ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সাগরিকায় তীরে এসে তরী ডুবল

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ২৫ অক্টোবর ২০১৬

সাগরিকায় তীরে এসে তরী ডুবল

মোঃ মামুন রশীদ ॥ আরেকটি হৃদয়ভাঙ্গা পরাজয়, ইতিহাস পায়ে চুমু খেল না। যদি জয়টা আসত তবেই ইতিহাস নুয়ে পড়ত বাংলাদেশের কাছে। অনেক নাটকীয়তায় পরিপূর্ণ শ্বাসরুদ্ধকর চট্টগ্রাম টেস্টের ফয়সালা পঞ্চম দিনে সূর্যটা মাঝ গগনে পৌঁছার অনেক আগেই হয়ে গেল। ২২ রানে জিতে বিজয়ীর হাসিটা থাকল সফরকারী শক্তিশালী ইংল্যান্ড শিবিরে। সাময়িক উল্লাস করা ইংলিশ ক্রিকেটাররা হতাশায় মুষড়ে পড়া বাংলাদেশী ব্যাটসম্যান সাব্বির রহমানকে সান্ত¡না দিতে এলেন। তবে এতটা কাছে এসে হেরে যাওয়ার বেদনা কোনভাবেই প্রশমন হওয়ার নয়। পঞ্চম দিনের শুরুটা দুই অপরাজিত সেনানী সাব্বির আর তাইজুল ইসলাম বেশ ইতিবাচক মনোভাব নিয়েই শুরু করলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর ১০ রান যোগ করতেই তাইজুল ও শফিউল ইসলামের বিদায়! তাই প্রয়োজনীয় ৩৩ রান করা হয়নি। ২৬৩ রানেই শেষ বাংলাদেশের দ্বিতীয় ইনিংস। শেষ দুই উইকেট পড়ল এই টেস্টে উইকেট পড়া না পড়ার আসল বিচারক ডিআরএস পদ্ধতিতে। সবমিলিয়ে ২৬ রিভিউ হওয়া এ টেস্টে বাংলাদেশের পরাজয়টা তাদের টেস্ট ইতিহাসের ক্ষুদ্রতম ব্যবধানে পরাজয়। উইকেটের দিক থেকে ২০০৩ সালে মুলতান টেস্টে পাকিস্তানের কাছে ১ উইকেটে পরাজয়ের দুঃসহ স্মৃতিটাই যেন আবার ফিরে এলো। আর দুই ম্যাচের সিরিজে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে থাকল ইংল্যান্ড। সাগরিকায় আগের চারটা দিন সকালে উইকেট যে আচরণ করেছে সেখানে দুই টেলএন্ডার স্পেশালিস্ট বোলারের ব্যাট হাতে বেশিক্ষণ লড়ে যাওয়া একেবারেই অলীক স্বপ্ন। জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের উইকেট যেন গোলকধাঁধা। সেই ধাঁধায় পড়েছেন এমনকি আম্পায়াররাও। চতুর্থ দিন পর্যন্ত ২৪টি রিভিউ নিয়েছে দু’দল যা অনেক আগেই বিশ্বরেকর্ড করে ফেলেছে। আর প্রতিদিনের শুরুতেই ভেঙ্গে-মুচড়ে গেছে ব্যাটসম্যানদের প্রতিরোধ। এমন উইকেটে হুট করে টেস্ট ক্রিকেট খেলতে নামা মানে জলে নেমে হিংস্র হাঙ্গরের সঙ্গে লড়াইয়ের সমতুল্য। কিন্তু টানা সাড়ে ১৪ মাস টেস্ট না খেলা বাংলাদেশ দল এই চোরাবালিতে নেমে গেছে দলে অনেক পরিবর্তন এনে। মাত্র ২৮৬ রানের টার্গেট তখন হিমালয় পর্বতের চেয়েও বড়। কিন্তু দারুণ খেলেছে বাংলাদেশ দল। চতুর্থ দিন শেষে ২৫৩ রান, ঐতিহাসিক বিজয় থেকে