ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কুক-স্টোকসদের দুর্বোধ্য এক জয়

প্রকাশিত: ০৬:৩৪, ২৬ অক্টোবর ২০১৬

কুক-স্টোকসদের দুর্বোধ্য এক জয়

বাংলাদেশ-ইংল্যান্ড টেস্ট সিরিজে ইংলিশরাই নিশ্চিত ফেবারিট। কিন্তু চট্টগ্রামের প্রথম টেস্টে ২২ রানের জয় পেতে অতিথিদের ঘাম ঝড়ে যায়। অনেকটা যেন হারতে হারতে বেঁচে যায় সফরাকিরা। ফয়সালা হয় পঞ্চম দিনে। অধিনায়ক এ্যালিস্টার কুক হাফ ছেড়ে বাঁচেন। দারুণ অলরাউন্ড পারফর্মেন্সে কুলীন ইংলিশদের কার্যত লজ্জা থেকে বাঁচিয়েছেন বেন স্টোকস। স্পিনবান্ধব উইকেটেও ইংলিশ পেসার যেভাবে বল করেছেন সেটি প্রশংসনীয়। গুরুত্বপুর্ণ মুহূর্তে তুলে নিয়েছেন ৪ ও ২টি করে উইকেট। পাশাপাশি ব্যাট হাতে ১৮ ও ৮৫ রানের দায়িত্বশীল ইনিংস উপহার দিয়ে হয়েছেন ম্যাচসেরা। অধিনায়ক কুক তাই রুদ্ধশ্বাস জয়ের ম্যাচে স্টোকসকে ‘এক্স-ফ্যাক্টর’ বলে অভিহিত করেছেন! ইংল্যান্ড ২৯৩ ও ২৪০ রানে অলআউট হয়। বাংলাদেশ ২৪৮ ও ২৬৩। ম্যাচে টাইগাররা শক্তিধর ইংলিশদের এভাবে কাঁপিয়ে দেবে- অধিনায়ক কুক, ‘নায়ক’ স্টোকস কেউই সেটি কল্পনা করেননি। তাদের বক্তব্যেই সেটি উঠে এসেছে। কুক বলেন, ‘আমি সত্যিই ভেবেছিলাম ২৮৫ রানের লিড যথেষ্ট। চিন্তাও করতে পারিনি চতুর্থ ইনিংসে ওরা (বাংলাদেশ) এত কাছাকাছি চলে যাবে। বিশেষ করে স্বাগতিক ব্যাটসম্যানরা যেভাবে স্পিন সামলেছে, সেটি ছিল মুগ্ধ করার মতো। টেস্টে দীর্ঘ বিরতির পর ফেরা বাংলাদেশের লড়াকু খেলার প্রশংসা করতেই হয়।’ শেষ দিনে ৩৩ রানের মধ্যে বাংলাদেশের ২ উইকেট তুলে নিতে ইংলিশ অধিনায়কের ভেতর আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি ছিল না বলেও জানিয়েছেন কুক, ‘সত্যি বললে, আজ (পঞ্চম দিন) সকালেও আমি জয়ের ব্যাপারে খুবই আত্মবিশ্বাসী ছিলাম। ২ উইকেটে ৩০Ñএর বেশি রান.. তাদেরও (বাংলাদেশ) হয়ত হাফ চান্স ছিল। তবে জানতাম আমরা সুযোগ তৈরি করতে পারব। স্বাচ্ছন্দ্যে ছিলাম, এবং শেষ পর্যন্ত সেটা করতে পেরেছি।’ কঠিন থেকে কঠিন হতে থাকা চট্টগ্রামের উইকেটে শেষ ইনিংসে বাংলাদেশের লক্ষ্য ছিল ২৮৬। ওই অবস্থায় কুক ধরেই নিয়েছিলেন তারা যথেষ্ট নিরাপদ। টাইগাররা এতটা কাছাকাছি চলে আসবে, সেটিই কেবল ভাবতে পারেননি ইংল্যান্ড ইতিহাসের সর্বোচ্চ টেস্ট রান সেঞ্চুরির মালিক। শেষ পর্যন্ত ম্যাচ জেতায় স্বস্তি পাচ্ছেন। অনুকূল কন্ডিশনে