ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

রুশো তাহের

সুন্দরবন বেঁচে থাক, বাংলাদেশ এগিয়ে যাক

প্রকাশিত: ০৩:৫৯, ২৬ অক্টোবর ২০১৬

সুন্দরবন বেঁচে থাক, বাংলাদেশ এগিয়ে যাক

আমার কন্যা কলেজ থেকে এসে বলল, আব্বু আমার এক বান্ধবী বলল, রামপাল সুন্দরবন ধ্বংস করবে। তাই ও রামপালবিরোধী। আসলে কলেজের শিক্ষার্থী হলেও আমার কন্যার পরিপক্বতা যথেষ্ট অগ্রসর। তাইতো ওর সঙ্গে মহাকাশবিজ্ঞান, মঙ্গলগ্রহে মানববসতি স্থাপন, জলবায়ু পরিবর্তন, সন্ত্রাসবাদ ও গ্লোবাল ইস্যুসহ বিচিত্র সব বিষয় নিয়ে হরহামেশাই আলোচনা করে থাকি। কিন্তু সুন্দরবন নিয়ে ওর মাইন্ডসেট তৈরি হয়েছে যুক্তিবোধ ও আবেগের মিশেলে। অবশ্য এর কারণ ওর পিতামহ মানে আমার বাবার বন বিভাগের চাকরির পুরো সময় সুন্দরবন বিভাগে অতিক্রম করা। মা-বাবার সঙ্গে আমার কৈশোরের দুরন্ত সময়ের নানা অভিজ্ঞতা গল্পাকারে আমার মেয়েকে শুনাতাম। বিশেষত, বাবার বন বিভাগের চাকরি ছিল বদলিযোগ্য। তাই একবছর কোন বন টহল ফাঁড়িতে, ছয় মাস গভীর জঙ্গলে গোলপাতা বা গরানকুপে, এর পরের বছর ফরেস্ট স্টেশন বা রেঞ্জ হেডকোয়ার্টার কিংবা খুলনা শহরের বিভাগীয় সদর দফতরে। এসব অভিজ্ঞতার গল্প যে মেয়ের মনোজগতে এ রকম প্রভাব বিস্তার করবে- তা আমার ভাবনায় ছিল না। কিন্তু রামপাল নিয়ে ওর অভিব্যক্তি আমাকে ভাবিয়ে তুলল। কী হচ্ছে রামপালে? সুন্দরবনের সঙ্গে রামপালের সম্পর্ক বৈরিতার নাকি বান্ধবের? প্রথমেই সুন্দরবন নিয়ে খানিকটা আলোকপাত করতে চাই। সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট এ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসের সুন্দরবন জয়েন্ট ল্যান্ডস্কেপ ন্যারেটিভ-২০১৬ শীর্ষক গবেষণায় দেখা যায়, ১৭৭৬ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত মানে ২৪০ বছরে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের আয়তন কমেছে প্রায় ৬ হাজার বর্গকিলোমিটার। অর্থাৎ ১৭৭৬ সালে সুন্দরবন বাংলাদেশ অংশের আয়তন ছিল ১১ হাজার ২৫৬ বর্গকিলোমিটার। যা ২০১৫ সালে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৪৬৭ বর্গ কি:মি:। এদিকে সুন্দরবনের উদ্ভিদ নিয়ে এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, ১৯৫৯ সালে হেক্টরপ্রতি সুন্দরী গাছ ছিল ২১১টি। আর ১৯৯৬ সালে তা নেমে আসে হেক্টরপ্রতি ১০৬টিতে। এভাবে কমতে থাকলে ২০২০ সালে এই সংখ্যা ৮০তে নেমে আসতে পারে। এর কারণ মনুষ্যসৃষ্ট ও প্রাকৃতিক। বিরল ইকোসিস্টেমের অমূল্য সম্পদ বলে অধিকতর দায়িত্বশীল হয়ে সুন্দরবনের যাতে ক্ষতি না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রেখে মনুষ্যসৃষ্ট কারণ আংশিকভাবে হ্রাস করা যায়। পুরোপুরি দূর করা এই জন্য সম্ভব নয় যে, সুন্দরবনের অবস্থান বাংলাদেশে হলেও মনুষ্যসৃষ্ট কারণসমূহের উৎপত্তি কিন্তু শুধু বাংলাদেশে নয়। বরং বাংলাদেশের বাইরেই বেশি হয়ে থাকে। আচ্ছা, যদি ১৬ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশ গণভোটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয়, আমরা ট্রাডিশনাল চাষাবাদের মাধ্যমে কৃষিপ্রধান দেশই থাকব, ইকোলজিকে ভাল রাখতে নগরায়ণ ও শিল্পায়নের দিকে ভুলেও যাব না। তারপরও কিন্তু বাংলাদেশের ইকোলজির স্বাস্থ্য ভাল থাকবে না। কারণ, চীন ও ভারত দ্রুত শিল্পায়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আর তাদের কার্বন নিঃসরণের বিচরণ কিন্তু আমাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনী ঠেকাতে পারবে না। এদিকে বাস্তবতা হলো পাঁচ দশকে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে নগরায়ণের হার সবচেয়ে বেশি। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পরিকল্পিত ও অপরিকল্পিতভাবে শিল্পায়নও হচ্ছে। বাড়ছে প্রযুক্তিনির্ভর জীবন যাপনীয় মানুষের সংখ্যা। এসবের মূল নিয়ামক কিন্তু বিদ্যুত। আর বিদ্যুত চাহিদা পূরণে প্রণীত হয়েছে মিশ্র জ্বালানি উৎস নীতি। যেখানে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত। এটা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে বাগেরহাট জেলার রামপালে ১৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এখন প্রশ্ন হলো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্রের জন্য রামপালকে কেন স্থান নির্বাচন করা হলো? প্লান্টের আয়ুষ্কালব্যাপী কয়লা সরবরাহ নিশ্চিত, পরিবহন ব্যবস্থা, পানির প্রাপ্তি, কম জনবসতি উচ্ছেদ, পরিবেশের ক্ষতি সহনশীল পর্যায়ে রাখা