ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জাহিদ রহমান

অন্ধকার থেকে মুক্তি চায় দেশের ফুটবল

প্রকাশিত: ০৬:৩৫, ২৬ অক্টোবর ২০১৬

অন্ধকার থেকে মুক্তি চায় দেশের ফুটবল

মালদ্বীপ, ভুটানের মতো ক্ষুদ্র দেশ ফুটবলে যেখানে কেবলই আলো ছড়াতে সক্ষম হচ্ছে, ঠিক সেখানে আমরা কেবলই অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছি। ফুটবলে আমরা কতটা অন্ধকারে তলিয়ে গেছি সবচেয়ে বড় প্রমাণ সম্প্রতি এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে ভুটানের কাছে বড় ব্যবধানে পরাজয়। এই পরাজয় আকস্মিকভাবে ঘটেনি, ঘটেছে আমাদের ফুটবলের অবনমনের ধারাবাহিকতায়। সম্প্রতি থিম্পুতে অনুষ্ঠিত ভুটান-বাংলাদেশ ম্যাচে বাংলাদেশ ফুটবল দল যে হারতে হবে তা আগেই আঁচ করা গিয়েছিল। খুব সম্ভবত বাফুফে কর্মকর্তারা কেবল আঁচ করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন! তবে ধারণা এই জন্য করা হয়েছিল যে, তার ক’দিন আগে ঢাকার মাঠে অনুষ্ঠিত প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশ দল ছন্নছাড়া খেলা উপহার দিয়ে ভুটানের সঙ্গে ড্র করেছিল। তখনই বোঝা গিয়েছিল সামনে পরিণাম খুব বেশি ভাল না। অবশেষে সেটাই ঘটে। পরাজয়ের লজ্জায় বাংলাদেশের মুখ ঢেকে যায়। সাম্প্রতিকালে অবকাঠোমো, প্রচার এবং অর্থবিত্তের প্রভাবে ফুটবলের বাহ্যিক আভিজাত্য যখন অনেক উঁচুতে, যখন বাফুফে নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনের চেয়ে উত্তাপ ছড়িয়ে ফেলে তখন মাঠে ফুটলের করুণ পারফরমেন্স সত্যিই বেমানান। ভুটানের কাছে পরাজয়ের পর তাই ফুটবলার এবং কর্মকর্তারা তিরস্কৃত হয়েছেন, নিন্দিত হয়েছেন। কর্মকর্তাদের ভূমিকা, ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সবাই। অনেকেই বাফুফে সভাপতির পদত্যাগও চেয়েছেন। তবে বাফুফে সভাপতি বলেছেন, না সবকিছু একেবারে শেষ হয়ে যায়নি।’ অবশ্যই সবকিছু শেষ হয়ে যায়নি। আশির দশকের মধ্যভাগে যেদিন ঢাকার মাঠে মালদ্বীপ বাংলাদেশের কাছে ৮ গোলের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছিল, সেদিন অবশ্যই মালদ্বীপেরও সবকিছু শেষ হয়নি। আর সব শেষ হয়নি বলেই তারা সেই প্রতিশোধটি নেয়ার জন্য এখন অপেক্ষা করছে। তার সঙ্গে তারা দিয়েছে কদিন আগে প্রীতিম্যাচে বাংলাদেশকে ৫-০ গোলের ব্যবধানে হারিয়ে। বোঝা যাচ্ছে আর কদিন পর তারা বাংলাদেশের জালে ৮ গোল দিয়েই ছাড়বে। মালদ্বীপ তো বেশ আগেই সার্ক অঞ্চলে ফুটবলে বাজিমাত করতে সক্ষম হয়েছে। নইলে পুঁচকে এই দেশটি কী ভারতের মতো একটি শক্তিকে হারিয়ে সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার যোগ্যতা দেখাতে পারে। এরপর থেকে মালদ্বীপের উত্থান আর উত্থান। মনে হচ্ছেÑ সেখানে এখন যুক্ত হয়েছে জনসংখ্যার অনুপাতে আমাদের নরসিংদী জেলার চেয়েও ছোট্ট দেশ ভুটানের। বাংলাদেশের ফুটবল বহু আগেই তার সৌন্দর্য হারিয়েছে। তবে সৌন্দর্য হারালেও ফুটবলের কীংবদন্তি কাজী সালাউদ্দিন যখন প্রথমবার রাজকীয় মর্যাদায় সভাপতি হন তখন সবাই এই আশায় বুক বাঁধেন যে এবার কিছু হবে। কারণ কাজী সালাউদ্দিন বরাবরই ফুটবলে অন্যরকম এক অনুপ্রেরণার আধার। তাঁর ইমেজ, আধুনিকতা সর্বোপরি ফুটবলের প্রতি তার যে দরদ সেই নিরিখে সবার প্রত্যাশাই ছিল কাজী সালাউদ্দিনই পারবেন ফুটবলকে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি উচ্চতায় নিতে। কিন্তু না কাজী সালাউদ্দিন পারেননি, একেবারেই পারেননি। কেন পারছেন না তিনি? ভুটানের কাছে বেদনাদায়ক পরাজয়ের পর তিনি প্রথমে মুখ না খুললেই পরে খুলেছেন। অনেক কথার ভিড়ে বলেছেন, ‘আমরা তো আর মাঠে গিয়ে খেলে দিতে পারি না।’ ধরেই নিলাম ছেলেদের চরম ব্যর্থতার আক্ষেপেই তিনি এ কথা বলেছেন। কিন্তু কেন আমাদের ফুটবলের এই হতাশজনক চিত্র? কেন আমরা ব্যর্থতার বৃত্ত থেকে বের হতে পারছি না? বারবারই কেন আমরা দুর্বল, নির্জীব পারফরমেন্স প্রদর্শন করে সবার কাছে হাস্যকর এক দল হিসেবে পরিগণিত হচ্ছি? মূল সমস্যা হলো আমরা গত এক দশকে ভাল খেলোয়াড় ও টিমওয়ার্ক তৈরি করতে পারিনি। শুধু অনেক স্বপ্নের কথা বলেছি এই যা, আমাদের দেশের খোলোয়াড়দের মাঝে স্পিড, স্পিরিট কোনটাই গড়ে উঠেনি। দলে কোন ভাল প্লেমেকার নেই। টেকনিক্যালিও আমাদের খেলোয়াড়রা অনেক পিছিয়ে। সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো- টিম স্পিরিটের চূড়ান্ত অভাব। অনেক খেলোয়াড়ের বেসিকও রীতিমতো নড়বড়ে। এসব কারণেই ফলাফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। যে টিম নিয়ে বাংলাদেশ খেলতে গিয়েছিল তাতে করে যে ফলাফল করেছে এর চেয়ে আর কোন ভাল ফলাফল না হওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। অথচ ফুটবলের সুযোগ-সুবিধা, অবকাঠামো, জনপ্রিয়তা যায় বলি না কে এরা কখনই মালদ্বীপ বা ভুটান আমাদের থেকে এগিয়ে নেই। ওদের দেশের ফুটবলাররা লীগে খেলে আমাদের খেলোয়াড়দের চেয়ে বেশি অর্থ পায় না। গত বেশ কয়েক বছর ধরে ফুটবল পর্যবেক্ষণে মনে হয়েছে আমাদের দেশে সবচেয়ে বড় অভাব মান সম্পন্ন ফুটবলার। আমাদের ঝুলিতে ভাল খেলোয়াড় নেই। ভাল খেলোয়াড় নেই বলেই আমরা বার বার ব্যর্থ হচ্ছি। ফুটবল সবসময় এগারো জনের খেলা। এ খেলায় চমৎকার টিমওয়ার্ক লাগে। এর বাইরে বার বার কোচ পরিবর্তন এ দেশের ফুটবলের মহাসর্বনাশের আরও অন্যতম একটি বড় কারণ। এর আগে আর্জেন্টাইন কোচ ক্রুসিয়ানি একটু হলেও খেলোয়াড়দের মন-মানসিকতায় পরিবর্তন এনেছিলেন। কিন্তু তাকে বিদায় করা হয়েছিল বিকল্প কোন কোচ নিয়োগ না দিয়েই। তারপর আবার যাও কিনা ভারতের বর্ষীয়ান কোচ নাইমুদ্দিনকে নিয়োগ দিয়ে শূন্যস্থানপূরণ করা হলো পরে আবার যা ছিল তাই করা হয়। এরপর তো বিদেশী কোচদের যাওয়া আর আসার পালা। তবে সব কোচদেরই প্রতিক্রিয়া এ রকম- এ দেশের খেলোয়াড়রা সমস্যা নয়, সমস্যা কর্মকর্তারা। তাদের কারণেই এদেশে দক্ষ খেলোয়াড় তৈরি হয়নি। বর্তমান বাফুফে কমিটিতে কাজী সালাউদ্দিনসহ বেশ কয়েকজন সাবেক তারকা ফুটবলার রয়েছেন। যে সব ফুটবলাররা এ দেশের ফুটবলের স্বর্ণালি দিনের খেলোয়াড়। যাদের ঝুলিতে রয়েছে অফুরন্ত অভিজ্ঞতা। কিন্তু সেই অভিজ্ঞতার প্রয়োগ হচ্ছে বলে মনে হয় না। সবাই শুধু অভিমান আর অভিমান করছে। সাম্প্রতিক পরিপ্রেক্ষিতে ফুটবলের যে অবস্থা প্রথমেই এর চুলচেরা বিশ্লেষণ করা দরকার। সেই নিরিখে বলব এখনই একটি রিভিউ কমিটি করে বিগত দশ বছরের আমাদের ফুটবল স্ট্যাটাসটাকে বিশ্লেষণ করে একটা পর্যালোচনা প্রতিবেদন তৈরি করা। যা এক নজরে দেখে বোঝা যাবে আমাদের উত্থান-পতন এবং অবস্থান। একই সঙ্গে বর্তমানে সাফ অঞ্চলের দেশগুলোর পারফরমেন্সের একটা তুলানামূলক রিপোর্ট করা। এই দুটি পর্যালোচনা রিপোর্ট তৈরির কাজ শেষ হলে সামনে পাঁচ বছরকে টার্গেট করে ফুটবলের উন্নতির জন্য একটা মাস্টার প্লান তৈরি করা। সেই মাস্টার প্লানে থাকবে সামনে আমাদের কী কী লক্ষ্য হবে এবং সেই লক্ষ্য পূরণে থাকবে সুনির্দিষ্ট কর্মতৎপরতা।
×