ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

নব্য জেএমবি প্রধান নিয়ে র‌্যাব ও কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য ;###;তাভেলা হত্যাকাণ্ড নিয়ে মতে মিল নেই

জঙ্গী দমনে ॥ সমন্বয়হীনতা!

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ২৭ অক্টোবর ২০১৬

জঙ্গী দমনে ॥ সমন্বয়হীনতা!

শংকর কুমার দে ॥ র‌্যাব প্রধান বলছেন, জঙ্গী সংগঠন নব্য জেএমবির প্রধান আবদুর রহমান। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট প্রধান বলছেন, আবদুর রহমান তৃতীয় সারির নেতা। আবার ইতালীয় নাগরিক সিজার তাভেলা হত্যাকা-ের জন্য নব্য জেএমবিকে দায়ী করেছে র‌্যাব। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট তদন্তের পর চার্জশীট দিয়েছে বিএনপি নেতাসহ দুর্বৃত্ত-সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে। পুলিশের দুই সংস্থার প্রধানের পরস্পরবিরোধী দুই ধরনের বক্তব্যে জঙ্গী দমন ও তদন্তে সমন্বয়হীনতা, বিরোধ ও দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে, যার সুযোগ নিতে পারে দুর্বৃত্ত চক্রের খুনী ও জঙ্গীগোষ্ঠী। এ ধরনের অভিমত ব্যক্ত করেছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তা, অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকগণ। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার ও কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটি) ইউনিটের প্রধান মোঃ মনিরুল ইসলাম বুধবার রাজধানীর মিডিয়া সেন্টারে সাংবাদিকদের বলেছেন, আশুলিয়ায় র‌্যাবের হাত থেকে পালাতে গিয়ে নিহত ‘নব্য জেএমবি’র প্রধান শায়খ আবু ইব্রাহিম আল হানিফ ওরফে আবদুর রহমান ওরফে সারোয়ার জাহান আসলে তৃতীয় সারির একজন নেতা এবং এ বিষয়ে যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ আছে। র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজির আহমেদ গত ২১ অক্টোবর কাওরানবাজারের বিসিআইসি ভবনে র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, নিহত আবদুর রহমানই সারোয়ার জাহান ওরফে শায়খ আবু ইব্রাহিম আল হানিফ নব্য জেএমবি প্রধান। শুধু তাই নয়, র‌্যাবপ্রধান বলেছেন, গুলশানে ইতালীয় নাগরিক সিজার তাভেলা হত্যাকা-ে জড়িতরা নব্য জেএমবি। অথচ পুলিশ ইতালীয় নাগরিক সিজার তাভেলা হত্যাকা-ের তদন্ত শেষে অভিযোগপত্র (চার্জশীট) দিয়েছে ঢাকা মহানগর বিএনপির যুগ্মআহ্বায়ক এমএ কাইউমসহ সাতজনের বিরুদ্ধে। মঙ্গলবার এ মামলার অভিযোগ গঠন করা হয়েছে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে। ইতালির নাগরিক সিজার তাভেলা হত্যার ঘটনায় ডিবির দেয়া অভিযোগপত্র এবং র‌্যাবের তথ্য পরস্পরবিরোধী হওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করা হয় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার ও কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটি) ইউনিটের প্রধান মোঃ মনিরুল ইসলামকে। বুধবার ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ইতালি নাগরিক সিজার তাভেলা হত্যার অভিযোগপত্র তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে দেয়া হয়েছে। ডিবি তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে যা মনে করেছে, তার ভিত্তিতেই চার্জশীট দিয়েছে। এটা কোন সৃষ্টিশীল রচনা ছিল না। তদন্ত ও সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে যা পাওয়া গেছে, পুলিশ তা-ই বলেছে। এখন প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, র‌্যাবপ্রধানের বক্তব্য সঠিক, নাকি পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট প্রধানের বক্তব্য সঠিক? পুলিশের দুই প্রধানের দুই ধরনের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য প্রকাশ পাওয়ায় জঙ্গী দমন ও তদন্তের যে সমন্বয় নেই, তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তারা বলেন, র‌্যাব ও কাউন্টার টেররিজম ইউনিট দুটাই পুলিশের জঙ্গী দমন ও তদন্তের গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট বা সংস্থা। এ দুটি সংস্থার প্রধানের পরস্পরবিরোধী দুই ধরনের বক্তব্যে দুর্বৃত্ত চক্রের খুনী ও জঙ্গীগোষ্ঠীর সদস্যরা সুযোগ নেয়ার সহায়ক হবে। ইতালীয় নাগরিক সিজার তাভেলাকে গত বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় রাজধানীর গুলশানে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ইসলামিক স্টেট (আইএস) এ হত্যার দায় স্বীকার করে প্রথমবারের মতো আলোচনায় আসে ইরাক-সিরিয়াভিত্তিক জঙ্গীগোষ্ঠীটি। ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) তাভেলা হত্যা মামলার তদন্ত শেষ করে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। তাতে বিএনপি নেতা কাইয়ুম, তার ভাই আবদুল মতিন, বাড্ডা এলাকার বিএনপিকর্মী তামজিদ আহম্মেদ, রাসেল চৌধুরী, মিনহাজুল আরেফিন, শাখাওয়াত হোসেন ও মোঃ সোহেলকে আসামি করা হয়। এদের মধ্যে কাইয়ুম ও সোহেল পলাতক আছে। গ্রেফতার হওয়া আসামিদের মধ্যে তামজিদ, রাসেল চৌধুরী, মিনহাজুল ও শাখাওয়াত আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। ইতালীয় নাগরিক সিজার তাভেলা হত্যাকা-ের ঘটনার ১৩ মাস পর র‌্যাব জানাল, গুলশান হলি আর্টিজান রেস্তরাঁসহ অন্যান্য জঙ্গী হামলা ও হত্যাকা-ের মতো ইতালীয় নাগরিক হত্যাকা-েও নব্য জেএমবি জড়িত। এ হত্যাকা-ের পরিচালনায় ছিলেন নব্য জেএমবির প্রধান আবদুর রহমান ওরফে সারোয়ার জাহান, যিনি হলেন কথিত শায়খ আবু ইব্রাহিম আল হানিফ। গত ২১ অক্টোবর র‌্যাবপ্রধান সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছেন, তাভেলা হত্যাসহ ২২ হামলার নেতৃত্ব দিয়েছেন নব্য জেএমবির প্রধান (আমির) সারোয়ার জাহান। তার সাংগঠনিক নাম শায়খ আবু ইব্রাহিম আল হানিফ। এই জঙ্গী নেতা গত ৮ অক্টোবর র‌্যাবের অভিযানে আশুলিয়ার গাজীরচট এলাকায় পাঁচতলা থেকে পড়ে গুরুতর আহত হন। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে সাভারের এনাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, পুলিশ ও র‌্যাবের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হওয়া- প্রথম প্রকাশ পায় র‌্যাবপ্রধানের দেয়া একটি অভিযোগ সংক্রান্ত চিঠি। চলতি মাসে কতিপয় পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দফতরে লিখিত অভিযোগ করেছেন র‌্যাবপ্রধান। সেই চিঠির পর প্রশ্ন উঠতে থাকে, এলিট ফোর্স র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন র‌্যাব ও পুলিশের মধ্যে দূরত্ব বাড়ছে কি? র‌্যাবপ্রধানের লিখিত ওই অভিযোগে বলা হয়- ‘র‌্যাব সদস্যদের পুলিশ হেনস্তা করছে, দায়ী পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটতে পারে। পরবর্তী সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অস্ত্রধারী দুটি দলের মধ্যে বড় ধরনের দুর্ঘটনা সৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া পুলিশ বাহিনী তথা সরকারের ভাবমূর্তিও ক্ষুণœ হতে পারে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বিশ্ব শিশু দিবস উপলক্ষে কেন্দ্রীয় খেলাঘরের আয়োজনে সকালে শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালা মিলনায়তনে এক চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় দুই বাহিনী পুলিশ ও র‌্যাবের মধ্যে