ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ মামুন রশীদ

লড়াকু সাব্বির

প্রকাশিত: ০৬:৩৩, ২৬ অক্টোবর ২০১৬

লড়াকু সাব্বির

নিজেকে প্রমাণ করেছেন টেস্ট ব্যাটসম্যান হিসেবে। শেষ পর্যন্ত লড়াই করে থেকেছেন অপরাজিত। যতক্ষণ উইকেটে ছিলেন পরাজয়ের ভীতিটা জেঁকে বসেছিল প্রতিপক্ষের ওপর। এরপরও ম্যাচশেষে মুষড়ে পড়লেন, অসাড় দেহে অনেকক্ষণ মাথা নিচু করে, হাঁটু মুড়ে বসে থাকলেই উইকেটে। কারণ, সহযোদ্ধারা ব্যর্থ হয়েছেন তাঁকে ইতিহাস গড়ার সুযোগটা কাজে লাগিয়ে দেশের জন্য গৌরবজনক এক জয় ছিনিয়ে আনার ক্ষেত্রে। দলের পরাজয়টা ছিল বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের। শেষ পর্যন্ত জয়ের যে আশা টিকে ছিল সেটা টেস্ট অভিষেক হওয়া ব্যাটসম্যান সাব্বির রহমানের হার না মানা ৬৪ রানের দারুণ ইনিংসের কল্যাণেই। কিন্তু যেখানে দল হেরেছে, স্বপ্ন ভেঙ্গে গেছে পুরো দেশের মানুষের সেখানে হতাশায় মুষড়ে তো পড়বেনই সাব্বির রহমান রুম্মান। টি-২০ স্পেশালিস্ট তকমা আগেই দিয়ে রেখেছিল সবাই। কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটে নিজের যোগ্যতা ও সামর্থ্য ঠিকই প্রমাণ করলেন তিনি। দেশের পক্ষে টেস্ট ক্রিকেটের চতুর্থ ইনিংসে সর্বোচচ ব্যক্তিগত ইনিংস উপহার দিলেন। টি-২০ স্পেশালিস্ট আর ওয়ানডেতে রান বাড়ানোর মোক্ষম অস্ত্র। সেই সাব্বির রহমানকেই টেস্ট দলে নেয়ার পর মৃদু গুঞ্জন উঠেছিল দীর্ঘ পরিসরের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তিনি কতখানি যোগ্য। তবে চট্টগ্রাম টেস্টের পর সেই তীর্যক প্রশ্নগুলো ধুয়েমুছে নিজের যোগ্যতা ও সামর্থ্য প্রমাণ করেছেন। এমনকি দল এবং পুরো বাংলাদেশেরই অন্যতম ভরসার নাম হয়ে গিয়েছিলেন ঐতিহাসিক কিছু ঘটানোর প্রত্যাশায়। তবে সেটা পূরণ করতে পারেননি সঙ্গীদের ব্যর্থতায়। শেষদিনে জয়ের জন্য ৩৩ রানের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সাব্বিরের সহযোদ্ধারা একেবারেই দুর্বল! কারণ, সঙ্গী হিসেবে ব্যাট হাতে ক্রিজে ছিলেন দুই স্পেশালিস্ট বোলার তাইজুল ইসলাম ও শফিউল ইসলাম। তারা বিদায় নিয়েছেন। ৬৪ রান করে অপরাজিত থাকলেও দলের পরাজয়ে মহানায়ক হতে পারেননি। নিজে না হেরেও সে কারণে পরাজিতই হয়েছেন। বাংলাদেশের পক্ষে চতুর্থ ইনিংসে সেরা হয়ে গিয়েছিলেন আগের দিনই অর্ধশতক হাঁকিয়ে। দলকে জেতানোর সুযোগটাও এসেছিল। কিন্তু অভিষেকেই নায়ক হওয়া হলোনা এ ২৪ বছর বয়সী ডানহাতি ব্যাটসম্যানের। শুরু থেকেই একক লড়াই চালিয়েছেন সাব্বির টেস্ট মেজাজে ব্যাটিং করেই। চট্টগ্রাম টেস্টে