ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

নতুন ফলক স্পর্শ

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ২৬ অক্টোবর ২০১৬

নতুন ফলক স্পর্শ

আনোয়ার রোজেন ॥ দেশের অর্থনীতি স্পর্শ করল নতুন মাইলফলক। দেশের ইতিহাসে এই প্রথম মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি আনুষ্ঠানিকভাবে সাত শতাংশের ঘর অতিক্রম করেছে। চূড়ান্ত হিসাবে গত অর্থবছরে (২০১৫-১৬) বাংলাদেশে ৭ দশমিক ১১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে, যা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রাক্কলিত হিসাবের চেয়ে বেশি। নয় মাসের (জুলাই-মার্চ) তথ্য বিশ্লেষণ করে চলতি বছরের এপ্রিলে বিবিএস বলেছিল, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৭ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ অর্জন করবে। কয়েক বছর ধরেই ছয় শতাংশের ঘরে আটকে ছিল দেশের প্রবৃদ্ধি। বিশ্বব্যাংক-এডিবি পূর্বাভাস দিয়েছিল গত অর্থবছরও ছয় শতাংশের ঘরেই থাকবে প্রবৃদ্ধি। কিন্তু উন্নয়ন সহযোগীদের পূর্বাভাস ভুল প্রমাণিত হয়েছে বিবিএসের চূড়ান্ত হিসাবে। সেই সঙ্গে জাতীয় বাজেটে প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্য ধরা হয়েছিল (৭ শতাংশ) তাও ছাড়িয়ে গেছে। তবে প্রবৃদ্ধি বাড়লেও মাথাপিছু আয় হয়েছে প্রাক্কলন থেকে এক ডলার কম, অর্থাৎ ১ হাজার ৪৬৫ ডলার। চূড়ান্ত হিসাবে ২০০৫-০৬ ভিত্তিবছর ধরে মঙ্গলবার এসব তথ্য প্রকাশ করেছে বিবিএস। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ যে এগিয়ে যাচ্ছে এটি তারই বড় প্রমাণ। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে চূড়ান্ত হিসাবে মাথাপিছু আয় ছিল এক হাজার ৩১৬ মার্কিন ডলার। এর আগের দুই অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ছিল যথাক্রমে ১ হাজার ১৮৪ ডলার এবং ১ হাজার ৫৪ ডলার। অর্থাৎ গত কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়ছে। দেশ যে দ্রত মধ্যম আয়ের দেশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এটি তারই লক্ষণ। কিন্তু এই অর্জন ধরে রাখাকে চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফিন্যান্স এ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তফা কে মুজেরি। তিনি বলেন, প্রাক্কলিত হিসাবের চেয়ে প্রবৃদ্ধি কম, বেশি বা কাছাকাছি হতে পারে। এ ক্ষেত্রে কাগজে-কলমে বেশি হয়েছে মনে হলেও আত্মতুষ্টির কারণ নাই। দেখা যাচ্ছে, শিল্পখাতে প্রবৃদ্ধি বেড়েছে, কিন্তু কৃষি খাতে কমেছে। এখন কোন কোন খাত এবং উপখাতে প্রবৃদ্ধি বেড়েছে এবং কেন বেড়েছে তা আরও পর্যালোচনার দাবি রাখে। তা না হলে এসব খাতে ভবিষ্যতে সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা কঠিন হবে। প্রবৃদ্ধি এবং সার্বিকভাবে মাথাপিছু আয় বাড়ায় দেশের মানুষকে অভিনন্দন জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে তিনি বলেন, এটি অর্জন সম্ভব হয়েছে দেশের সকল শ্রেণী ও পেশার মানুষের যার যার অবস্থান থেকে অবদান রাখার কারণে। তাই সকলে মিলে কাজ করে গেলে আমরা কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব। প্রধানমন্ত্রীর অভিনন্দনের বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। প্রবৃদ্ধি বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেছেন, তিন থেকে চার বছর আগেও বিশ্বব্যাংকের কোন প্রতিবেদনে শীর্ষ ৫০ দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম থাকত না। চলতি মূল্য ও পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি (পিপিপি)- এই দুই ভিত্তিতে তৈরি করা প্রতিবেদনগুলোতে বাংলাদেশের নাম থাকত ৫০ দেশের পরে। চলতি বছর বিশ্বব্যাংকের করা প্রতিবেদনে দুই ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ উন্নতি করেছে। জিডিপির চলতি মূল্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ৪৩তম আর পিপিপি’র ভিত্তিতে এ অবস্থান ৪৩তম। চূড়ান্ত হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশের জিডিপি’র আকার দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকা বা ২২১ বিলিয়ন ডলার। প্রসঙ্গত, বিবিএসের হিসাব মতে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ০৬ শতাংশ, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ছিল ৬ দশমিক ০১ এবং ২০১১-১২ অর্থবছরে ছিল ৬ দশমিক ৫২ শতাংশ। মাথাপিছু আয় এক ডলার কম হওয়া প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার বদলে যাওয়ায় গত মে মাসের প্রাক্কলনের সময় থেকে চূড়ান্ত হিসাবে মাথাপিছু আয় কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে তখন ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল ৭৮ টাকা ১৫ পয়সা, যা বর্তমানে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৮ টাকা ২৭ পয়সা। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় মাথাপিছু আয় ১ ডলার কম হয়েছে। মন্ত্রী জানান, বর্তমানে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ছে। গত তিন মাসে বিদেশী সরাসরি বিনিয়োগ বা এফডিআই বেড়েছে। প্রাক্কলনে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ায় চলতি অর্থবছরের বাজেটে ৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ঠিক করেছে সরকার। আশা করছি, এবারও বোনাস প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে। এসব কারণেই আগামী ৫ বছর হবে বাংলাদেশের জন্য। বিবিএস সূত্রে জানা গেছে, গত অর্থবছরে সেবা এবং শিল্প খাতের ওপর ভর করে প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ০৯ শতাংশ, যা এর আগের অর্থবছরে ছিল ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ। সেবা খাতে প্রবৃদ্ধি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৫ দশমিক ৮০ শতাংশ। তবে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমে হয়েছে ২ দশমিক ৭৯ শতাংশ, যা আগের অর্থবছর ছিল ৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সিনিয়র গবেষক ড. ফাহমিদা খাতুন জনকণ্ঠকে বলেন, উন্নত দেশগুলোতে শিল্পখাত ও সেবাখাতের তুলনায় কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি তুলনামূলকভাবে কমই হয়। তবে কৃষি ও সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি আরও বাড়ানোয় আমাদের মনোযোগ দিতে হবে। অবকাঠামোয় চীনা বিনিয়োগের ফলে আগামীতে শিল্প ও সেবাখাতে প্রবৃদ্ধি আরও বাড়বে বলে তিনি মনে করেন। এদিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সমীক্ষা থেকে দেখা যায়, নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশ পুরোপুরি মুক্তবাজার অর্থনীতিতে প্রবেশের পর বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বাড়তে থাকে। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে তা খুব দ্রতগতিতে বাড়তে পারেনি। স্বাধীনতা-পরবর্তী গত ৪১ বছরের মধ্যে ৩৪ বছরে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বেড়েছে ৫০০ ডলার। আর গত কয়েক বছরে তা দ্বিগুণ বেড়ে এক হাজার ডলার ছাড়িয়েছে। ১৯৭২-৭৩ সাল থেকে মাথাপিছু আয় বেড়ে ২০০৬-০৭ অর্থবছরে তা দাঁড়ায় মাত্র ৫২৩ ডলারে। আর ২০০৭-০৮ অর্থবছর থেকে ২০১২-১৩ অর্থবছরে তা দ্বিগুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৪৪ ডলারে। গত কয়েক বছরে মাথাপিছু আয় দ্বিগুণ বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি কার্যকরী ভূমিকা রেখেছে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী। এ কর্মসূচীর কারণেই উপকারভোগী জনগোষ্ঠীর মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। সমীক্ষায় দেখা গেছে, সরাসরি উপকারভোগীদের মাথাপিছু আয় যেভাবে বেড়েছে তার তুলনায় যারা এ কর্মসূচীভুক্ত নয় তাদের মাথাপিছু আয় কম হারে বেড়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচীর উপকারভোগী নারীদের আর্থিক সক্ষমতার মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি পেয়েছে। অভাবগ্রস্ত দরিদ্র শিশুদের খাদ্য চাহিদা পূরণ হয়েছে, তবে পুষ্টি চাহিদা বিশেষ করে দুগ্ধজাত এবং আমিষজাত খাদ্যের ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী সম্পর্কে পরিকল্পনা কমিশনের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, উপকারভোগীদের ওপর সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী ব্যাপক প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে খাদ্য নিরাপত্তায় বিরাজমান ঝুঁকিসমূহ তাৎপর্যপূর্ণভাবে হ্রাস পেয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচীর প্রভাবে মৌসুমী অভাব কমেছে, যার ফলে দিনে তিনবার খাদ্যগ্রহণকারী পরিবারের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে দ্বিগুণ হয়েছে। আর্থিক ও অন্যান্য সঙ্কট মোকাবেলার ক্ষেত্রে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সঞ্চয় প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সম্পদ সংগ্রহ, যেমন ভূমি মালিকানা ও গবাদি পশু পালনে মিশ্র পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। দরিদ্রের মধ্যে ভূমিহীনতা থেকে উত্তরণ দৃশ্যমান না হলেও আর্থিক সক্ষমতার কারণে ভূমিবন্ধক নেয়ার ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
×