৃণার পাত্র যেমন হয় তেমনি আল্লাহ্ জাল্লাহু শানুহুও মুনাফিকদের জন্য কঠিন শাস্তির ঘোষণা করেছেন। হযরত আবু হুরায়রা রাদি আল্লাহ তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত অন্য আর একখানি হাদিসে আছে যে, ‘ইন্না মিন শাররিননাসি ইন্দাল্লাহি ইয়াওমাল কিয়ামাতি যাল ওয়াজহায়নি।’ নিশ্চয়ই কিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট মন্দ লোক হিসেবে গণ্য হবে সেই মানুষ যে দুমুখো। (তিরমিযী শরীফ)। এই মুনাফিকরাই যুগে যুগে মুসলিমদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে নিজেদের ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করে আসছে। আল্লাহ্ জাল্লাহু শানুহু মুনাফিকদের জন্য সবচেয়ে কঠিন শাস্তির ঘোষণা দিয়ে ইরশাদ করেন- ‘ইন্না মুনাফিকিনা ফিদ্ দারকিল আসফালি মিনাননার।’ নিশ্চয়ই মুনাফিকদের দোযখের সর্বনিম্ন স্তরে নিক্ষেপ করা হবে। লেখক : পীর সাহেব, দ্বারিয়াপুর শরীফ উপদেষ্টা, ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা)
×