চতুর্থ দিনে বাংলাদেশ ২৮৬ রানের জয়ের লক্ষ্য নিয়ে খেলতে নামে। ১৪০ রানে ৫ উইকেট হারানোর পর ক্রিজে আসেন সাব্বির। ওয়ানডে ও টি-২০ ক্রিকেটে একজন মেজাজী ও আক্রমণাত্মক ব্যাটসম্যান হিসেবে পরিচিতি থাকলেও টেস্ট টেম্পারামেন্ট তার কতটা থাকবে সেটা নিয়ে শঙ্কা ছিল। কিন্তু শুরু থেকেই নিজেকে সুস্থির রেখে ঠা-া মাথায় খেলে গেছেন সাব্বির। প্রথম ইনিংসে ৮ নম্বরে নেমে দারুণ খেলছিলেন। কিন্তু ১৯ রান করার পর সাজঘরে ফিরেছেন বেন স্টোকসের পেসে সিøপে ক্যাচ দিয়ে। দ্বিতীয় ইনিংসে একইভাবে স্বাচ্ছন্দ্যে শুরু করেন সাব্বির। দারুণ খেলে ষষ্ঠ উইকেটে অধিনায়ক মুশফিকুর রহীমের সঙ্গে ৮৭ রানের দারুণ জুটি গড়ে দলকে এগিয়ে নিয়েছেন জয়ের প্রত্যাশা পূরণের পথে। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে এটি ষষ্ঠ উইকেটে বাংলাদেশের দ্¦িতীয় সেরা জুটি। তবে মুশফিক দিনের শেষভাবে সাজঘরে ফিরে যান। তখনও বাংলাদেশ দল ৫৯ রান দূরে জয় থেকে। এরপর আরেক অভিষিক্ত তরুণ মেহেদি হাসান মিরাজ ও কামরুল ইসলাম রাব্বি উইকেটে এসে বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি। মেহেদি ১ ও রাব্বি ০ রানে ফিরে গেলে ২৩৮ রানেই ৮ উইকেট হারিয়ে নিশ্চিত পরাজয়ের শঙ্কায় পড়ে বাংলাদেশ। তিন ব্যাটসম্যানকে বিদায় নিতে দেখলেও সাব্বির হাল ছাড়েননি। ক্যারিয়ারের অভিষেক টেস্টে দ্বিতীয় ইনিংস খেলতে নেমেই পেয়ে গেছেন অর্ধশতক। এটি বাংলাদেশের পক্ষে অভিষেকে অর্ধশতক বা তার বেশি রান করার এটা ১৫তম ঘটনা। তিনটি সেঞ্চুরি ও ১২টি হাফসেঞ্চুরি আছে। আর কোন টেস্ট ম্যাচে বাংলাদেশের নিজেদের দ্বিতীয় ইনিংসে অভিষিক্ত কোন ব্যাটসম্যানের অর্ধশতক হাঁকানোর এটি সপ্তম ঘটনা। তবে ম্যাচের চতুর্থ ইনিংসের আগে কোন বাংলাদেশী ব্যাটসম্যান অভিষেকে অর্ধশতক করতে পারেননি। মানজারুল ইসলাম রানা ও মার্শাল আইয়ুব উভয়ে ৩১ রান করে করেছিলেন নিজেদের অভিষেক টেস্টের চতুর্থ ইনিংসে। সবাইকে ছাড়িয়ে এখন সবার ওপরে সাব্বির। শেষ পর্যন্ত তাইজুল ইসলামকে নিয়ে আরও ১৫ রান যোগ করেছেন সাব্বির নবম উইকেটে। জয়ের যে স্বপ্ন সেটা পূরণের জন্য শুধু সাব্বিরই ভরসা ছিলেন। তিনিই বাংলাদেশ দলকে জয় পাওয়ার মতো একটি অবস্থানে নিয়ে আসেন। এর আগে বাংলাদেশের কোন অভিষিক্ত ব্যাটসম্যানের ওপরই টেস্ট ক্রিকেটে টার্গেট নিয়ে খেলার সময় এমন গুরুদায়িত্ব চাপেনি। এই চাপ সামলে তিনি দলকে জেতাতে পারলে অন্যরকম এক ইতিহাস লেখা হতো বাংলাদেশের ক্রিকেটে। কারণ এর আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজের দ্বিতীয় সারির