ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আকিল জামান ইনু

থেমে গেল ভিয়েতনামের কণ্ঠস্বর

প্রকাশিত: ০৬:২৮, ২৭ অক্টোবর ২০১৬

থেমে গেল ভিয়েতনামের কণ্ঠস্বর

১৯৪৫ এ হো-চি-মিনের স্বাধীনতা ঘোষণার বছরই যাত্রা শুরু হয় ‘ভয়েস অব ভিয়েতনাম’-এর। আরও দশ বছর পরে, হ্যানয় হান্নাহ্ এতে যোগ দেন যখন তার বয়স ২৫। অনুষ্ঠানে একজন ইংরেজী সংবাদ পাঠিকা হিসেবে তিনি যোগ দেন । কিন্তু স্বদেশে ব্যাপক হারে মার্কিন সৈন্যদের উপস্থিতিতে ১৯৬৫তে তিনি জড়িয়ে পড়েন যুদ্ধের প্রোপাগান্ডায়। যুদ্ধের পূর্বে দিনে ৫-৬ মিনিট সংবাদ পাঠের পরিবর্তে যুদ্ধকালীন সময়ে তার জন্য প্রতিদিন ৩০ মিনিট করে তিনবার সময় বরাদ্দ হয়। সে সময় বহির্বিশ্বেও ভিয়েতনামের প্রতিনিধিত্ব করে তার কণ্ঠ । একটি প্রগতিশীল পরিবারের জন্মের পর, তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় একটি ফ্রেঞ্চ স্কুলে। হলিউড মুভি মুভি দেখে তার ইংরেজী শেখার শুরু। পকেট ভর্তি রুটি আর সসেজ নিয়ে তিনি ‘গন ইউথ দ্য উইন্ড’ দেখেছেন পাঁচ বার। তার ভাষায় তিনি ভিভিয়েন লেই আর পেন্সিল মোঁচের নিচ থেকে উচ্চারিত ক্লার্ক গ্যাবেলর প্রতিটি শব্দ মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। তার বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য বিষয়ও ছিল ইংরেজী। দিনের পর দিন তিনি ইংরেজী উচ্চারণ নিয়ে কাজ করেছেন এবং শেষ পর্যন্ত নিখুঁত মার্কিন উচ্চারণে ইংরেজী বলা রপ্ত করেন। ভিয়েত নাম যুদ্ধে তার প্রোপাগান্ডার ধরণ ছিল অভিনব। ভিনদেশী মার্কিন সেনাদের উদ্দেশ্যে সুরেলো মিষ্টি কণ্ঠে তিনি তার বক্তব্য উপস্থাপন করতেন । যেন অনুষ্টানে উপস্থাপন করছে তাদের পরিচিত পাশের বাড়ির মেয়ে অথবা দুষ্টুমিষ্টি এক স্কুল বালিকা। সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে অনুপ্রবেশকারী ক্লান্ত মার্কিন সেনারা গা এলিয়ে দিয়েছে। কেউ পরিষ্কার করছে তার রাইফেল। কেউ করছে ধূমপান অথবা মাত্র ছিপি খুলেছে বিয়ারের এমন এক সময়ে তাদের পিঠে ঝোলানো রেডিও খুলতেই ভেসে এলো তাঁর মিষ্টি কণ্ঠস্বর। যাকে তারা জানত হ্যানয় হান্নাহ্ বলে। উপস্থিত সৈন্যদের মধ্যে সরাসরি কারও নাম ধরে হান্নাহ্ বলছেন, ‘জি, আই’ জো, কেমন আছ তুমি আজ? ‘মিষ্টি স্বরে আরও বলছেন।’ ‘তুমি কি বিভ্রান্ত? কোন কারণ না জেনেই আদর্শহীন এক যুদ্ধে প্রাণ দিতে আসার চেয়ে বিভ্রান্তির আর কি আছে? তোমার সরকার তোমাকে পরিত্যাগ করেছে, এই গহীন জঙ্গলে মরতে পাঠিয়েছে। তাদের বিশ্বাস কর না, তারা মিথ্যাবাদী।’ এসব কথোপথনের মাঝেই তিনি তাদের প্রিয় শিল্পীদের পছন্দের গান যেমন, বব ডিলান, জোয়ান বায়েজ, এলভিস প্রিসলী প্লে করতেন। এ ছাড়াও তার নিজের পছন্দের গানও বাজাতেন। পিট সিগাবের, ‘হোয়ার হ্যাড অল দ্য ফ্লাওয়ার গন?’ কিংবা পেটুলা ক্লার্কের ‘ডাউনটাউন’, গানের পরেই আবার তিনি। এবার তিনি বর্ণনা দিচ্ছেন যুদ্ধক্ষেত্রে সাম্প্রতিক হতাহতদের বিবরণ এবং এমন কি বলে দিচ্ছেন তারা কোন্ শহর থেকে এসেছেন । আরও বলছেন, ‘ডিফেট জো’, সেই সঙ্গে আবেদন, ‘ডুবতে যাওয়া জাহাজ থেকে নেমে পড়ার এখনই সময়। তোমরা জানো কোন দিনও এ যুদ্ধে তোমরা জিততে পারবে না।’ তার কাছে প্রতিটি ইউনিটের সদস্যদের নাম ও তখনকার অবস্থানের তথ্য ছিল। মাত্র নিহত হয়েছে এমন কোন সেনা সদস্যের নাম ধরে তিনি তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতেন। তার কথা মার্কিন সেনাদের কাছে মার্কিন সামরিক বাহিনী পরিচালিত রেডিও পরিবেশিত তথ্যের চেয়ে অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য ছিল । এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের ডেট্রয়েটে যে যুদ্ধ বিরোধী দাঙ্গা হচ্ছে তা মার্কিন সেনারা তার মাধ্যমেই জানত। অনেকে বলেন তিনি প্রতিটি মার্কিন সেনার বান্ধবীর নাম পর্যন্ত জানতেন। এপ্রিল ৩০, ১৯৭৫ যুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত তার প্রোপাগান্ডা মার্কিন সেনাদের মনোবল ভেঙ্গে দিতে রেখেছে অপরিসীম অবদান। তিনি পরিণত হয়েছিলেন ভিয়েতনামের কণ্ঠস্বরে। তাঁর এমন অসাধারন ভূমিকা আমাদের মনে করিয়ে দেয় ১৯৭১-এ মহান যুক্তিযুদ্ধে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের’ কথা। হ্যালয় হান্নাহ্ আর নেই। গত ৩০ সেপ্টেম্বর ৮৭ বছর বয়সে চিরতরে থেমে গেছে ভিয়েতনামের কণ্ঠ।
×