আদিল রশীদ-মঈন আলীদের স্পিন আক্রমণ এবং প্রতিকূলে পেস বোলিং-অলরাউন্ডার বেন স্টোকসের দুরন্ত নৈপুণ্যে সন্তুষ্ট কুক। গুরুত্বপুর্ণ মুহূর্তে তুলে নিয়েছেন ৪ ও ২টি করে উইকেট। পাশাপাশি ব্যাট হাতে ১৮ ও ৮৫ রানের দায়িত্বশীল ইনিংস উপহার দিয়ে হয়েছেন ম্যাচসেরা। অধিনায়ক কুক তাই স্টোকসকে ‘এক্স-ফ্যাক্টর’ ক্রিকেটার বলে অভিহিত করেছেন, ‘স্টোকস স্কোয়াডে দারুণ ভারসাম্য এনে দিয়েছে। ব্যাটিং কিংবা বোলিং- দলের প্রয়োজেন সে যে কোনো সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। সত্যি বলতে ওর নৈপুণ্যে দারুণ খুশি আমি।’ শেষ দিনের ২ উইকেট নয়, প্রথম ইনিংসের ব্যাটিংটাই চট্টগ্রাম টেস্টে পার্থক্য গড়ে দিয়েছেন বলে মনে করেন অতিথি অধিনায়ক, ‘এটা মনে রাখার মতো দুর্দান্ত একটা টেস্ট। শুরুতে ভাবতেও পারিনি খেলা পঞ্চম দিনে গড়াবে। অনেক চড়াই-উৎরাই ছিল। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল তৃতীয় দিনের শরুটা। তখনও বাংলাদেশ ৭০-৮০ রানে পিছিয়ে, হাতে ৫ উইকেট। এরপরও আমরা লিড পেয়েছি। সেটিই ছিল আসল পার্থক্য। ওই মুহূর্তেও স্টোকস অসাধারণ বল করেছে।’ ম্যাচের নায়ক স্টোকস বলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম ২৮০ (আসলে ২৮৬) রান আমাদের জন্য অনেক। কখনই ভাবিনি এ ম্যাচ এত ক্লোজ হবে। তারা (বাংলাদেশ) যেভাবে স্পিন খেলেছে, তা খুবই অভূতপূর্ব।’ চতুর্থ ইনিংসে বাংলাদেশকে ২৮৬ রানের লক্ষ্য দিয়েছিল ইংল্যান্ড। লক্ষ্যটা খুব বড় না হলেও চট্টগ্রামের টার্নিং সেøা উইকেটে এ লক্ষ্যই ছিল বিশাল। তবে উল্টো টাইগার ব্যাটসম্যানদের তীব্র প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয় সফরকারীদের। এমন লড়াই করার পর বাংলাদেশকে কৃতিত্ব দিতে ভোলেননি স্টোকস। নিজেদের কন্ডিশনে অভ্যস্ত থাকায় স্বাগতিকরা এমনটা খেলতে পেরেছে বলেও মনে করেন তিনি, ‘বাংলাদেশ তাদের কন্ডিশনে নিয়মিত হওয়ায় স্পিন বল দারুণ মোকাবেলা করেছে। অবশ্যই তাদের কৃতিত্ব দিতে হবে, বিশেষ করে যেভাবে চতুর্থ ইনিংসে ব্যাটিং করেছে।’ ৩৩ রানের লক্ষ্য নিয়ে সোমবার শেষ দিন সকালে মাঠে নামেন বাংলাদেশের দুই অপরাজিত ব্যাটসম্যান সাব্বিরর রহমান এবং তাইজুল ইসলাম। আর ১০ রান যোগ করতেই গুটিয়ে যায় টাইগারা। দুর্দান্ত অলরাউন্ড নৈপুণ্যে পার্থক্য গড়ে ‘নায়ক’ বেন স্টোকস। বাংলাদেশ সফরে আচরণগত কারণে সমালোচিত হওয়া এ অলরাউন্ডার খলনায়কে পরিণত হয়েছিলেন। ওয়ানডে সিরিজের সেরা খেলোয়াড় হয়ে বাংলাদেশকে হারানোর কারণেও যেন বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে খলনায়ক হয়েছেন তিনি। তবে ইংল্যান্ডের জন্য ওয়ানডে সিরিজের পর প্রথম টেস্টেও মহানায়ক হয়ে গেলেন ২৫ বছর বয়সী এ তরুণ। পঞ্চম দিনে স্বীকৃত ব্যাটসম্যান সাব্বির রহমানের সঙ্গে তাইজুল ইসলাম যে আত্মবিশ্বাসী মনোভাবে শুরু করেছিলেন তাতে করে প্রথম তিন ওভারে সেই আশঙ্কা আরও জেঁকে বসেছিল ইংল্যান্ড দলের ওপর। কিন্তু দিনের চতুর্থ ওভারে তিনটি ডেলিভারিতেই সেসব শঙ্কা কাটিয়ে দলকে বিজয়ী করলেন স্টোকস। প্রথম বলেই তাইজুলকে এলবিডব্লিউ করে ফিরিয়ে দেন। তখনও জয় থেকে ২৩ রান দূরে বাংলাদেশ। ব্যাট হাতে শফিউল ইসলাম আগেও ইংল্যান্ড দলকে ব্যাট হাতে ভোগান্তি উপহার দিয়ে দুবার হারিয়ে দিয়েছেন (ওয়ানডেতে)। এবার তাকে সে সুযোগ দেননি স্টোকস, ওই ওভারের তৃতীয় বলেই আবার এলবিডব্লিউ করে শফিউলকে সাজঘরে পাঠিয়ে দলের জয় নিশ্চিত করেন। ২৬৩ রানে গুটিয়ে বাংলাদেশের দ্বিতীয় ইনিংস। ২২ রানের নাটকীয় জয় দিয়ে রোমাঞ্চকর চট্টগ্রাম টেস্টে হাসিটা হেসেছে ইংল্যান্ড। ওয়ানডে সিরিজেও এভাবেই দলকে দুটি ম্যাচ জিতিয়ে সিরিজসেরা হয়েছিলেন স্টোকস। টেস্ট সিরিজের প্রথম ম্যাচেও তিনি সেটাই করলেন। প্রথম ইনিংসে ব্যাট হাতে মাত্র ১৮ রানে ফিরে গেলেও, নিশ্চিত লিড নেয়ার পথে এগোতে থাকা বাংলাদেশকে প্রথম ইনিংসে ২৪৮ রানে গুটিয়ে দিয়েছেন তিনিই। তৃতীয় দিন সকালে তার গতির ঝড়েই মাত্র ২৭ রানে ৫ উইকেট হারায় বাংলাদেশ। তিনটিই নিয়েছিলেন স্টোকস। সবমিলিয়ে ৪ উইকেট। ২৮৬ রানের টার্গেটে খেলতে নামা বাংলাদেশ যখন জয়ের স্বপ্নে বিভোর তখনও দুই উইকেট নিয়ে সেই স্বপ্নটাকে ধুলিসাৎ করেছেন। এর আগে ব্যাট হাতে ৮৫ রানের একটি দুর্দান্ত ইনিংস খেলেন ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় ইনিংসে। মাত্র ৬২ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে চরম বিপর্যয়ে পড়া দলকে রক্ষা করেন। ওয়ানডে সিরিজে মাঠে তর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের সঙ্গে। ম্যাচশেষে অভিবাদনের সময়ও বিতর্ক, দুদিনের দুটি প্রস্তুতি ম্যাচেও স্টোকস আচরণগত কারণে দেশ-বিদেশের মিডিয়ায় সমালোচিত হন। সেটা তার পারফর্মেন্সে ছাপ ফেলেনি।
×