দলের বিরুদ্ধে টেস্ট জিতেছিল বাংলাদেশ। নিয়মিত খেলোয়াড়রা বিদ্রোহ করার কারণে একজনও ছিলেন না ২০০৯ সালে হওয়া সেই সিরিজে। এরপর জিম্বাবুইয়ে ছাড়া আর কোন দলকে টেস্টে হারাতে পারেনি বাংলাদেশ দল। ইংলিশরা ২০১৪ সালেও বিশ্বসেরা টেস্ট দলে পরিণত হয়েছিল। বর্তমানেও তাদের অবস্থান চার নম্বরে। ভগ্নাংশের ব্যবধানে পিছিয়ে আছে তিনে থাকা অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে। তাদের বিরুদ্ধে জয় আসলে দেশের ক্রিকেটে এক গৌরবজনক অধ্যায়ের সূচনা হতো। আর সেটা রচনা করার সুযোগ ছিল সাব্বিরের হাতেই। অভিষেক টেস্টে উভয় ইনিংসে অর্ধশতাধিক রান করার দেশীয় রেকর্ডটা অবশ্য হাতছাড়া হয়েছে তার। ২০০১ সালের এপ্রিলে জিম্বাবুইয়ের বিরুদ্ধে বুলাওয়েতে অভিষেক টেস্টের উভয় ইনিংসে জাভেদ ওমর বেলিম করেছিলেন অপরাজিত ৮৫ ও ৬২। আর ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে ডানেডিনে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে অভিষেক টেস্টে তামিম ইকবাল করেছিলেন ৮৪ ও ৫৩ রান। কিন্তু সেসব ম্যাচের চতুর্থ ইনিংসে ছিল না, সাব্বিরই প্রথম। টেস্ট ইতিহাসে ম্যাচের চতুর্থ ইনিংসে অভিষিক্ত ক্রিকেটারের অর্ধশতাধিক রান করার ঘটনা এটা নিয়ে ৪৫তম। আছে ৭টি সেঞ্চুরিও। তবে অর্ধশতাধিক রান করে অভিষেকেই দলকে জেতানোর ঘটনা ছিল মাত্র ১৫টি। একমাত্র সেঞ্চুরি আছে পাকিস্তানের ইয়াসির হামিদের। তিনি ১০৫ রান করেছিলেন ২০০৩ সালের আগস্টে করাচীতে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। সেই গৌরবজনক ঘটনার অংশ হওয়ার সুযোগ থাকলেও সঙ্গীর অভাবে সেটা হয়নি সাব্বিরের। বাংলাদেশের গৌরবময় অধ্যায় রচনা করে মহানায়ক হয়ে ওঠা যায়নি। পঞ্চম দিনে দারুণ আত্মবিশ্বাস নিয়ে খেলেছেন সাব্বির। প্রথম তিনটা ওভার নির্বিঘেœই কাটিয়ে ১০ রান তুলে ফেলে জয়ের আরও কাছে চলে যায় বাংলাদেশ। কিন্তু দিনের চতুর্থ ওভারেই সর্বনাশটা ঘটে গেল। সাব্বির অপরপ্রান্তে দাঁড়িয়ে দেখলেন স্টোকসের ধ্বংসলীলায় তার দুই সহযোদ্ধা তাইজুল আর শফিউলের বিদায়। ১০২ বলে ৩ চার ও ২ ছক্কায় ৬৪ রানের দারুণ এক ইনিংস খেলে অপরাজিত থাকলেন। তবে আক্ষেপ নিয়ে প্রশ্নটা উঠলই- সাব্বির কেন দিনের তৃতীয় ওভারের শেষ বলে রান নিয়ে তাইজুলকে স্ট্রাইক দিয়েছেন? এ বিষয়ে অধিনায়ক মুশফিকুর রহীম ব্যাখ্যা দিলেন। তিনি বলেন, ‘৩৩ রান তো সাব্বির একাই করতে পারবে না। গতকাল (রবিবার) শেষ দিকে তাইজুল খুব ভাল খেলছিল, আজও শুরুটা খুব ভাল করেছিল। এজন্য সিদ্ধান্ত নেয়া যে, যদি রান হয় রানটা নিয়ে নেয়া।’
×