ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মারুফ রায়হান

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ২৫ অক্টোবর ২০১৬

ঢাকার দিনরাত

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় সম্মেলনকে কেন্দ্র করে গত সপ্তাহের রাজধানী ছিল মুখর, প্রাণবন্ত। তবে সাধারণ ঢাকাবাসীর ভেতর কিছুটা কৌতূহল, উৎকণ্ঠাও যে ছিল না, এমনটা বলা যাবে না। বিশেষ করে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে যানবাহন চলাচলে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করায় এবং মিডিয়ায় তার ব্যাপক প্রচার হওয়ায় মানুষ কিছুটা চিন্তিত ছিল। যাদের ঘর থেকে না বেরুলেও চলে তারা নিশ্চয়ই বেরোয়নি। এক মাস পর আমি ঘর থেকে অফিসের উদ্দেশে বেরিয়েছিলাম। সম্মেলনের প্রথম দিন ছিল শনিবার, যেটি আবার বহু মানুষের ছুটির দিন। উত্তরা থেকে বেরিয়ে মূল সড়কে এসে কিছুটা অবাকই হলাম। রাস্তায় যানবাহনের সংখ্যা কম, মানুষও কম। অনেকটা হরতাল হরতাল আমেজ। আসলে ভুল বললাম, এখন তো হরতাল আর কর্মব্যস্ত কর্মদিবসের ভেতর তেমন পার্থক্য টানা যায় না। সারাটা পথ বেশ নির্বিঘ্নে এবং ভালভাবেই এলাম। অন্যান্য দিন যেসব পথ যানজটে নাকাল হয়, শনিবার সেসব প্রায় সুনসান। পরের দিন সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবস হওয়ায় কিছুটা চিন্তা এসে ভর করে আমার মনেও। লালমাটিয়ায় ছিলাম শনিবার রাতে। রবিবার বেলা এগারোটার পর বেরুলাম। পান্থপথ সত্যিকারের পান্থজনের পথেই পরিণত হয়েছে দেখছি। আমি অবশ্য গাড়িতে পাড়ি দিলাম তিন মিনিটে! বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্স হেমন্তের রোদ পোহাচ্ছে, ক্রেতার দেখা সে পাবে কিনা এ নিয়ে আমি কিছুটা দ্বিধান্বিত। বৃহস্পতিবার বিটিভি ভবনের উদ্দেশে বেরিয়ে দেখেছি ঢাকা দারুণ উৎসবের সাজে সেজেছে। টিভির রেকর্ডিং শেষে রাতে ঘরে ফেরার পথে প্রতিটি সড়কে নান্দনিক আলোকসজ্জায় চোখ জুড়িয়ে গেল। আর কত রংবেরঙের বাহারি প্রচার! এবার সম্মেলনও হয়েছে বেশ জাঁকজমকপূর্ণ। বিপুল মানুষের প্রাণোচ্ছল উপস্থিতি, তবু কোথাও কোন বিশৃঙ্খলা নেই। বৃদ্ধাশ্রম “নিজের হাতে ভাত খেতে পারতো নাকো খোকা বলতাম আমি না থাকলে রে কি করবি রে বোকা? ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতো খোকা আমার কথা শুনে- খোকা বোধ হয় আর কাঁদে না, নেই বুঝি আর মনে। ছোট্টবেলায় স্বপ্ন দেখে উঠতো খোকা কেঁদে দু’হাত দিয়ে বুকের কাছে রেখে দিতাম বেঁধে দু’হাত আজো খোঁজে, ভুলে যায় যে একদম- আমার ঠিকানা এখন বৃদ্ধাশ্রম।” বৃদ্ধাশ্রমে পড়ে থাকা প্রায় প্রত্যেক বাবা-মায়ের গল্পই এমন। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এমন নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে তা হয়ত কোনদিন ভাবতেই পারেন না বয়সের ভারে নুয়ে পড়া অসহায় এই মানুষগুলো। এখানে ধনী কিংবা গরিব, ক্ষমতাশালী কিংবা অক্ষম কোন বিষয়ই না। উচ্চবিত্ত আর নিম্নবিত্তের জন্য দুটি বৃদ্ধাশ্রমে সময় দেয়ার অভিজ্ঞতা থেকে এমনটাই মনে হয়েছে। আমাদের বন্ধু সায়কা শর্মিন নিয়মিত যান বৃদ্ধাশ্রমে। তার সঙ্গে একবার ঘুরে আসতে চেয়েছি ঢাকার দুটি বৃদ্ধাশ্রমে। একটি তো আমাদের উত্তরার কাছেই, উত্তরখানের মৈনারটেকে। এটির নাম ‘আপন নিবাস বৃদ্ধাশ্রম’। এখানে আশ্রয় পেয়েছেন কিছু অসহায় বৃদ্ধা যাদের নেই কোন আপনজন, নেই মাথা গোঁজার ঠাঁই। এই বৃদ্ধাশ্রমের সবাই নারী, যাদের বয়স ৬০-১২০ বছর। এদের কেউই শারীরিকভাবে খেটে কাজ করে খাওয়ার মতো সামর্থ্য রাখেন না। বার্ধক্যের কারণে কর্মক্ষমতা হারিয়েছেন অনেক আগেই। এদের কেউ ছিলেন রাস্তায়, কেউ মাজারে, কেউবা হাসপাতালের পাশে রাস্তায় অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। কেউবা ভিক্ষা করত আবার কেউবা ছোট্ট কোন খুপরিঘরে পড়েছিল জীবনের শেষনিঃশ্বাস ত্যাগের অপেক্ষায়। এখন আশ্রয় পেয়েছেন। বলা চলে একটা নতুন জীবনই পেয়েছেন। শতবর্ষী এক বৃদ্ধ মা আছেন যিনি সারাদিন আপনমনে বিড়বিড় করেন। হাতপাখা দিয়ে ঢেকে নিজের খাবার খান যা দেখে মনে হবে খাবারের ভীষণ কষ্ট ছিল তার এক সময়। একজন আছেন বাকপ্রতিবন্ধী। তিনি চোখে দেখতে পান না, কানেও শুনতে পান না। অন্যের সাহায্য নিয়ে চলাফেরা করেন। রংপুর থেকে আসা এক মায়ের ছিল তিন সন্তান। ছেলে মারা যাবার পর মেয়েদের সংসারে তার দুবেলা খাবার জোটেনি। এদের সবারই সুন্দর সাজানো সংসার ছিল যেখানে তাদের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে এখন। একটা নির্মাণাধীন/অর্ধনির্মিত (অসম্পূর্ণ) ভাড়াবাড়িতে চলছে এই বৃদ্ধাশ্রম। এখানে বিদ্যুত সংযোগ নেই। উপহার হিসেবে পাওয়া ১০০ ওয়াটের একটি সোলার দিয়ে কোনমতে রাতের আলোর প্রয়োজন মেটানো হয়। এখানে আশ্রয় নেয়া প্রত্যেকেই ষাটোর্ধ হওয়ায় প্রায় সবারই রয়েছে কোন না কোন শারীরিক অসুস্থতা। এমনকি মানসিক এবং শারীরিক প্রতিবন্ধীও আছেন কয়েকজন। দেখার মতো কোন ডাক্তার নেই এখানে। কেউ অসুস্থ হলে ডাক্তার বা হসপিটালের শরণাপন্ন হবার জন্য আছেন একজন স্বেচ্ছাসেবী। এই আশ্রমে যেহেতু সহায়সম্বলহীনদেরই ঠিকানা তাই এখানে কোন মাসিক চার্জ গ্রহণ করা হয় না। নামমাত্র যা সাহায্য আসে তার উপরই নির্ভর করে এই বৃদ্ধাদের ভাল থাকা মন্দ থাকা। এখানে একান্ত প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মধ্যে আছে চাল, ডাল, তেল আর ওষুধ। এক একজনের জন্য মাসিক ওষুধে ব্যয় হয় আনুমানিক ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা। সাধারণ ওষুধের মধ্যে প্রয়োজন ভিটামিন, সালাইন, গ্যাস্ট্রিক-জ্বর-সর্দি-কাশির। প্রতিদিন বারো কেজি চাল, এক কেজি ডাল, ৩ কেজি আলু, ১ কেজি পেঁয়াজ আর তিন পোয়া তেল প্রয়োজন। যারা বেশি অসুস্থ তাদের প্রতিদিন দুধ, ডিম খাওয়াতে হয়। ওয়াসার পানির সংযোগ না থাকায় যে