ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মানস ঘোষ;###;অনুবাদ : এনামূল হক

ভারত যদি তখন বিচারপতি চৌধুরীর পরামর্শ শুনত...

প্রকাশিত: ০৩:৫৭, ২৮ অক্টোবর ২০১৬

ভারত যদি তখন বিচারপতি চৌধুরীর পরামর্শ শুনত...

কাশ্মীরে বর্তমানে পাকিস্তানের ইন্ধনে যে গোলযোগ ও রক্তক্ষরণ চলছে তা থেকে ভারত রেহাই পেতে পারত যদি দেশটির নেতৃবৃন্দ ও নীতিনির্ধারকরা বাংলাদেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর পরামর্শ শুনতেন। বিচারপতি চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলেন আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত (এ্যাম্বাসেডর এ্যাট লার্জ)। সে সময় তিনি পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর ভারতভুক্ত করে নেয়ার এবং বেলুচিস্তান, পাখতুনিস্তান ও সিন্ধুর স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি সমর্থন দেয়ার জন্য ভারতীয় নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। সেই কাজগুলো করা হলে পাকিস্তান আবার আয়তনে কাটছাঁট হয়ে যেত। এতে করে দেশটির বিষদাঁত ভেঙ্গে যেত এবং এর প্রতিবেশীদের বিশেষ করে ভারতে হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর শক্তি এবং সক্ষমতা থাকত না। তার পরামর্শ মতো কাজ করা হলে ভারতের এত বিলম্বে এমন হঠাৎ করে পাকিস্তান নীতি পুনরুজ্জীবন করার প্রয়োজন পড়ত না, যেখানে দেশটি ইতোমধ্যেই পিন্ডির সন্ত্রাসী কৌশল ও প্রক্সি যুদ্ধের অতি শোচনীয় শিকারে পরিণত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিরও বেলুচিস্তান সম্পর্কে সেই ঐতিহাসিক ঘোষণাটি দেয়ার দরকার হতো না। কেননা, বিচারপতি চৌধুরীর যুক্তি ছিল এই যে, পাকিস্তান আরও খ-িত হলে অস্তিত্বের সঙ্কটে এত গভীরভাবে জড়িয়ে পড়ত যে ঘৃণ্য হঠকারী পথে পা বাড়ানোর কথা ভাবার বা কাজ করার মতো আগ্রহ, শক্তি বা সম্পদ দেশটার থাকত না। নয় মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতীয় নেতৃবৃন্দের বেশ কিছু বাংলাদেশী নেতাকে পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল যারা ছিলেন সত্যিকার অর্থে ভারতের শুভাকাক্সক্ষী। সেই সঙ্কটময় দিনগুলোতে তাদের বিজ্ঞ পরামর্শ কিছুটা হলেও ভারতের পাকিস্তান নীতিনির্ধারণে ভূমিকা রেখেছিল। তাদের মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য দুজন ব্যক্তি ছিলেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এবং ভারতে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। অন্য আরও কয়েকজন ছিলেন যেমন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ। ভারতীয় নেতৃবৃন্দ বিশেষত শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ও ভারতীয় জনগণের প্রতি তাদের ভালবাসা ও শ্রদ্ধা ছিল সীমাহীন। ১৯৭২ সালের জানুয়ারি থেকে ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত চাকরি উপলক্ষে ঢাকায় অবস্থানকালে তাদের আস্থা অর্জন করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। তারা আমাকে অকথিত অনেক কাহিনী শুনিয়েছিলন যেগুলো আজকের ভারত-পাকিস্তান উদ্বায়ু সম্পর্কের ক্ষেত্রে দারুণ প্রাসঙ্গিকতা বহন করে। এই নেতারা শ্রীমতী গান্ধীর নেতৃত্বের গুণাবলীর অতি মুগ্ধ অনুরাগী ছিলেন এবং তাকে মহীয়সী নেত্রী বলে অভিহিত করতেন। ভারতে আশ্রয় প্রার্থী দেড় কোটি বাংলাদেশী শরণার্থীকে গ্রহণ ও দেখভাল করে ভারতীয়রা যে বিপুল ত্যাগ স্বীকার করেছিল তার জন্য তারা ভারতীয় জনগণেরও অত্যন্ত শুভাকাক্সক্ষী ছিলেন এবং তাদের মঙ্গল কামনা করতেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাক বাহিনীর পরিচালিত গণহত্যা ও গণধর্ষণের কারণে তারা পাকিস্তানের প্রতি হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন ক্ষমাহীন। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে পাকিস্তান সম্পর্কে তারা যা যা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন তার প্রতিটি শব্দ আজ সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ থেকে অভিমত ও মূল্যায়ন আমাদের চেয়ে অনেক বেশি নির্ভুল এবং বাস্তবতা নির্ভর। পাকিস্তানের শাসক পাঞ্জাবী এলিট শ্রেণীর মধ্যে বিচারপতি চৌধুরীর কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব ছিল। তিনি দুঃখ করে বলতেন যে, ইসলামাবাদের প্রধান নীতিনির্ধারক পাকিস্তানী পাঞ্জাবীদের মনমানসিকতা ভারতীয় নেতাদের জানা নেই। যে কারণে পাকিস্তানের প্রতি তাদের নীতির মধ্যে দুই বিপরীতধর্মী বৈশিষ্ট্যের অস্তিত্ব ও সামঞ্জস্যহীনতা রয়েছে। কিছু কিছু পরিস্থিতিতে সেই নীতিগুলো ছিল অকারণেই মহৎ ও উদার এবং কূটনৈতিক শিষ্টাচারে পরিপূর্ণ, যার কোন প্রয়োজনই ছিল না। পাকিস্তানীরা এটাকে ‘হিন্দুদের স্বভাবগত ভীরুতা ও নির্বুদ্ধিতা’ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছিল। এরপর তিনি একটা দৃষ্টান্ত দেন। পশ্চিমাঞ্চলীয় রণাঙ্গনেও পাক বাহিনী যখন পিছু হটছিল সে সময় তিনি ও তাজউদ্দীন কাশ্মীর বিরোধের স্থায়ী সামাধান হিসেবে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরকে ভারতভুক্ত করে নেয়ার জন্য ভারতীয় নেতাদের পরামর্শ দিয়েছিলেন। তারা অভিমত দিয়েছিলেন যে কাশ্মীর বিরোধের স্থায়ী সমাধানের এমন সুবর্ণ সুযোগ ভারত আর কখনই পাবে না। জেনারেল নিয়াজীর আত্মসমর্পণের বেশ আগে তারা দুজনে লিখিত বার্তা বা চিঠিপত্রের মাধ্যমে ইন্দিরা গান্ধী, তৎকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নীতি পরিকল্পনামন্ত্রী ডিপি ধর এবং ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব টিএন কাউলকে সাবধান করে দিয়েছিলেন যে, পাকিস্তানকে যেন বিশ্বাস করা না হয় এবং তাদের প্রতি সতর্ক পদক্ষেপ নেয়া হয়। কারণ ভারতের প্রতি পাকিস্তানের পাঞ্জাবী নেতৃবৃন্দ ও পাঞ্জাবী জনগোষ্ঠীর ঘৃণা এতই সুগভীর যে তারা প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য রক্তপিপাসায় উন্মাদ হয়ে আছে, যা ভারতীয় নেতারা সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়ে গেছেন কিংবা তারা যদি সে সম্পর্কে সচেতন থাকতেন বা তারপরও অগ্রাহ্যভরে এ কথা বলে বৈরিতাকে হাল্কাভাবে নেয়ার চেষ্টা করছেন যে, ‘পাকিস্তানীরা আমাদের কি করতে পারে’? এরা দুজনেই পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরকে ভারতভুক্ত না করে পশ্চিম রণাঙ্গনে ভারতের একতরফা যুদ্ধবিরতি ঘোষণার বিরুদ্ধে ছিলেন। তারা বেলুচিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি সর্বাত্মক নৈতিক ও বৈষয়িক সমর্থন ঘোষণার দ্বারা পাকিস্তানী রাষ্ট্র ও এর সামরিক বাহিনীকে আরও দুর্বল করে দেয়ার পক্ষে ছিলেন। বেলুচিস্তান প্রদেশটি পাকিস্তান ভূখ-ের এক-তৃতীয়াংশ যা কিনা বিপুল পরিমাণ গ্যাস, সোনা, তাম্র ও অন্যান্য মূল্যবান খনিজ দ্রব্যের আধার। সেই কারণে তার (বিচারপতি চৌধুরীর) দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছিল যে বালুচদের প্রতি এই সমর্থন পাখতুনিস্তান ও সিন্ধুর স্বাধীনতা আন্দোলনের অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে। পাকিস্তান যখন এক নাজুক অবস্থায় পড়ে গেছে তখন দেশটিকে আরও খ-িত না করাটা হবে রণকৌশলগত ভ্রান্তি। আর ভারত