প্রভৃতি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে রামপালকে নির্ধারণ করা হয়েছে। আমাদের মনে রাখতে হবে প্রযুক্তিনির্ভর যে কোন উন্নয়ন কর্মকা-ই ইকোলজির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাই উন্নয়ন করব, ইকোলজি তথা পরিবেশের কোন ক্ষতি হবে নাÑ এই প্রতিশ্রুতি যথার্থ নয়। কিন্তু উন্নততর প্রযুক্তির ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনায় এই ক্ষতি সহনশীল পর্যায়ে রাখা যায়। এই বাস্তবতায় রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্রে আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল টেকনোলজির ব্যবহার, ট্রক্সিক উৎপাদন ও ছাই নিয়ন্ত্রণ, পানি থেকে দূষণরোধ, ড্রেজিং ও কয়লা পরিবহনে উন্নত জাহাজ ব্যবহার অন্তর্ভুক্তি করা হয়েছে। এরপরও তেল গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুত বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটিসহ কতিপয় পরিবেশবাদী সংগঠন তুলকালাম কাণ্ড করে যাচ্ছে রামপালকে ঘিরে। বিশেষজ্ঞদের এতে জড়িয়েছে, তরুণদের বিভ্রান্ত করা হচ্ছে এমনকি ডেকে এনেছে ইউনেস্কোকে। বিশেষজ্ঞরা রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্রের প্রভাব সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করে ব্যবস্থাপত্র দিচ্ছেন। জনৈক বিশেষজ্ঞ রামপাল কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুত কেন্দ্রকে আরও ১০ কি:মি: দূরে সরিয়ে স্থাপনের পরামর্শ দিয়েছেন। আবার আরেক বিশেষজ্ঞ সুন্দরবনের পূর্বে ৩০ কি:মি: দূরে বরগুনায় এই বিদ্যুত কেন্দ্র সরিয়ে নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। উনি ওই ব্যবস্থাপত্রকে বলেছেন অল্টারনেটিভেরও অল্টারনেটিভ। আসলে সম্মানিত বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী বিকল্প খুঁজতে খুঁজতে বাংলাদেশে হয়ত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের জায়গাই পাওয়া যাবে না। কারণ প্রায় ১৬ কোটি মানুষ এই ভূখ-ে অনেকটা গাদাগাদি করে বসবাস করছে বললেও অত্যুক্তি হবে না। তাই বাধ্য হয়ে সরকার কে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত উৎপাদনের অপশন থেকে সরে আসতে হবে। কিন্তু বিদ্যুত উৎপাদনের জন্য কয়লা ছাড়া আর কি কি বিকল্প আছে? এর সোজা-সরল জবাব সভা-সমিতিতে হরহামেশা দিয়ে যাচ্ছেন রামপালবিরোধীরা। তারা বলছেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনের অমিত সম্ভাবনার দ্বার নাকি খুলে গেছে। বাংলাদেশ সেখানে প্রবেশ করলেই বিদ্যুত সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আচ্ছা, পৃথিবীর কোন্ কোন্ দেশে বিদ্যুত চাহিদার শতকরা কতভাগ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে আসে সেই তথ্য-উপাত্ত কি রামপালবিরোধীদের কাছে আছে? রামপালবিরোধীরা আরেকটি মিথ্যে তথ্য প্রতিনয়তই বলে যাচ্ছেন। তা হলো পৃথিবী নাকি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত উৎপাদনের অপশন থেকে সরে আসছে। এই সরে আসা মানে কি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দেশের সব কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র বন্ধ করে দিয়ে পরের দিন থেকে সৌরবিদ্যুত উৎপাদনে লেগে যাওয়া? আসলে কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণ যা কার্বন নিঃসরণ নামে পরিচিত, তা কমিয়ে আনতে তথা এই গ্রহকে বাসযোগ্য রাখতে বিদ্যুত উৎপাদনে, শিল্পায়নে, সামগ্রিকভাবে প্রযুক্তিনির্ভর জীবনযাপনে আমাদের দায়িত্বশীল হওয়া উচিত, নির্বিচারে কোন কিছু করা যাবে না। প্রযুক্তির উন্নত ভার্সনের ব্যবহারে দূষণের মাত্রা কমিয়ে আনা সম্ভব। প্রয়োজনবোধে বিকল্পকেও গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশের রামপালবিরোধীরা (সার্বিকভাবে এঁরা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত উৎপাদন এমনকি নিউক্লিয়ার বিদ্যুতেরও বিরোধী) প্রায় ৬ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের সুন্দরবনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে মাত্র। রামপাল তো এখনও নির্মাণই হয়নি, তারপরও সুন্দরবনের আয়তন কমে গেল কেন? বাঘ ও সুন্দরী গাছের সংখ্যাইবা আশঙ্কাজনকহারে হ্রাস পাচ্ছে কেন? আসলে আমরা চাই সুন্দরবন বেঁচে থাক তার জীববৈচিত্র্য নিয়ে আর বাংলাদেশ এগিয়ে যাক ষড়যন্ত্র আর বিরোধিতা অতিক্রম করে বিদ্যুত উৎপাদনের মধ্য দিয়ে। লেখক : বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক
×