ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আশার আলো হোয়াইট হেলমেটস

প্রকাশিত: ০৭:৩৯, ২৬ অক্টোবর ২০১৬

আশার আলো হোয়াইট হেলমেটস

যুদ্ধকবলিত সিরিয়ায় এখন শুধু ধ্বংস ও মৃত্যুর হোলি খেলা। প্রায় পাঁচ বছর ধরে চলমান এই যুদ্ধের যেন শেষ নেই। প্রেসিডেন্ট বাশারের সৈরশাসনের বিরুদ্ধে যারা লড়াইয়ে নেমে পড়েছিল শেষ পর্যন্ত তারা সহস্র্রাধিক সশস্ত্র গুণে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। আর এই লড়াইয়ে যে কারোর না কারোর পক্ষ নিয়ে সংশ্লিষ্ট হয়েছে ইরান, রাশিয়া আমেরিকা, সৌদি আরব, কাতার, তুরস্ক এবং হিজবুল্লাহ। সিরিয়া যুদ্ধ যেন ভিলেনেরই জন্ম দিয়েছে। আর দিয়েছে ধ্বংসের পাশাপাশি অগণিত উদ্বাস্তুর। এই যুদ্ধ বোমা ও কামানের গোলায় ধ্বংসপ্রাপ্ত সেই স্ট্যালিনগ্রাদের কথাই মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু যুদ্ধের বিভীষিকা ও ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যেও দূর পাহাড়ের দিক চক্রাবলে জ্বলজ্বলে তারার মতো মৃদু আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে আরও কিছু সংগ্রামী মানুষ যাদের নিয়ে আগামীর উজ্জ্বল দিনের আশা জাগে। এরা হোয়াইট হেলমেট নামে পরিচিত। এরা হলো স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী যাদের কাজ যুদ্ধকবলিত এলাকার বিধ্বস্ত বাড়িঘরের ভেতর আটকে পড়া মানুষদের উদ্ধার করা, অগ্নিকা- নির্বাপিত করা, অবিস্ফোরিত বোমা নিষ্ক্রিয় করে দেয়া, রাসায়নিক হামলা হলে তা থেকে মানুষজন রক্ষার ব্যবস্থা করা। তাদের মূলমন্ত্র হলো কোরানের এই অমিয় বাণী : ‘একজনের জীবন বাঁচানো মানে গোটা মানবতাকে রক্ষা করা।’ হোয়াইট হেলমেট বাহিনীতে সিরিয়ার সমাজের সর্বস্তরের মানুষ আছে। আছে শিক্ষক, রুটি বিক্রেতা, ওষুধের দোকানদার, ছুতার, ছাত্র ও অন্যান্য পেশার মানুষ। এই বাহিনীর স্বেচ্ছাসেবকদের সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। এদের হাত দিয়ে প্রাণরক্ষা পেয়েছে প্রায় ৬০ হাজার নারী-পুরুষ ও শিশু। তবে এই উদ্ধার কাজ করতে গিয়ে মারা গেছে ১৪১ জন হোয়াইট হেলমেট। হোয়াইট হেলমেটদের কাজ সিরিয়ার অভ্যন্তরের ভাগ জুড়ে। সেখানেই রুশ বা মার্কিন বিমান কিংবা বাশারের বাহিনী বোমা ও গোলাবর্ষণ করে তারা সেখানেই ছুটে যায় বিপন্ন মানুষ উদ্ধারে। ফ্রন্টলাইনে তারা নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে। তবে অধিক থেকে অধিকতর মাত্রায় তাদের কাজের পরিধি হয়ে পড়েছে দেশের সর্ববৃহৎ নগরী আলেপ্পো। এই নগরীর পূর্বাংশ যুদ্ধের প্রথম দিক থেকেই বিদ্রোহীদের দখলে হলেও এখন দেশের বাকি অংশ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন। প্রায় ৩ লাখ লোক সেখানে অবরুদ্ধ অবস্থায় জীবনযাপন করছে। হোয়াইট হেলমেটের প্রধান হলেন রাইজ সালেহ। পেশায় ইলেকট্রনিক্সের সেলসম্যান। পাঁচমিশালি লোকজন নিয়ে গঠিত তার স্থানীয় পর্যায়ের গ্রুপটি আজ একটি ঐক্যবদ্ধ জাতীয় সংগঠনের রূপ লাভ করেছে। বাশারপন্থী মিডিয়াগুলো জঙ্গীগোষ্ঠীর সঙ্গে হোয়াইট হেলমেটদের যোগাযোগ আছে বলে অভিযোগ করলেও এর নেতারা সেটা অস্বীকার করেন। বলেন, তাদের সদস্যরা সবাই সিভিলিয়ান এবং তাদের আচরণবিধিতে অস্ত্রধারণ করা নিষিদ্ধ। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জাপানের অর্থায়নে এআরকে নামের একটি কনসাল্টিং ফার্ম ২০১৩ সালের মার্চ মাসে তুরস্কে উদ্ধারকারী দলের প্রশিক্ষণের আয়োজন করে। হোয়াইট হেলমেটের শিকার রয়েছে ২০১১ সালের গণঅভুত্থানে। সে সময় বাশারবিরোধী আন্দোলন শুরু হলে সরকারের তরফ থেকে নেমে আসে নিষ্ঠুর দমননীতি- জেল, জুলুম, গুলি। অচিরেই সশস্ত্র বিদ্রোহ দানা বাঁধে। বিদ্রোহীরা সিরিয়ার শহর, নগরের নিয়ন্ত্রণ দখল করে নেয়। সরকার ধ্বংস করতে লেগে যায়। বলতে গেলে তখন থেকে হোয়াইট হেলমেটদের কাজ শুরু। সরকার জীবন ধারণের জন্য অপরিহার্য অবকাঠামোগুলো উদ্দেশ্যপূর্ণভাবেই ধ্বংস করে দিচ্ছিল। ধ্বংসস্তূপের জন্য রাস্তায় চলাচলের উপায় ছিল না। বিদ্যুত বিচ্ছিন্ন, পানি নেই। সেগুলো ঠিকঠাক করার কেউ নেই- নেই কোন সরকারী সংস্থার লোকজন। তখন স্থানীয় বেসামরিক প্রতিরক্ষা গ্রুপগুলো সরকারের রেখে যাওয়া শূন্যতা পূরণে এগিয়ে আসে। শুরু হয় ধ্বংসস্তূপ অপসারণ, বিদ্যুত ও পানি সংযোগ পুনর্প্রতিষ্ঠা, চিকিৎসার প্রয়োজন নিরূপণ লাশ দাফন ইত্যাদি। এভাবেই বেসামরিক প্রতিরক্ষা গ্রুপগুলো যুদ্ধকবলিত সিরিয়ায় বিকল্প সরকারের একটা কাঠামো হয়ে দাঁড়ায়। যুদ্ধ যতই ছড়িয়ে পড়তে থাকে ততই তারা নিজেদের নেটওয়ার্ক ও কর্মকা-ের পরিধি বিস্তৃত করে চলে। আর এভাবেই আবির্ভাব ঘটে হোয়াইট হেলমেটের। নিজেদের জীবন বিপন্ন করে এর সদস্যরা ছুটে যায় আর্তমানবতার সেবায়। উদ্ধার ও ত্রাণ কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তা করতে গিয়ে তারা নিজেরাও আক্রমণের টার্গেট হয়। বিশেষ করে রুশ বিমান বাশারের বাহিনী, আইসিস, আলকামেদার তরফ থেকে আঘাত নেমে আসে তাদের ওপর। কেউ প্রাণ হারায়, কেউ হয় আহত। কিন্তু তারপরও সিরিয়ার বিশেষ করে আলেপ্পোর বিপন্ন অবরুদ্ধ মানুষ নির্ভর করে হোয়াইট হেলমেটসদের ওপর। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে জনগণের কাছে এদের সুনাম খ্যাতি অনেক বেড়ে গেছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে চাহিদা। গত ৭ অক্টোবর নোবেল শান্তি পুরস্কার ঘোষিত হওয়ার আগে গ্রুপটির এই পুরস্কারপ্রাপ্তির সম্ভাবনার কথা শোনা গিয়েছিল। হোয়াইট হেলমেটসদের নিয়ে নেটফ্লিক্স এক চমৎকার প্রামাণ্য চিত্র ছেড়েছে। গত ২২ সেপ্টেম্বর গ্রুপটি মর্যাদাজনক ‘রাইট লাইভলিহুড এ্যাওয়ার্ড’ লাভ করে। এটি নোবেল পুরস্কারের বিকল্প হিসেবে বিবেচিত। এই পুরস্কার ঘোষিত হওয়ার পরের দিন সকালে আলেপ্পোর পূর্বাঞ্চলে হোয়াইট হেলমেটসের তিনটি স্থাপনার ওপর বোমাবর্ষণ করা হয়। এতে ওদের বেশ ক্ষতি হলেও সৌভাগ্যবশত কেউ নিহত হয়নি। আর এমনি সব ঝুঁকি ও বিপর্যয়ের মধ্যেও নিজেদের কাজ কঠিন সংকল্প নিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে সিরিয়ার এই বীর সংগ্রামীর দল। চলমান ডেস্ক সূত্র : টাইম
×