ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

ঢাকার রাজপথ ও গলির নিত্যসাথী এই খোলা ডাস্টবিন

‘গলিটার কোণে কোণে জমে ওঠে, পচে ওঠে আমের খোসা ও আঁটি কাঁঠালের ভুতি...’

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ২৬ অক্টোবর ২০১৬

‘গলিটার কোণে কোণে জমে ওঠে, পচে ওঠে আমের খোসা ও আঁটি কাঁঠালের ভুতি...’

আরাফাত মুন্না ॥ আমাদের নগর জীবনে বিড়ম্বনা যেন পিছু ছাড়ছে না। নাগরিকদের অসচেতনতা বা কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনা যে কোন ভাবেই সৃষ্টি হচ্ছে একের পর এক বিড়ম্বনা। রাজধানী ঢাকায় বসবাসকারী নাগরিকদের নিত্য বিড়ম্বনার বিশেষ একটি নাম ডাস্টবিন। যেখানে সেখানে খোলা ডাস্টবিনগুলোর কারণে ভোগান্তি চরমে উঠেছে নগরবাসীর। বাড়ি থেকে বেরোলেই রাস্তার মোড়ে গলির আনাচে-কানাচে এসব ডাস্টবিনের কারণে দূষিত হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ। সরেজমিন দেখা যায় রাজধানীর আজিমপুর, ইরাকী মাঠ, নিউ মার্কেট, নীলক্ষেত, কাঁটাবন, হাতিরপুল, মগবাজার, বাংলামটর, রাজারবাগসহ সমগ্র ঢাকাতেই রয়েছে অসংখ্য খোলা ডাস্টবিন। বাদ যায়নি ভিআইপি সড়কগুলোও। ইস্কাটন গার্ডেনের ডেমোক্রেসি ওয়াচের সামনের খোলা ডাস্টবিনটি সমগ্র এলাকার পরিবেশ নষ্ট করে ফেলেছে। চকচকে ঝকঝকে সড়কের পাশে এমন একটি ডাস্টবিন দেখতে বড়ই বেমানান লাগে বলে জানালেন সেখানকার আক্তারুজ্জামান। এসব ডাস্টবিনের পাশ দিয়ে চলাচলের সময় নাকে কাপড় দিয়েও দুর্গন্ধ প্রতিহত করা যায় না, বলে জানান তিনি। নিউ মার্কেটে আগত হাজার হাজার ক্রেতাসাধারণকে খোলা ডাস্টবিনগুলোর পাশ দিয়েই চলাচল করতে হয়। নিউ মার্কেটসংলগ্ন বিশ্বাস বিল্ডার্সের নিবাসী রেণু আক্তার বলেন, বাচ্চাকে প্রতিদিন এখান দিয়েই স্কুলে নিয়ে যেতে হয়, ডাস্টবিনের গন্ধে বাচ্চা একদিন বমি করে অসুস্থ হয়ে গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কুয়েত-মৈত্রী হলের এক আবাসিক ছাত্রী জানান, ক্লাসে যাওয়ার পথে নিউ মার্কেটের সামনে যানজটে আটকা পড়লে তো আর কথাই নেই, মনে হয় যেন পুরো জামা কাপড় থেকেই গন্ধ বের হচ্ছে। ক্রেতাদের মতে, নিউ মার্কেটের মতো একটি জনবহুল এলাকায় এসব উন্মুক্ত ময়লা শুধু পরিবেশের জন্যই ক্ষতিকর নয়, তাদের স্বাস্থ্যের জন্যও হুমকিস্বরূপ। আজিমপুর ইরাকী মাঠ নিবাসী আমিনুল ইসলাম জানান, প্রতিদিন ভোরে মুক্ত বাতাস সেবনের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে বাড়ি থেকে বেরোলেই পরপর ৪টি ডাস্টবিন অতিক্রম করতে হয়, আর এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে তিনি কর্তৃপক্ষের নজরদারি আশা করেছেন। হাতিরপুল কাঁচাবাজার সংলগ্ন ডাস্টবিন নিয়ে এখানকার ক্রেতা এবং ব্যবসায়ীদের ক্ষোভের শেষ নেই। মাংস ব্যবসায়ী রফিক বলেন, ডাস্টবিনের কারণে সেখানে কুকুর ও কাকের যন্ত্রণা পোহাতে হয়। এতে বিরক্ত কাঁচাবাজারে আসা ক্রেতারাও। বৃষ্টির দিনে এই ডাস্টবিনগুলো আরও ভয়াবহ রূপ নেয়। রাস্তার পানির সঙ্গে ময়লা ও আবর্জনা মিশে একাকার হয়ে যায়। আর এই নোংরা পানির মধ্য দিয়েই স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গামী শিক্ষার্থী ও অফিসগামীদের চলাচল করতে