ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আনসার আল ইসলাম, নব্য জেএমবিও নিষিদ্ধ হচ্ছে শীঘ্রই

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ২৬ অক্টোবর ২০১৬

আনসার আল ইসলাম, নব্য জেএমবিও নিষিদ্ধ হচ্ছে শীঘ্রই

শংকর কুমার দে ॥ খুব শীঘ্রই নিষিদ্ধ হচ্ছে আরও দুই জঙ্গী সংগঠন আনসার আল ইসলাম ও নব্য জেএমবি। প্রায় দুই মাস আগে জঙ্গী হামলা ও একাধিক লেখক-ব্লগার হত্যার অভিযোগে এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দাখিল করেছে পুলিশ। গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার পর একের পর এক জঙ্গী হামলা ও জঙ্গী বিরোধী অভিযানের ঘটনায় জঙ্গী সংগঠন নব্য জেএমবির তৎপরতা সামনে চলে আসায় এই জঙ্গী সংগঠনটি নিষিদ্ধ করার জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে এ খবর জানা গেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত আগস্ট মাসে পুলিশ সদর দফতরের মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জঙ্গী সংগঠন আনসার আল ইসলামকে নিষিদ্ধ করার জন্য প্রতিবেদন পাঠিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। আনসার আল ইসলামের মতোই জঙ্গী সংগঠন নব্য জেএমবিকে নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দেশে জঙ্গী তৎপরতার অভিযোগে এ পর্যন্ত ৬টি সংগঠনকে জঙ্গী কার্যক্রমের অভিযোগে নিষিদ্ধ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ২০০৩ সালে শাহাদত-ই-আল হিকমা, ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরে হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ, ২০০৬ সালের ২২ জানুয়ারি জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) ও জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজেবি), ২০০৯ সালের ২২ অক্টোবর হিয্্বুত তাহরীর এবং ২০১৫ সালের ২৫ মে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নিষিদ্ধ করা হয়। এখন আবার আনসার আল ইসলাম ও নব্য জেএমবিকে নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে আনসার আল ইসলাম তাদের সাংগঠনিক কাঠামো তৈরি করে। যার প্রধান সমন্বয়ক ঢাকার একটি মাদ্রাসার সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন। বছর তিনেক ধরে তিনি আত্মগোপনে থেকে সংগঠনটি পরিচালনা করে আসছেন। এই সংগঠনের সামরিক কমান্ডার হিসেবে কাজ করছে সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ মোঃ জিয়াউল হক। এছাড়া এই সংগঠনের আরেক আধ্যাত্মিক নেতা জসিমউদ্দিন রাহমানী গ্রেফতার হয়ে বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। এর আগে ২০১৫ সালের ২৫ মে পুলিশ সদর দফতরের এক সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আনসারুল্লাহ বাংলা টিমকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। জঙ্গী কার্যক্রমের অভিযোগে বর্তমানে দেশে ৬টি সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। জঙ্গী বিরোধী তদন্তের সঙ্গে গোয়েন্দা সংস্থার একজন একজন কর্মকর্তা বলেন, ২০১৪ সালের ৪ সেপ্টেম্বর আল-কায়েদা নেতা আইমান আল জাওয়াহিরি ভারতীয় উপমহাদেশে আল-কায়েদা ইন ইন্ডিয়ান সাব-কন্টিনেন্ট (একিউআইএস) নামে নতুন একটি শাখার ঘোষণা করে। মূলত একিউআইএস ঘোষণার পরপরই আনসার আল ইসলামের সাংগঠনিক কাঠামো তৈরি হয়। আনসার আল ইসলামের সাংগঠনিক কাঠামোতে প্রধান সমন্বয়কের পর তিনটি ভাগ রয়েছে। এর একটি হলো ‘দাওয়া’ বিভাগ। যাদের কাজ হলো সংগঠনে নতুন সদস্য সংগ্রহ করা। এছাড়া সংগঠনের নেতাকর্মীদের বাসা ভাড়া করে দেয়াসহ বিভিন্ন রকম লজিস্টিক সাপোর্ট দিয়ে থাকে। অপর বিভাগটি হলো ‘আশকারি’ বিভাগ। এই বিভাগকে সামরিক বিভাগও বলা হয়ে থাকে। মূলত এই বিভাগের প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করেন পলাতক জিয়া। এছাড়া ‘মিডিয়া ও আইটি’ নামে আরেকটি বিভাগ রয়েছে। যাদের কাজ হলো নিজেদের মতাদর্শ প্রচার ও পারস্পরিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে নানা রকম এ্যাপসসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাত থেকে বাঁচার নানারকম কৌশল নিয়ে কাজ করে। জঙ্গী বিরোধী তদন্ত সূত্র জানায়, ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের সাম্প্রতিক উত্থানের বিষয়টি প্রথম সামনে আসার সঙ্গে আনসার আল ইসলাম নামের জঙ্গী সংগঠনটির প্রচার প্রকাশ পায়। ওই