মাত্র ৩৩ রান দূরে থেকে সারারাত বিনিদ্র কেটে গেল বাংলাদেশ দলের তাঁবুতে। আর ২ উইকেট নেয়ার চিন্তায় তখন চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে পাগলপ্রায় ইংলিশরাও দু’চোখের পাতা শান্তিতে এক করতে পারেনি। বাংলাদেশের সমস্যা অনেকÑ দুই টেলএন্ডারকে নিয়ে পঞ্চম দিন এই ৩৩ রান করতে হবে এবং বিভীষিকাময় সকালের পৈশাচিক থাবা থেকে বাঁচতে হবে। শুধু ভরসার নাম সাব্বির। ক্যারিয়ারের অভিষেক টেস্ট খেলতে নেমেই টি২০ স্পেশালিস্ট তকমা পাওয়া এ ডানহাতি মারকুটে ঝঞ্ঝাহীন সাগরের জলের মতেহা শান্ত, নির্লিপ্ত থেকে ৫৯ রান করেছেন। উইকেটেও আছেন। শুধু সঙ্গ দিতে হবে তাঁকে। আগের দিন শেষ উইকেটে তাইজুল দারুণ আস্থা দেখিয়ে সম্ভাবনাময় ব্যাটিং করেছেন। ১৫ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটিটা শুরু হলো পঞ্চম দিন সকালে ইতিহাস ছোঁয়ার প্রেরণায় উজ্জীবিত আত্মবিশ্বাস নিয়ে। সাব্বির প্রথম ওভারেই ৩ রান নিয়ে ‘জুজু’ কাটালেন আগের দিনগুলোর। প্রতিষ্ঠিত ব্যাটসম্যান হলেও তিনি নির্ভার হয়েই স্ট্রাইক দিচ্ছিলেন তাইজুলকে। বেশ অনুপ্রাণিত, ভয়ডরহীন ও চাপমুক্ত মনে হচ্ছিল দু’জনকেই। পরের ওভারে বেন স্টোকসকে একটি চারও হাঁকালেন তাইজুল হুক করে। বাংলাদেশ শিবিরে উল্লাস! চাপটা কেটে গেছে, আর মাথায় হাত ইংলিশ ফিল্ডারদের, চোখে-মুখে হতাশা। কিন্তু এই স্টোকসই পরে হৃদয় ভেঙ্গে দিলেন বাংলাদেশের। স্টেডিয়ামে গুটিকয়েক দর্শক সোল্লাসে চিৎকার করছিলেন একটা রান আসতেই। আবার তাইজুল যখন অফস্টাম্পের বাইরের বল ছেড়ে দিচ্ছিলেন ব্যাট উঁচিয়ে তখন উল্লাসধ্বনিটা আরও বিকট শব্দেই ধ্বনিত হচ্ছিল স্টেডিয়ামের প্রাচীরে প্রাচীরে। এটাই তো টেস্ট মেজাজ। তাইজুল একটা বল মোকাবেলা করছিলেন আর সাব্বির বার বার এগিয়ে এসে পরামর্শ দিচ্ছিলেন তাঁকে স্ট্রেট (সোজা) ব্যাটে খেলার জন্য। তবে স্টোকসই সর্বনাশ করলেন। নিজের পরবর্তী ওভারের তিনটি বলেই স্বপ্নের সমাধি হলো বাংলাদেশের। দিনের চতুর্থ ওভারের প্রথম বলেই তাইজুলের পেছন দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া বল ভেতরের পায়ে সামান্য চুমু দিয়ে যেতেই তীব্র আবেদন, সাড়া দেননি আম্পায়ার। কিন্তু চট্টগ্রাম টেস্টের মূল বিচারক রিভিউয়ের শরণাপন্ন হয়ে এবারও ইংল্যান্ড জয়ী। ফিরে গেলেন তাইজুল। শফিউল এসে একটি বল দেখেশুনে ছেড়ে দিলেন। কিন্তু পরের বলটি অফস্টাম্পের অনেক বাইরে পড়ায় খেলার কোন চেষ্টাই করেননি তিনি। সেটা প্যাডে লাগায় এলবিডব্লিউ হয়ে যান। রিভিউ নিয়েছিল বাংলাদেশ, তবে