টিউবওয়েল বসিয়ে পানির প্রয়োজন মেটানো হয় তা কষ্টসাধ্য। তাই একটি ডিজেলপাম্প আর ছাদে বসানোর উপযোগী একটি পানির ট্যাঙ্কও একান্ত প্রয়োজন। একজন ডোনার হয়ে এই অসহায় মায়েদের পাশে দাঁড়াতে পারেন আপনিও। এ তো গেলো হতদরিদ্র মানুষের কথা। এক সময় সমাজের উচ্চপর্যায়ে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন তাদের অনেকের জীবনও এখন কাটছে পরিবার-পরিজনবিহীন এই বৃদ্ধাশ্রমের ছোট্ট এক একটি রুমে। স্বামী-সন্তান আর আত্মীয়স্বজন নিয়ে কাটানো ব্যস্ত জীবন এখন শুধুই অতীত। এক একটা দিন তাদের কাছে এখন এক একটা বছর। আমাদের বন্ধুটি বলছিলেন, রাজধানীর আগারগাঁওয়ের প্রবীণ নিবাসে ঠাঁই হয়েছে দেশের নামকরা স্কুলের এক শিক্ষিকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেছেন। স্বামী ছিলেন একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার ডিরেক্টর। কোটি টাকার বাড়ি বিক্রি করে একমাত্র সন্তানকে পড়ালেখা করান আমেরিকায়। স্বামী মারা যাবার পর অসহায় হয়ে পড়েন। যে সন্তানকে জীবনের সর্বস্ব দিয়ে মানুষ (!) করেছেন তার কাছে সেই বৃদ্ধা মা হয়ে যায় বিশাল বোঝা। পেনশনে পাওয়া সামান্য কিছু টাকা দিয়ে কোনমতে খেয়েপরে জীবনের শেষ কটা দিন পার করেন এই বৃদ্ধা। এমন অনেকেই আছেন এখানে। আছেন পিএইচডি ডিগ্রীধারী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক-শিক্ষিকা, কবি, সরকারী উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এমনকি দীর্ঘদিন বিদেশে আরাম-আয়েশে জীবন কাটানো সন্তান পরিত্যক্ত মা-বাবা। অঢেল সম্পত্তির মালিকও আছেন যাকে দেখার মতো কোন প্রিয়জন নেই। এদের কেউই জানতেন না যে তাদের শেষ ঠিকানা হবে এই বৃদ্ধাশ্রম! টাকাপয়সা এখন তাদের জীবনে মূল্যহীন, শুধু আমাদের একটু সময় একটু হাসিমুখ দেখার জন্য অপেক্ষায় থাকেন তারা। আমরা কি পারি না আমাদের সন্তানদের নিয়ে বছরে অন্তত একটা দিন তাদের মুখে হাসি ফোটাতে যাতে আমাদের শেষ ঠিকানা না হয় এই বৃদ্ধাশ্রমের নিঃসঙ্গ জীবন। অবাক পার্টি অজ্ঞান পার্টি অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়া মঞ্জুরুল ও সুজনের সর্বশেষ খবর পাইনি। কাগজে ফলোআপ আসেনি। কিন্তু ওদের কথা মন থেকে সরাতে পারছি না। গত বুধবার গাবতলী থেকে ছেড়ে আসা গাজীপুরগামী বিআরটিসি পরিবহনের আর্টিকুলেটেড (জোড়া লাগানো) একটি বাসে অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়েন দু’জন। বাসযাত্রীরা তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নেন এবং স্বজনদের খবর দেন। এ দু’জনের কাছ থেকে সহযাত্রীরা ৪০ হাজার টাকা, কাগজপত্র, মানিব্যাগ ও মুঠোফোন উদ্ধার করেন। কয়েক সহযাত্রী তাদের উদ্ধার করে সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরী বিভাগে নেন। পরে তাদের পরিবার সাভারের একটি বেসরকারী হাসপাতালে ভর্তি করায়। অপারেশনের সময় দৈর্ঘ্য