হত্যামামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের আমির মুফতি জসীমউদ্দীন রাহমানী কারাভোগ করছেন। একসময় আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামে একটি ফেসবুক গ্রুপ ছিল। তারা অনলাইনে প্রচার চালাত। এই আনসারুল্লাহ বাংলা টিমই পরে আনসার আল ইসলাম নামে আত্মপ্রকাশ করে, যারা বাংলা টিমের ব্যানারে কাজ করতেন, তারাই আনসার আল ইসলামে কাজ করা শুরু করেন। আনসার-আল-ইসলাম ড. অভিজিৎ রায়, প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন, বগার নিলাদ্রী নীলয়, ওয়াশিকুর বাবু, নাজিম উদ্দিন সামাদ, জুলহাস মান্নান ও তনয় হত্যাকা-ের ও হত্যা চেষ্টার মতো ঘটনার দায় স্বীকার করেছে। ২০১৫ সালের নবেম্বরের দিকে ৩৪ জনকে হত্যার হিটলিস্ট প্রকাশ করেছিল আনসার-আল-ইসলাম। লিস্টে বিশিষ্ট কলামিস্ট আব্দুল গাফফার চৌধুরী, অধ্যাপক ড. জাফর ইকবাল, একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাহী সভাপতি শাহরিয়ার কবির, ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন, ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ, গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার, কবি নির্মলেন্দু গুণ, লেখক তসলিমা নাসরিন, সাংবাদিক আবেদ খানসহ আরও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নাম উল্লেখ করা হয়। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের একজন কর্মকর্তা জানান, গত ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ জঙ্গী হামলার মধ্য দিয়ে দেশ-বিদেশে আত্মপ্রকাশ ঘটায় নব্য জেএমবি জঙ্গী সংগঠনটি। তারপর থেকে গত সাড়ে ৩ মাসে যেই ৯টি বড় ধরনের জঙ্গী বিরোধী অভিযান পরিচালিত হয়েছে, যা ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। এই ৯টি জঙ্গী হামলা ও জঙ্গী বিরোধী অভিযানের মধ্যে রয়েছে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি, কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় জঙ্গী হামলা, কল্যাণপুর, মিরপুর, আজিমপুর, নারায়নগঞ্জ, টাঙ্গাইল, গাজীপুর ও সর্বশেষ সাভারের আশুলিয়ায়। নব্য জেএমবির প্রধান নব্য জেএমবির প্রধান প্রধান আবদুর রহমান ওরফে সারোয়ান জাহান ওরফে আবু ইব্রাহিম আল হানিফ, প্রধান সমন্বয়ক তামিম আহমেদ চৌধুরী, সামরিক কমান্ডার ও প্রশিক্ষক সেনা বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর জাহিদুল ইসলাম ওরফে মেজর মুরাদসহ প্রায় ৩৩ জঙ্গী নিহত হওয়ার পর এখন নব্য জেএমবির জঙ্গী সংগঠনটির তৎপরতা আপাতত বন্ধ দেখা যাচ্ছে। তবে যে কোন সময়ে পলাতক জঙ্গীরা নতুন নেতৃত্বে তৎপরতা যাতে শুরু করতে না পারে সেজন্য জঙ্গী বিরোধী অভিযানের পাশাপাশি জঙ্গী সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে পুলিশ প্রশাসন। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তদন্ত সূত্র জানান, মূলত ২০০৫ সালের বোমা নিয়ে হামলার পর চাপাতি ও ধারালো অস্ত্রে লেখক, প্রকাশক, অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট, পুরোহিত, যাজক, শিয়াদের ওপর বিচ্ছিন্ন হামলার পর এই বছর গুলশানে কূটনীতিক পাড়ায় হলি আর্টিজান বেকারিতে অত্যাধুনিক অস্ত্র নিয়ে এক হামলায় ১৭ বিদেশীকে হত্যার সাক্ষী হয় বাংলাদেশ। এর মধ্যেই নতুন নতুন দলের খবর আসে, তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারে জঙ্গীদের পারদর্শিতাও উন্মোচিত হয়, হামলার পর নানা নামে ইন্টারনেটে বার্তাও আসতে থাকে, আইএস কিংবা আল কায়দার মতো আন্তর্জাতিক জঙ্গী গোষ্ঠীর নামে হয় দায় স্বীকারও। তবে সেই ১১ বছর পর ঘুরেফিরে আবার ফিরে এসেছে ২০০৫ সালের সেই জেএমবির নামই, তবে নব্য জেএমবি নামে। পুুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের একজন কর্মকর্তা বলেন, এক সময়ে জঙ্গী হিসেবে মাদ্রাসা ছাত্রদের নাম এলেও এখন তাদের সঙ্গে বিদেশ থেকে পড়ে আসা এবং দেশের নামী সরকারী-বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদেরও দেখা যাচ্ছে এই ‘নব্য জেএমবিতে’। আধুনিক শিক্ষায় বেড়ে ওঠা সচ্ছল পরিবারের এই তরুণ-যুবকদের তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের পারদর্শিতায় গোয়েন্দাদের তদন্তেও নতুন পথ খুঁজতে হচ্ছে। জঙ্গী সংগঠন দুইটি নিষিদ্ধ করা হলে জঙ্গী সদস্যদের বিরুদ্ধে শাস্তি দেয়া সহজ হবে, অর্থনৈতিক সহযোগিতা হ্রাস পাবে, জঙ্গীরা মনোবল হারাবে, আরও দুর্বল হয়ে পড়বে।
×