ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

মানসম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাপ কমানোর কার্যকর উদ্যোগ ॥ পিপিপির আওতায় উচ্চ মানের আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ২৬ অক্টোবর ২০১৬

মানসম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাপ কমানোর কার্যকর উদ্যোগ ॥ পিপিপির আওতায় উচ্চ মানের আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

বিভাষ বাড়ৈ ॥ বিদ্যুত ও জালানি, যোগাযোগসহ কয়েকটি খাতে ‘পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) প্রকল্পের সফল বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতায় এবার পিপিপি দৃশ্যমান হচ্ছে শিক্ষা খাতে। দেশের মাধ্যমিক স্তরে আন্তর্জাতিক মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে সরকার ও ব্যক্তি উদ্যোগে সারাদেশে আবাসিক স্কুল নির্মাণের পরিকল্পনা করছে সরকার। প্রথমে বিভাগীয় পর্যায়ে, পরে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে পিপিপির মাধ্যমে নির্মাণ করা হবে মানসম্মত আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এদিকে ঢাকা মহানগরীর মানসম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওপর চাপ কমাতে এবার পার্শ্ববর্তী ১০টি এলাকায় সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন উয়িং ইতোমধ্যেই শিক্ষা খাতের এ উদ্যোগ বাস্তবায়নে কাজ করছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফর সূত্রে জানা গেছে, সেকেন্ডারি এ্যাডুকেশন সেক্টর ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম’-এর (সেসিপ) সহায়তায় পিপিপি প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। কর্মকর্তারা বর্তমানে প্রকল্প উন্নয়ন পরিকল্পনা’ (ডিপিপি) তৈরির কাজ করছেন। প্রকল্পের কার্যক্রম ও অগ্রগতি জানাতে আগামীকাল রাজধানীর জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি (নায়েম) একটি কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছে। অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক এস এম ওয়াহিদুজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেছেন, বিদ্যুত ও জালানি, যোগাযোগসহ কয়েকটি খাতে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) প্রকল্পের সফল বাস্তবায়ন আমরা দেখেছি। মাধ্যমিক স্তরে আন্তর্জাতিক মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে সরকার ও ব্যক্তি উদ্যোগে আমরা আবাসিক স্কুল নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। প্রথমে বিভাগীয় পর্যায়ে, পরে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে পিপিপির মাধ্যমে নির্মাণ করা হবে মানসম্মত আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আমরা চাই প্রতিষ্ঠানগুলো হবে রেসিডেন্সিয়াল মডেল, ভিকারুন নিসা নূন, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল এ্যান্ড কলেজ, নটরডেম কলেজের মতো মানসম্মত প্রতিষ্ঠান। প্রকল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পিপিপির আওতায় প্রথমে দেশের বিভাগীয় শহরে এসব আবাসিক মডেল স্কুল নির্মাণ করা হবে। ইতিবাচক ফল এলে এরপর পর্যায়ক্রমে জেলা, উপজেলা পর্যায়েও নির্মাণ করা হবে। স্কুল পরিচালনার জন্য সরকার ও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ২০ থেকে ২৫ বছর মেয়াদী চুক্তি হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নে খরচ ধরা হয়েছে আড়াই হাজার কোটি টাকা। জানা গেছে, দেশে মাধ্যমিক স্তরে সরকারী স্কুলের চেয়ে বেসরকারী স্কুলের সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি। ব্যক্তি উদ্যোগে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা হলেও সরকারই মূলত অর্থ-সহায়তা দিয়ে থাকে। এ স্তরে সরকার বেসরকারী প্রতিষ্ঠানেই ব্যয় করে ৬৭ ভাগ অর্থ। বাজেটের বাকি অংশ সরকারী প্রতিষ্ঠানের পেছনে ব্যয় হয়। মূলত এসব কথা মাথায় রেখেই ব্যক্তি ও সরকারী উদ্যোগে হাইস্কুল নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। পিপিপি ঘোষণার পর ২০১০ সালে পিপিপি নীতিমালা ও কৌশল, ২০১২ সালে পিপিপি কারিগরি সহায়তা অর্থায়ন নীতিমালা (পিপিপিটিএএফ) এবং ২০১২ সালে পিপিপিটিএএফ কর্মসূচী এবং গত বছর পিপিপি আইন করা হয়েছে। এর বাইরে পিপিপি প্রকল্প বাস্তবায়নে বেসরকারী খাতকে আকৃষ্ট করতে গঠন করা হয়েছে ‘বাংলাদেশ ইনফ্রাস্ট্রাকচার ফিন্যান্স ফান্ড লিমিটেড’ (বিআইএফএফএল) নামের একটি কোম্পানি। প্রকল্পের সহকারী পরিচালক মোঃ হাফিজুর রহমান বলেন, পিপিপির মাধ্যমে মানসম্মত আবাসিক স্কুল নির্মাণ করা হলে শিক্ষা আরও যুগোপযোগী হবে। তিনি বলেন, শিক্ষায় আমরা অনেকদূর এগিয়েছি। তবে আন্তর্জাতিক মানসম্মত শিক্ষা নিয়ে আমাদের আরও অনেক কিছু করার আছে। পিপিপির আওতায় আমাদের লক্ষ্য প্রথমে বিভাগীয় পর্যায়ে, পরে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে করা হবে মানসম্মত আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এ কর্মকর্তা বলেন, আমরা চাই এসব প্রতিষ্ঠানের মান হবে রেসিডেন্সিয়াল মডেল, ভিকারুন নিসা নূন, নটরডেম কলেজের মতো। এদিকে রাজধানী ঢাকা মহানগরীর মানসম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওপর শিক্ষার্থীদের চাপ কমাতে এবার পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। শিক্ষার্থীর চাপ বাড়লেও