বুঝে রোগীকে হিসাব করে এ্যানেস্থেসিয়া দেয়ার ব্যবস্থা করেন ডাক্তার। এটাকে আমরা সাধারণভাবে বলি অজ্ঞান করা। আমাদের কথ্য অভিধানে ‘অজ্ঞান পার্টি’ চালু শব্দ। তার ‘ডাক্তার’ এখন মানুষ মারার কারিগর হয়ে উঠছে। সংবাদপত্রে মাঝেমধ্যেই এমন সংবাদ বেরোয়- অজ্ঞান পার্টির কবলে যাত্রী সর্বস্বান্ত। এসব খবর আমাদের হয়ত গা সওয়া হয়ে গেছে। একবার নিজে ওই পার্টির কব্জায় পড়লে হয়ত বুঝতে পারব তার স্বরূপ ও ভোগান্তি। কবি তো বলেই গেছেন- কী যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কিসে/ কভু আশীবিষে দংশেনি যারে... সতর্কতামূলকভাবে এখন অনেক যানবাহনে লেখা থাকে- অপরিচিত কারও দেয়া কিছু খাবেন না। অবশ্য যারা খান তারা এসব লেখা লক্ষ্য করেন না, কিংবা তারা অক্ষরজ্ঞানবঞ্চিত। শহরের এসব শয়তানি বুদ্ধি সম্পর্কে তারা অসচেতন থাকেন। আপনজনের মতো খাতির করে পান, মিষ্টি বা এজাতীয় কিছু খাইয়ে তাকে অচেতন করে সঙ্গে থাকা নগদ অর্থ, ঘড়ি-মোবাইলফোন আত্মসাত করবেন- এমন ভাবনা তাদের মগজে ধরা দেয় না। একবার এমন অভিজ্ঞতা লাভ করলে তাদের মনে কী প্রতিক্রিয়া হয়, তা জানতে ইচ্ছে করে। নগরবাসীর প্রতি নিশ্চয়ই ঘৃণার উদ্রেক হয়। মানুষকে তারা ভীষণ বিপজ্জনক বলে ভাবতে শুরু করে। আবদুল মোমেনের প্রতিক্রিয়া আমাদের জানা হবে না। কারণ, তার অজ্ঞান অবস্থার অবসান ঘটেনি। তার কথা লিখেছিলাম এ কলামে। বিদেশগামী নিকটজনকে বিদায় দিতে ঢাকায় এসেছিলেন কিশোরগঞ্জের আবদুল মোমেন (৪৫)। সঙ্গে ছিল ভ্রাতুষ্পুত্র। মহাখালী বাসস্ট্যান্ডের সামনে ডাব বিক্রেতার কাছ থেকে ডাব কিনে খান। এরপরই রাস্তার ওপর ঢলে পড়েন তিনি। অজ্ঞান অবস্থায় হাসপাতালে নেয়া হয়। বেশ কয়েক ঘণ্টা পর মোমেন মারা যান। ডাবের পানি পান করানোর মাধ্যমে সংজ্ঞাহীন করে টাকাপয়সা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা ঢাকায় মাঝেমধ্যেই ঘটছে। মোমেনের সঙ্গে লোক ছিল বলে তার কিছু কেড়ে নেয়ার ঘটনা ঘটেনি। অবশ্য সবচেয়ে মূল্যবান প্রাণখানিই তার কেড়ে নেয়া হয়েছে। রাজধানীতে বিচিত্র উপায়ে মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে। এর ভেতর পেশাদার খুনীও রয়েছে। কথা হলো পেশাদার খুনীর তুলনায় অজ্ঞান পার্টির সদস্যদের অপরাধ লঘু কিনা। একে বরং ছিনতাইয়ের আরেক রূপ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। অস্ত্র ঠেকিয়ে বা আহত করে, কিংবা চোখে মরিচের গুঁড়া ছিটিয়ে বা মলম মাখিয়ে পকেট গড়ের মাঠ করে দেয়ার তুলনায় যাত্রীকে ঘুমের দেশে পাঠিয়ে টাকা এবং মালসামানা লোপাট করার অপকর্মটিকে কিছুটা ‘শান্তিপূর্ণ’ বলে মনে হতে পারে চূড়ান্ত বিচারে। দুটোতেই অর্থ নাশ, তবে একটিতে রক্তপাতের শঙ্কা থাকে। অপরটি বিনা রক্তপাতে। অবশ্য প্রাণ সংহারের ঘটনা ঘটার পর ওই ‘শান্তি প্রক্রিয়া’ হয়ে উঠেছে চরম ‘ঝুঁকিপূর্ণ’। ২৩ অক্টোবর ২০১৬ সধৎঁভৎধরযধহ৭১@মসধরষ.পড়স
×