ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

শেখ আসমান

আগামী দিনের নৌকার মাঝি ॥ অভিমত

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ২৫ অক্টোবর ২০১৬

আগামী দিনের নৌকার মাঝি ॥ অভিমত

মাঝি স্রোতের প্রতিকূলে নৌকা চালিয়ে গেলে তার গতিবেগ অঙ্ক করে বের করা সম্ভব। কিন্তু ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন যে নৌকার পথচলা শুরু হয়েছে তার গতিবেগ কোন সূত্রের মাধ্যমে প্রয়োগ করে সমাধান করা সম্ভব নয়। নৌকা স্রোতের প্রতিকূলে বয়ে গিয়ে প্রথম কূলের দেখা পায় ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে। ২৩৭ আসনের বিপরীতে জয়লাভ করে ২২৩টি আসনে। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী প্রতীক ছিল নৌকা। আর নৌকার প্রধান মাঝি ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। সেদিন বঙ্গবন্ধু ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। কিন্তু মাত্র দেড় মাসের মাথায় যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙ্গে দেয় পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী। কিছুটা টালমাটাল হয়ে যায় নৌকা, কিন্তু মাঝি শক্ত হাতে হাল ধরলেন এবং এটা একদিনে হয়নি। বঙ্গবন্ধু মাত্র ২৯ বছর বয়সে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হন এবং ৩৩ বছর বয়সে ১৯৫৩ সালে সাধারণ সম্পাদক হন। এ থেকে প্রতীয়মান হয় তিনি তৃণমূলে কতটা জনপ্রিয় ছিলেন, তৃণমূলের সঙ্গে তিনি কতটা সম্পৃক্ত ছিলেন। সময় ১৯৬৬, নৌকার মাঝি উপস্থাপন করলেন ‘ম্যাগনাকার্টা’, যাকে বলা হয় বাঙালীর মুক্তির সনদ। ঐতিহাসিক ৬ দফা। পাকিস্তানের মাটিতে ১৯৬৬ সালের ৫-৬ ফেব্রুয়ারি বিরোধী দলের সমাবেশে উপস্থাপিত হলো ৬ দফা। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী। ৬ দফাকে পাকিস্তান ভাঙ্গার ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করলেন আইয়ুব গং। অতঃপর নৌকার মাঝি শেখ মুজিবের ওপর নেমে এলো শাসকগোষ্ঠীর নির্মম অত্যাচার। ১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি গ্রেফতার করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে! ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব এবং অন্যান্য’ শিরোনামে বঙ্গবন্ধুসহ ৩৫ জনকে আসামি করে দায়ের করা হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। উত্তাল সমুদ্র হয়ে ওঠে পূর্ব পাকিস্তান। রাজপথে নেমে আসে নৌকার যাত্রীরা, মুক্ত করতে প্রাণের মাঝিকে। মাঝি ছাড়া দিশাহারা যাত্রীরা। দীর্ঘ আন্দোলনের শেষে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে তীব্র আন্দোলনের মুখে মুক্তি দেয় পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী। দীর্ঘ কারাবরণে নৌকার যাত্রীরা মুক্তির পরের দিন ২৩ ফেব্রুয়ারি তাদের প্রাণপ্রিয় মাঝিকে ভূষিত করে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে। তার আগে রক্তে ভিজে গেছে আসাদের শার্ট আর মতিউরের জামা। ১৯৭০-এর ভয়াবহ সাইক্লোনে মারা যায় লাখ লাখ মানুষ। পশ্চিম পাকিস্তানী সরকারের অবহেলায় দুর্গত অঞ্চলের মানুষের দুর্ভোগ আরও বেড়ে যায়। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হলো জাতীয় পরিষদের নির্বাচন। ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭ আসনে জয় পেয়ে বিপুল ব্যবধানে বিজয় লাভ করে আওয়ামী লীগ। তবুও পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী নৌকার মাঝি এবং যাত্রীকে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে বঞ্চিত করে। ফুঁসে ওঠে জনগণ। ততদিনে নৌকার মাঝি এবং যাত্রীদের ধ্বংস করার নীলনক্সা করে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী। চালায় গণহত্যা। বন্দী করে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে। ৩০ লাখ প্রাণ আর ৪ লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে মুক্ত হয়ে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। নৌকা পৌঁছে যায় তার নির্দিষ্ট গন্তব্যে, তার জন্য ত্যাগ করতে হয়েছে বিপুল। মাত্র ১ বছরের মাথায় সংবিধান প্রণয়ন করেন বঙ্গবন্ধু। জাতিসংঘ, ওআইসি, কমনওয়েলথের স্বীকৃতির মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বসভায় বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করেন নৌকার মাঝি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তারপর আবারও স্বপ্নভঙ্গ। পাকিস্তানী ষড়যন্ত্রে এবং তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকারদের সহযোগিতায় সপরিবারে হত্যা করা হয় জাতির পিতার পরিবারকে। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা। এবার সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত নৌকার যাত্রীরা। চারদিকে যখন ঘোর অন্ধকার, কোন আশাই যখন আর রইল না, তখন মঞ্চে আবির্ভূত হলেনÑ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। চাঞ্চল্য ফিরে এলো নৌকার যাত্রীদের মাঝে। তেজোদীপ্ত সূর্যের মতো উদ্ভাসিত হলো প্রতিটি যাত্রী। এ যেন ফিনিক্স পাখি। শুরু হলো নতুন সংগ্রাম। লড়াইটা জারি থাকল। স্বৈরাচারের বুলেটবিদ্ধ নির্যাতনের শিকার হলেন গণতন্ত্রের মানসকন্যা শেখ হাসিনা। বুক পেতে দিল নৌকার অসীম সাহসী যাত্রীরা। সে যাত্রায় বেঁচে গেলেন। অনেক সংগ্রামের পর প্রধানমন্ত্রী হয়ে পিতার অসমাপ্ত কাজ শেষ করার লড়াই শুরু করলেন। দীর্ঘ ৫ বছর মানুষের মুক্তির জন্য নিরলস কাজ করে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রের কাছে পরাভূত হয়ে ক্ষমতা ছাড়তে হলো নৌকার মাঝিকে। কারণ শেখ হাসিনাকে সরাতে পারলেই বাংলাদেশকে লুট করা সম্ভব, একাত্তরের পরাজিত পক্ষ তা ভালই জেনে গেছে ততদিনে। নেমে এলো রাষ্ট্রীয় বর্বরতা। তাজা ১২টি গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হলো। এ যাত্রায় রাখে আল্লাহ মারে কে, ভাগ্যচক্রে বেঁচে ফিরলেন। তীব্র আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে আবারও তীরে উঠতে সক্ষম হলো নৌকার যাত্রীরা। সালটা ২০০৯। দৃশ্যপটে শেখ হাসিনা। পালটানা নৌকা এবার উন্নয়নের নৌকায় পরিণত হলো। এবার শুধুই অর্জন। বিদ্যুত উৎপাদন ১৪,০৭৭ মেগাওয়াট, খাদ্যশস্য উৎপাদনে বিশ্বে ১০ম, ধান উৎপাদনে চতুর্থ, বিদ্যুতকেন্দ্র ১০০টি, রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলার, রফতানি আয় ৩৪.৪ বিলিয়ন ডলার, রেমিটেন্স ১৫.৭২ বিলিয়ন ডলার, মাথাপিছু আয় ১,৪৬৬ ডলার, জিডিপি ৭.০৫%, ৬.১৫ কিলোমিটারের পদ্মা সেতু, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে সহ-সভাপতির দায়িত্ব, গোল্ডম্যান স্যাকসের নেক্সট-১১ এর অন্যতম বাংলাদেশ, চারদিকে অর্জনের স্বীকৃতি। এ শুধুই বাংলাদেশের অর্জন। কিন্তু যার হাত ধরে এ অর্জন তিনিও ছিনিয়ে এনেছেন অসংখ্য পুরস্কার, দেশকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। মার্কিন ম্যাগাজিন ফোর্বসের প্রভাবশালী ১০০ নারীর তালিকায় ৩৬তম শেখ হাসিনা, ফরচুন ম্যাগাজিনের শীর্ষ ৫০ নেতার তালিকায় ১০ম, সাউথ সাউথ পুরস্কার, চ্যাম্পিয়ন্স অব দ্য আর্থসহ অসংখ্য পুরস্কার। এসব অর্জনের পেছনে ছিলেন দুজন দক্ষ মাঝি। এক মাঝির হাত ধরে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, আরেক মাঝির নেতৃত্বে আমরা বিশ্ব সভায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছি। আজ বাংলাদেশের একজন নারী নেত্রী শত বাধা প্রতিকূলতা পেরিয়ে সারা বিশ্বে জায়গা করে নিয়েছেন সমহিমায়। এ যেন আর্নেস্ট হেমিংওয়ের উপন্যাসের মতোÑ অ সধহ পধহ নব ফবংঃৎড়ুবফ নঁঃ হড়ঃ ফবভবধঃবফ. অন্তহীন ছুটে চলা... লেখক : সাবেক ছাত্রনেতা
×