শফিউলের মধ্যে খেলার কোন অনুভব না থাকায় আউট হয়ে গেছেন তিনি। ২৬৩ রানে গুটিয়ে গেল বাংলাদেশের দ্বিতীয় ইনিংস। স্তব্ধ স্টেডিয়ামের নিরেট নীরবতা চিরে দিয়ে উল্লাসে ফেটে পড়ল ইংল্যান্ডের ক্রিকেটাররা, আর সাব্বির তখন নন স্ট্রাইকিং এন্ডে হতাশার অসাড়তায় মুখ নিচু করে বসে পড়লেন। যেন ভেঙ্গে পড়লেন ভাঙ্গা হৃদয় নিয়ে। ইংলিশরা দারুণ খেলোয়াড়সুলভ ভদ্রোচিত আচরণ দেখিয়ে একে একে সবাই এলেন সাব্বিরকে সান্ত¡না দিতে। হেরে গেল বাংলাদেশ ২২ রানে। অভিষেক টেস্টের চতুর্থ ইনিংসে বাংলাদেশের পক্ষে সেরা ইনিংস খেলা সাব্বির অপরাজিত ৬৪ রান করেও সবচেয়ে নির্মম পরাজয়ের ভারে আক্রান্ত হলেন। শেষ দিনে মাত্র ২১ বল আর ১৮ মিনিটেই খেলার ফয়সালা হলো যা বাংলাদেশের ষোলো কোটি মানুষের হৃদয় বিদীর্ণ করে দিল। এর আগে ইংল্যান্ড এত কম ব্যবধানে অস্ট্রেলিয়া ব্যতীত কোন দলের বিরুদ্ধেই টেস্ট জেতেনি। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ২২ রানের কম ব্যবধানে জিতেছে ৯ টেস্ট। সেদিক থেকে এটি ইংলিশদের দশম সর্বনিম্ন ব্যবধানের জয়। তবে বাংলাদেশের সবচেয়ে কম ব্যবধানের পরাজয় এটি। এর আগে ১০০ রানের নিচে বাংলাদেশের পরাজয় আছে একটিই। ২০১২ সালের নবেম্বরে মিরপুর টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে ৭৭ রানে হেরেছিল বাংলাদেশ দল। আর উইকেটের ব্যবধানে ক্ষুদ্রতম পরাজয় ১ উইকেটে। সেবারও হৃদয়ভাঙ্গা পরাজয় এসেছিল। মুলতানের দুঃসহ স্মৃতি এবার ফিরে এলো চট্টগ্রামে। তবে বিশ্বের চার নম্বর সেরা টেস্ট দলের বিরুদ্ধে এমন শ্বাসরুদ্ধকর পুরো পাঁচদিন ময়দানি লড়াইয়ে সমানে সমানে টিকে থাকায় বিশ্ববাসীর চোখ কপালে তুলে দিয়েছে বাংলাদেশ। জয়ী হলে ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে টেস্ট জয় ছাড়া আবার কোন বড় টেস্ট দলকে হারানোর গৌরবময় ইতিহাস গড়ত টাইগাররা। সেবার ক্যারিবীয়দের নিয়মিত খেলোয়াড়রা বিদ্রোহ করায় দ্বিতীয় সারির দল খেলেছিল। কিন্তু এবার ইংল্যান্ড ছিল পূর্ণশক্তির। কিন্তু সেই গৌরব এলো না। পঞ্চম দিনে সারাবিশ্বের ক্রিকেট ভক্ত-সমর্থক এবং দেশের ষোলো কোটি ক্রিকেটপ্রেমী চোখ রেখেছিলেন সেই পেন্ডলামে দোলা টেস্টের ভাগ্যটা শেষ পর্যন্ত কী হয় দেখার জন্য। কিন্তু শক্ত দল হিসেবে জিতে গেল ইংল্যান্ডই। অভিজ্ঞতার কাছে হারল বাংলাদেশ আরেকবার। বেন স্টোকস প্রথম ইনিংসে চারটি এবং বিজয় নির্ধারক শেষ দুই উইকেট নেয়ার পাশাপাশি ব্যাট হাতেও ৮৫ রানের একটি চমৎকার ইনিংস খেলে হয়েছেন ম্যাচসেরা।
×