ঢাকায় মানসম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাড়ছে না-শিক্ষাবিদসহ বিভিন্ন মহলের এমন অবস্থানের প্রেক্ষিতে এবার সম্পূর্ণ নতুন ও আধুনিক শিক্ষার সুযোগসম্পন্ন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার এ উদ্যোগ। জানা গেছে, ঢাকা শহরের আশপাশের দশটি এলাকায় একটি করে নতুন সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন করবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই হবে দুই শিফটের। যেখানে অন্তত ৩০ হাজার শিক্ষার্থীর মানসম্মত শিক্ষা প্রাপ্তি নিশ্চিত করা সম্ভত হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ক্রমবর্ধমান শিক্ষার্থীদের চাহিদা ও শিক্ষায় বৈষম্য নিরসনের লক্ষ্যে এসব বিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। নতুন হতে যাওয়া এসব স্কুলের প্রতিটিই হবে ঢাকা জেলার মধ্যে। তবে ঢাকা মহানগীর আশপাশের এলাকায়। প্রতিটির একাডেমিক ভবন হবে ১০ তলার। এসব প্রতিষ্ঠান নির্মাণ হলে ঢাকা শহরের হাতেগোনা মানসম্মত বিদ্যালয়ের ওপর চাপ কমবে বলে আশা করছেন কর্মকর্তারা। ঢাকা জেলার নবীনগর, ইপিজেড/আশুলিয়া, ধামরাই, পূর্বাচল, হেমায়েতপুর, জোয়ারসাহারা, সাইনবোর্ড, চিটাগং রোড, শাহজাহানপুর/নূরের চালা, ইকুরিয়া/ঝিলমিল এলাকায় নতুন বিদ্যালয় স্থাপন করা হবে। ‘ঢাকা শহর নিকটবর্তী এলাকায় দশটি সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন’ প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রস্তাবিত ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৬৬৬ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। এই অর্থ দিয়ে প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় জমি অধিগ্রহণ, প্রতি প্রতিষ্ঠানে একটি করে দশ তলা ভবন নির্মাণ, শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ, ল্যাব স্থাপন, খেলাধুলার সামগ্রী সরবরাহ, বই সরবরাহ ও অন্যান্য ব্যয় নির্বাহ করা হবে। নতুন বিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্পের বাস্তবায়ন মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) নতুন দশটি বিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। বর্তমানে ঢাকার মোট ৪৯টি থানায় ৩১টি সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং ১১টি সরকারী কলেজ রয়েছে। বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ এ শহরের প্রায় অর্ধেক থানায় কোন সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয় বা কলেজ নেই। দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা মহানগরীতেও জনসংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেলেও নতুন কোন সরকারী স্কুল-কলেজ স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়নি বহু বছর। এ অবস্থায় গত মহাজোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকনির্দেশনায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পূর্ণ সরকারী অর্থায়নে ৪৩৫ কোটি টাকা ব্যয় সাপেক্ষে “ঢাকা মহানগরীতে ১১টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও ৬টি মহাবিদ্যালয় (সরকারী) স্থাপন” প্রকল্পটি গ্রহণ করে। ১১টি নতুন সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও ৬টি কলেজের মধ্যে ১৪টি প্রতিষ্ঠানে ইতোমধ্যেই শিক্ষা কার্যক্রম চালু হয়েছে। কিন্তু জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত মামলা-মোকদ্দমার কারণে বাকি ৩টি প্রতিষ্ঠান স্থাপনের কাজ বিলম্ব হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে- হাজারীবাগ থানার অধীন কালুনগর মৌজায় একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও একটি মহাবিদ্যালয়, মোহাম্মদপুর থানার বরাব মৌজায় একটি মহাবিদ্যালয়, মিরপুর পল্লবী থানার অধীন দুয়ারীপাড়া মৌজায় একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও একটি মহাবিদ্যালয়। এছাড়া আছে সবুজবাগ থানার অধীন রাজারবাগ মৌজায় একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও একটি মহাবিদ্যালয়, বাড্ডা থানার অধীন দক্ষিণখান মৌজায় একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও একটি মহাবিদ্যালয়, মোহাম্মদপুরের ঢাকা গবঃকমার্শিয়াল ইনস্টিটিউট ক্যাম্পাসে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, উত্তরা থানার অধীন উত্তরখান মৌজায় একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, শ্যামপুর থানার অধীন জুরাইন মৌজায় একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মিরপুর দারুস সালাম থানার অধীন জহুরাবাদ মৌজায় একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং ভাষানটেক পুনর্বাসন প্রকল্পে একটি বিদ্যালয় ও একটি মহাবিদ্যালয়। নতুন দশ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় ঢাকার ১১ প্রতিষ্ঠানের সুযোগ সুবিধাগুলো নিশ্চিত করা হবে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। কোন কোন ক্ষেত্রে আরও আধুনিক সুবিধা প্রদানেরও চিন্তা ভাবনা চলছে। যেখানে দশতলা ভবনের থাকবে আধুনিক কম্পিউটার ল্যাব। নতুন পদক্ষেপ হিসেবে প্রতিটিতে প্রধান শিক্ষকের জন্য থাকবে কোয়ার্টার। প্রধান শিক্ষকের কক্ষ, সহকারী প্রধান শিক্ষকের কক্ষ, অফিস কক্ষ, কমনরুম এবং শিক্ষক মিলনায়তন থাকবে। প্রতিটি ভবনে ১০টি শ্রেণীকক্ষ থাকবে। প্রতিটি কক্ষে শিক্ষার্থী ধারণক্ষমতা কমপক্ষে ৪০ জন। তবে প্রয়োজনে বাড়ানোর মতো অবকাঠামো থাকবে।
×