যদি এই সুযোগকে কাজে না লাগায় তাহলে দেরিতে নয়, বরং অচিরেই পাকিস্তান ভারতের যথেষ্ট ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। বিচারপতি চৌধুরীর পরামর্শে শুধু ভারতের নয়, বাংলাদেশেরও নিরাপত্তা স্বার্থ বিবেচনায় নেয়া হয়েছিল। কারণ, তাঁর মতে পাকিস্তানী পাঞ্জাবীরা পাকিস্তান ভাঙ্গার জন্য বাঙালীদের কোনদিন ভুলবে না ও ক্ষমা করবে না। তিনি ও তাজউদ্দীন দু’জনেই জানতেন যে পাকিরা অনেক ট্রয়ের ঘোড়া রেখে যাচ্ছে যারা সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পাকিস্তানের প্রক্সি হিসেবে কাজ করবে। পাকিস্তান ভাঙ্গার ‘বাঙালী ষড়যন্ত্রে’ সাহায্য সহায়তা করার জন্য পাকিরা ভারতকেও রেহাই দেবে না। উভয় নেতা ভারতকে এই বলেও হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন যে নাশকতা চালানোর জন্য পাকিরা পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে টার্গেট করবে এবং ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে এই অঞ্চলগুলোকে সম্ভব সব রকম উপায়ে সাহায্য করবে। সুতরাং বিচারপতি চৌধুরীর পরামর্শ অনুযায়ী এই হুমকির বিরুদ্ধে সর্বোত্তম রক্ষাকবচ ছিল পাকিস্তানের ভৌগোলিক সীমারেখা নতুন করে নির্ধারণ করে এর ভূখ-গত সীমানা মূলত পাঞ্জাব প্রদেশে সীমাবদ্ধ রাখা। কারণ খর্বকায় পাকিস্তান সে দেশের শাসক পাঞ্জাবী এলিট শ্রেণীর অহংবোধে এমন প্রচ- আঘাত হয়ে দেখা দেবে সে দেশের এই ক্ষুদ্র আকার ও পরিণতিটা মেনে নেয়াই তাদের জন্য দুষ্কর হয়ে উঠবে। বিচারপতি চৌধুরী দিল্লীতে হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন যে, ভারত এসব রণকৌশলগত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হলে দেশটি শেষ পর্যন্ত অদূর ভবিষ্যতে পাকিস্তানের সঙ্গে আরেকটি যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে বাধ্য হবে। কিন্তু ভারতীয় নেতৃবৃন্দ এই পরামর্শ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তারা ভেবেছিলেন যে পাকিস্তান তার পূর্বাঞ্চল খুইয়ে বসার পর দেশটিকে আরও নাকাল করার কোন প্রয়োজন নেই। তারা এই পরামর্শকে পাকিস্তানীদের নৃশংসতায় অহেতুক প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠা এক বাঙালী ভদ্রলোকের আবেগের বশবর্তী উক্তি হিসেবে দেখেছিলেন। জেনারেল নিয়াজী যেদিন ঢাকায় আত্মসমর্পণ করেছিলেন ঠিক সেদিন বাংলাদেশের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদের উদ্যোগে লন্ডনে পাকিস্তানের বিভিন্ন জাতিসত্তার জাতীয়তাবাদী নেতাদের অতীব তাৎপর্যপূর্ব এক গোপন বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই প্রথম এই নেতারা একত্রিত হয়েছিলেন এবং পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক প্রভুদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালাতে দৃঢ়সঙ্কল্প ব্যক্ত করেছিলেন। সেই বৈঠকে নওয়াব বুগতী থেকে শুরু করে ওয়াসী খচন পর্যন্ত সকল নেতা আজাদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন যে, ভারত তাদের সংগ্রামের সমর্থনে পাকিস্তানের সঙ্গে আরেক যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার ঝুঁকি নেবে কিনা। বৈঠক সাফল্যম-িত করে তুলতে ভিত্তি রচনার মতো কোন কাজ আগে থেকে করা হয়নি বিধায় এ বৈঠক থেকে সুনির্দিষ্ট কোন ফল অর্জিত হয়নি। তবে জাতীয়তাবাদী নেতাদের সবাই একমত হয়েছিনে যে, ভারত বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানের কাছ থেকে সামান্য কিছু সাহায্য পেলেই অদূর ভবিষ্যতে বালুচ, সিন্ধি ও পাখতুনরা স্বাধীন হবে। লেখক : ভারতীয় সাংবাদিক
×