হয়। ভুক্তভোগীরা মনে করেন রাতের বেলায় ময়লা অপসারণের ব্যবস্থা করা হলে এই বিড়ম্বনা থেকে সাধারণ মানুষ কিছুটা হলেও মুক্ত হতে পারবে। রাজধানীর স্কুলগুলোকেও পোহাতে হয় ডাস্টবিনের যন্ত্রণা। মগবাজার থেকে শুরু করে মালিবাগ, রাজারবাগ, কমলাপুর ও মতিঝিলের অধিকাংশ স্কুলের সামনেই রয়েছে ডাস্টবিন। কোথাও মূল গেটের সামনে, কোথাও গেট থেকে একটু দূরে রাখা হয়েছে ময়লার বড় ডাস্টবিন। সরেজমিনে দেখা যায়, রাজারবাগ পুলিশ লাইন স্কুল এ্যান্ড কলেজের গেটের সামনেই এক সঙ্গে তিনটি ডাস্টবিন রাখা হয়েছে। এখান থেকে রাজারবাগ পুলিশ লাইন স্কুল এ্যান্ড কলেজের ক্লাসরুমের দূরত্ব ১৫ মিটারের বেশি হবে না। সারাদিন মহল্লার ভেতর থেকে ভ্যান গাড়িতে করে ময়লা নিয়ে এখানে জমা করা হয়। কোন এক সময় সিটি করপোরেশনের গাড়ি গিয়ে তা নিয়ে যায়। এই ডাস্টবিনগুলোর ঢাকনা না থাকায় দুর্গন্ধ ছড়িয়ে এলাকার বাতাস দূষিত করছে। যার ভুক্তভোগী হচ্ছে পথচারীসহ স্কুলের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। পুলিশ লাইন স্কুল এ্যান্ড কলেজের অভিভাবক আল মামুন বলেন, বড়দের রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা অনেক বেশি। তাই হয়ত এই দুর্গন্ধে আমাদের তেমন কিছু হবে না। তবে শিশুদের এই দুর্গন্ধের পাশ দিয়ে নিয়মিত আনা নেয়া করা ঝুঁকিপূর্ণ। এমন উৎকট দুর্গন্ধের মধ্যে নিয়মিত ক্লাস করতে গিয়ে অনেক শিক্ষার্থী রোগাক্রান্ত হচ্ছে। তিনি বলেন, এত জায়গা থাকতে ডাস্টবিনগুলো কেন স্কুলের গেটের সামনে রাখতে হবে তার কোন কূল কিনারা পাই না। একটু দূরে রাখলে কি সমস্যা হয়? নাক চেপে হাঁটছে পথচারীরা ॥ রাজধানীর বাংলামটর মোটর পার্টস মার্কেটের সামনেই রাস্তার অর্ধেক জুড়ে রাখা রয়েছে ময়লার ডাস্টবিন। এই পথে যাতায়াতকারী পথচারীদের নাকে রুমাল চেপে বা নাক বন্ধ করে চলাচল করতে দেখা যায়। দিলু রোডের আগে একটি, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের গেটে দুইটি ডাস্টবিন রাখা আছে। এখানেই রয়েছে খ্রীস্টান মিশনারি স্কুলের গেট। মগবাজার পার হয়ে ওয়্যারলেস মোড়ে আরেকটি। এখান থেকে ৩০০ গজ দূরে যেতে না যেতেই প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশনের সামনে আরেকটি। এখানে কয়েকটি কোচিং সেন্টারের শাখা এবং একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। মৌচাক-মালিবাগ মোড় পার হয়ে সোনালী ব্যাংক স্টাফ ট্রেনিং কলেজের গেটে একটি। এখানে আরেকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মিলেনিয়াম বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এর প্রায় ১০০ গজের মধ্যে ঢাকা জিলা স্কুলের কোণায় আরেকটি ডাস্টবিন। ফকিরাপুল কাঁচাবাজারের সামনে রয়েছে বড় আকারের উন্মুক্ত ডাস্টবিন। অনেকটা জায়গা নিয়ে রাস্তার উপরেই ময়লা রাখা হয়। রাস্তার অর্ধেকজুড়ে খোলা আকাশের নিচে এমন ময়লা রাখায় এলাকার পরিবেশ দূষিত হয়। এর একটু দূরেই জোনাকী সিনেমা হলের পাশে একটি। ময়লা রাখা হয় শান্তিনগর কাঁচাবাজারের সামনে রাস্তার অর্ধেক জুড়ে। জনবহুল এলাকা ও রাস্তার মাঝখানে এমনভাবে ময়লা রাখায় পথচারীদের সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়। এ রাস্তার পথচারী আক্তার হোসেন জানান, রাস্তার পাশে হলেও ময়লা রাখার আলাদা জায়গা করা উচিত। এভাবে উন্মুক্তভাবে ময়লা ফেলে রাখার কারণে যে দুর্গন্ধ ছড়ায় তাতে চলাচল করা যায় না। পুরান ঢাকার চিত্র একই ॥ রাজধানীর পুরান ঢাকার পাকিস্তান মাঠ এলাকার পাশেই পড়ে আছে ময়লার স্তূপ। আর এই রাস্তা দিয়ে চলাচল করছে সারি-সারি রিক্সা, সিএনজিচালিত অটোরিক্সা, ভ্যান, প্রাইভেটকারসহ বিভিন্ন পরিবহন। অনেকটা ব্যস্ত এই রাস্তার প্রায় অর্ধেক জুড়ে আছে বিশাল ময়লার স্তূপ। পথচারীরা এই ময়লার স্তূপ দিয়েই নিজেদের চলাচলের জায়গা করে নিয়েছে। কারণ অনেকটা পরিস্থিতি মেনে নিতে যেন বাধ্য হয়েছে এলাকাবাসী। পথচারী রায়হান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, রাস্তার পাশে ময়লার স্তূপ থাকায় এর উপর দিয়ে চলাচল করতে হয় দুর্গন্ধ সহ্য করে। পাশের দোকানের মালিক বললেন, প্রতিদিনই দোকান খোলার পর থেকে এভাবেই ময়লাগুলো সামনে থাকে আর সেই সঙ্গে থাকে অতিরিক্ত দুর্গন্ধ। তিনি বলেন, আর কি কোন জায়গা নেই এইসব ময়লা ফেলার? রাস্তার পাশে ময়লা আর দুর্গন্ধের কারণে এলাকার স্কুলগামী ছোট শিশুরা খুব ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এদিকে বংশাল, নাজিরাবাজার, সিদ্দিক বাজার, সিক্কাটুলি, ইংলিশ রোড, নয়াবাজার, নবাবকাটারাসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে প্রায়ই একই চিত্র দেখা গেছে। রাস্তা আর মহল্লায় অভিন্ন দৃশ্যপট ॥ রাস্তা বা মহল্লা, সব জায়গাই ডাস্টবিনের চিত্র একই। ডাস্টবিনগুলো রাস্তার ওপরেই। ডাস্টবিনগুলোর কারণে রামপুরা-বাড্ডা-কুড়িল, মহাখালী মোড়, কলেজ গেট থেকে গাবতলী, মিরপুর ১ থেকে ১০ নম্বর, কাজীপাড়া-শেওড়াপাড়া, গুলশানের প্রধান প্রধান রাস্তায় ভয়াবহ যানজটের সৃষ্টি হয় বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব ডাস্টবিন যেমন রাস্তার প্রায় অর্ধেকটা দখল করে আঁকাবাঁকা অবস্থায় ফেলে রাখা হয়, তেমনি এগুলোর উপচে পড়া ময়লা-আবর্জনা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ায় রাস্তা আরও সংকুচিত হয়ে যায়। কয়েক বছর ধরেই মধ্যবাড্ডায় বিশ্বরোডের ওপর পাশাপাশি ছয়টি কনটেনার ডাস্টবিন এলোপাতাড়িভাবে ফেলে রাখা আছে। পথচারী-যাত্রীরা এ স্থানকে ‘অভিশাপ’ আখ্যা দিয়ে থাকেন। রাজধানীর গ্রিন রোডবাসী প্রতিদিন ঘর থেকে বেরিয়েই গলির মুখে আবর্জনার পাহাড় দেখতে পান। এতে পথচারীদের চলতে যেমন সমস্যা হয়, তেমনি দুর্গন্ধে আশপাশে থাকাটা কঠিন হয়ে পড়ে। প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তার বক্তব্য ॥ এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা কমোডর (বিএন) একেএম বখতিয়ার জনকণ্ঠকে বলেন, ঢাকার দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকার বর্জ্য ব্যবস্থানা কি ভাবে সুন্দর করা যায়, সে বিষয়ে অনেক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, কোন দেশের রাজধানীতে রাস্তার উপরে ডাস্টবিন থাকা উচিত না, সে জন্যই আমরা অনেক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। এক বছরের মধ্যে রাস্তার ওপর থেকে ডাস্টবিনগুলো সরানো সম্ভব হবে বলেও তিনি জানান।
×