দ্বন্দ্ব নেই। ছোটখাটো যে কিছু সমস্যা আছে, সেটা তারা নিজেরাই মিটিয়ে নিতে পারবে। পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজি) একেএম শহীদুল হক কতিপয় পুলিশের বিরুদ্ধে র‌্যাব মহাপরিচালকের অভিযোগের বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, র‌্যাব মহাপরিচালক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে পুলিশের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ করেননি। আইজিপিকে বাদ দিয়ে তিনি (র‌্যাব মহাপরিচালক) এমন অভিযোগ করতেও পারেন না। কোন অভিযোগ করতে চাইলে তা আইজিপি বরাবরই করতে হবে। পুলিশ সদর দফতরে মোবাইল ফোন এ্যাপ ‘বিডি পুলিশ হেল্প লাইন’ চালুর অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন আইজিপি। র‌্যাবের ডিজির কতিপয় পুলিশ সম্পর্কে অভিযোগ করার পরিস্থিতির পর পুলিশ সদর দফতর থেকে এ সংক্রান্ত ১০ দফা জরুরী নির্দেশনা জারি করা হয়, যাতে করণীয়, বর্জনীয় ইত্যাদির সম্পর্কে নির্দেশনা দেয়া হয়। এসব নির্দেশনার অনুলিপি সারাদেশের পুলিশের সব ইউনিটে পাঠানো হয়েছে। ভবিষ্যতে পুলিশ-র‌্যাবের মধ্যে যাতে বড় ধরনের কোন অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা না ঘটে, সে লক্ষ্যে পুলিশ সদর দফতর থেকে নতুন এ নির্দেশনা জারি করা হয়েছে বলে জানা গেছে। সংবাদ সম্মেলনে যা বলেন পুলিশ কর্মকর্তা ॥ ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেছেন, ইতালি নাগরিক সিজার তাভেলা হত্যার অভিযোগপত্র তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে দেয়া হয়েছে। তিনি দাবি করেন, র‌্যাব সারোয়ার জাহানকে ‘নব্য জেএমবি’র প্রধান বলে দাবি করেছে। কিন্তু তিনি তৃতীয় সারির একজন নেতা। এ ব্যাপারে যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণও আছে। বুধবার ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন মনিরুল ইসলাম। ইতালীয় নাগরিক সিজার তাভেলা হত্যাকা-ের বিষয়ে র‌্যাব ও পুলিশের এ ভিন্ন তথ্যের ব্যাপারে সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করা হলে মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘ডিবি তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে যা মনে করেছে, তার ভিত্তিতেই চার্জশীট দিয়েছে। এটা কোন সৃষ্টিশীল রচনা ছিল না। তদন্ত ও সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে যা পাওয়া গেছে, পুলিশ তা-ই বলেছে।’ পুলিশ কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম বলেন, আমি মনে করি, র‌্যাবের মহাপরিচালক এ কথা বলেননি। একটা দায়িত্বশীল পর্যায়ে থেকে বিচারাধীন কোন বিষয়ে তিনি এ ধরনের মন্তব্য করতে পারেন না। এর আগের সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব জানায়, নারায়ণগঞ্জে তামিম চৌধুরীকে যখন ঘিরে ফেলা হয়, তখন তার সঙ্গে সারোয়ার জাহানের খুদে বার্তা বিনিময় হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে মনিরুল ইসলাম বলেন, ওই দিন সকাল সোয়া ছয়টার দিকে কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের সদস্যরা তামিমকে ঘিরে ফেলেন। এরপর তামিম চৌধুরীর হাতে খুব কম সময় ছিল। সে সময় সামান্য যে যোগাযোগ তিনি করতে পেরেছিলেন, তা তানভীর কাদেরী ও মেজর জাহিদের সঙ্গে। র‌্যাব সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেছিল- ‘নব্য জেএমবির’ সদস্য আছে আর মাত্র ২১ জন। এ প্রসঙ্গে মনিরুল বলেন, এ ধরনের কোন তথ্য পুলিশের কাছে নেই। তবে খবর আছে, শীর্ষস্থানীয় নেতারা অভিযানে নিহত হওয়ায় ‘নব্য জেএমবির’ মাঝারি বা নিচের সারির কিছু নেতা এখন দায়িত্ব নিয়েছে।
×