ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আনন্দ সুন্দর পরম্পরা জয়নুলে

উজ্জ্বল রঙে আঁকা জীবন ছবি, শুকনো পাতার মর্মর

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ২৬ অক্টোবর ২০১৬

উজ্জ্বল রঙে আঁকা জীবন ছবি, শুকনো পাতার মর্মর

মোরসালিন মিজান ॥ দুই প্রজন্মের দুই শিল্পী। একজন প্রবীণ। তার অনেক দেখা চোখ। বহু নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে গিয়েছেন। অন্যজন নবীনা। প্রবীণের শিল্প দীর্ঘপথ তাকে অনুপ্রাণিত করেছে। সমৃদ্ধ করেছে। এখন উভয়ই বিভিন্ন মাধ্যমে স্বতন্ত্র ভাবনার বিস্তার ঘটিয়ে চলেছেন। চিন্তার ফারাক আছে। আবার মিলমিশটাও চোখে পড়ার মতো। এই মিলমিশের মুখ্য কারণ, তারা সম্পর্কে বাবা-মেয়ে। চারুকলা অনুষদের জয়নুল গ্যালারিতে একত্রিত হয়েছেন দুজন। যৌথ প্রদর্শনীর শিরোনাম- পরম্পরা। ‘পরম্পরা’ একটি স্বপ্নেরও নাম। বাবা শ্রীবাস বসাক স্বপ্ন দেখতেন আত্মজা ঊর্মিলা শুক্লার সঙ্গে যৌথ প্রদর্শনী করবেন। নিজে আর্ট কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন সেই ১৯৬৬ সালে। মেয়েও বাবার পথ অনুসরণ করেন। ততদিনে আর্ট কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ। এই অনুষদ থেকে ২০০২ সালে পাস দেন তিনি। এই সময়ের মধ্যে কোন একক প্রদর্শনী করেননি বাবা। মেয়ের সঙ্গে যৌথ প্রদর্শনী করার অপেক্ষায় কাটিয়ে দিয়েছেন! কিন্তু হবে হচ্ছে করেও হচ্ছিল না। সোমবার চারুকলার জয়নুল গ্যালারিতে ডানা মেলল স্বপ্ন। শিল্পী দু’জন বটে। কাজ খুব বেশি নয়। মোট ৩২টি শিল্পকর্ম। একটি গ্যালারির যেটুকু জায়গা, তারা সুন্দর ব্যবহার করেছেন। তাতেই অপলক চোখ। মন্ত্রমুগ্ধ হতে হয়। শিল্পী শ্রীবাস বসাকের অন্যতম বৈশিষ্ট্য- তিনি অহর্নিশ ছবি আঁকেন। কোন বিরতি দেন না। প্রদর্শনীতে সীমিত সংখ্যক কাজ। বাছাই করা ২২টি ছবি। তবে শিল্পীর কাজ সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা দেয়। শ্রীবাস লোকভাবনা দ্বারা তাড়িত। নিজের অনুভূতিগুলোকে উজ্জ্বল রঙে আঁকেন। পটুয়াদের যে শৈলী, তার ছবিতে স্বতন্ত্র উপস্থাপনা পায়। সাদা কাগজে মোটা কালির ড্রইংগুলো বিশেষ আকর্ষণ করে। জলরঙেও খুব সাবলীল। মাধ্যমটি ব্যবহার করে নারীকে আঁকেন শিল্পী। আবহমান গ্রাম বাংলা থেকে ফর্ম খুঁজে নিয়ে দৃশ্যমান করেন ‘সখী’। এই সখী যেন সকল প্রেমিক পুরুষের কল্পনাকে ছুঁয়ে দেয়। জলরঙে আঁকা ‘লীলাবালি’ তরুণী অভিন্ন নৃত্য দৃশ্য শতভাগ উপভোগ্য করে তোলে। নারীকে পরম ‘আশ্রয়’ হিসেবেও দেখান শিল্পী। একই মাধ্যমে তুলে আনেন গ্রামীণ ঐতিহ্যের হরেক অনুষঙ্গ। মিক্সড মিডিয়ায় করা কিছু কাজে চোখ আটকে যায়। মাছরাঙা পাখির ধ্যান যেন শিল্পীর সাধনা একাগ্রতারও প্রকাশ। ‘যাত্রা’ শিরোনামের কাজগুলো অনন্য সাধারণ। ‘রঙ্গমঞ্চ’ তার সিরিজ চিত্রকর্ম। সাদা কাগজে অজস্র মুখ ও মুখোশ আঁকেন শিল্পী। দিনে যা মুখ, রাতে তা মুখোশে ঢাকা পড়ে যায়। এভাবে জীবনের রঙ্গমঞ্চকে দৃশ্যমান করেন তিনি। ঊর্মিলা বসাকের কাজগুলোও শিল্পপ্রেমীদের খুব সহজে অধিকার করে নেয়। জীবনসঙ্গী রাহুল আনন্দের গানটির কথা প্রাসঙ্গিক হবে- ও ঝরা পাতা ও ঝরা পাতাগো/ তোমার সাথে আমার রাত পোহানো কথা গো/ তোমার সাথে আমার দিন কাটানো কথা...। এই ঝরা পাতা নিয়ে কাজ করেন ঊর্মিলাও। তার শিল্পকর্মের উপকরণ প্রয়োগবিধি সত্যি আকর্ষণীয়। শিল্পী ঝড়া পাতা সযত্নে কুড়িয়ে নেন। স্কেচবুকে চাপা দিয়ে রাখেন দিনের পর দিন। এভাবে শুকনো পাতা হয়ে ওঠে ক্যানভাস। তার পর পাতার গায়ে সুই সুতো দিয়ে নিজের কল্পনাকে গড়েন। টাঙ্গাইলের মেয়ে। বুনন শিল্পের সঙ্গে বহুকালের পরিচয়। পরিচয়টা দারুণ কাজে লাগান শিল্পী। ঊর্মিলার শুকনো পাতা শুকনো থাকে না। ঝরা পাতা নতুন প্রাণ পায়। সব মিলিয়ে চমৎকার প্রদর্শনী। ‘পরম্পরা’ আগামী ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত চলবে।
×