ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রেজাউদ্দিন স্টালিন

আলোকিত মানুষের প্রতিকৃতি ডাঃ এবিএম আব্দুল্লাহ

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ২৫ অক্টোবর ২০১৬

আলোকিত মানুষের প্রতিকৃতি  ডাঃ এবিএম আব্দুল্লাহ

এক রাতে আমার বমিভাব হয়ে ব্যাপক জ্বর এলো। জ্বরের অনুভূতিটা একটু অন্য ধরনের। এর আগেও অনেকবার অসুখ করেছে; কিন্তু ঠিক এমন প্রকোপ আগে দেখিনি। একদিন পর রক্ত পরীক্ষা করালাম। সবকিছু মাত্রাতিরিক্ত। তারপর ডাক্তার প্রভাকর পুরকায়স্থের কাছে গেলাম। তিনি নিজেও পারকিনসন রোগে ভুগছিলেন। তবু তিনি বললেন, সম্ভবত গড়ংয়ঁরঃড় ইরঃব থেকে জ্বর আসতে পারে। তিনি ম্যালেরিয়ার ওষুধ দিলেন। আমি খেলাম না। ভাবলাম ডাইগোনোসিস ঠিক হচ্ছে না। তারপর গেলাম এলিফ্যান্ট রোডে অধ্যাপক আলমের কাছে। তিনি বললেন, এখন জ্বরের রোগী দেখি না। আপনি ডাঃ এবিএম আব্দুল্লাহ সাহেবের কাছে যান। তিনি ধানম-ি ৭নং রোডে বসেন। আমি কালবিলম্ব না করে চলে গেলাম। সেখানে এটেনডেন্টকে বারবার তাগাদা দিলাম- আমার শরীর খারাপ লাগছে একটু ঢুকতে দিন। তিনি অল্প সময়ের মধ্যে আমাকে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দিলেন। ডাঃ এবিএম আব্দুল্লাহকে দেখেই ভক্তি এসে গেল। চোখে-মুখে সারল্য। বেশ কিছুক্ষণ সময় দিলেন। ভাল করে স্টেথিসকোপ দিয়ে দেখে বললেন, সম্ভবত আপনার ডেঙ্গু হয়েছে। তিনি আবার চষধঃবষবঃ ঈড়ঁহঃ করতে দিলেন। আমি ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ঈড়ঁহঃ-এর রিপোর্ট নিয়ে গেলাম। তিনি বললেন, আপনার ডেঙ্গু ঐবসড়ৎধলরপ ঋরভঃু ঞযড়ঁংধহফ পড়ঁহঃ মাত্র। ঈবহঃৎধষ ঐড়ংঢ়রঃধষ-এ ভর্তি হয়ে যান। আমি তার কথামতো দ্রুততম সময়ের মধ্যে ভর্তি হলাম। তিনি দ্রুত আমার চিকিৎসার ব্যবস্থা নিলেন। প্রায় সাতদিন হাসপাতালে ছিলাম। তিনি দু’বেলা আসতেন, খোঁজ-খবর নিতেন। যেদিন হাসপাতাল ছাড়ার বিল দিতে গেলাম দেখলাম তিনি তার ভিজিট নেননি। আমি যারপরনাই মুগ্ধ হলাম। আমার সামান্য পরিচয় তিনি জানেন, তাতেই এই সহৃদয়তা, প্রাণটা ভরে উঠল। তারপর বাংলাদেশ টেলিভিশন, এটিএন বাংলা এবং চ্যানেল আইতে কয়েকবার তার সাক্ষাতকার নিয়েছি। তিনি বারবার রোগ প্রতিরোধের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। বাংলাদেশে যেন ডেঙ্গুর বিস্তার না ঘটে সে বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য পত্রপত্রিকায় লেখার পাশাপাশি মিডিয়াতে সরব থেকেছেন। তার কারণেই ডেঙ্গু চিকিৎসা সহজতর হয়েছে। মানুষ অনেকাংশে সচেতন হয়েছে। কেউ বিশ্বাস করবেন- একজন অধ্যাপক মেডিসিনের অদ্বিতীয় বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসক মাত্র তিনশত টাকা ভিজিট নেন! অসমর্থ রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দেন। কখনও ওষুধ কেনার টাকা না থাকলে ওষুধও কিনে দেন। হাসপাতালে ভর্তির ব্যাপারে নিরন্তন সহযোগিতা করেন এবং রোগীরা বিপদে পড়লে মোবাইল ধরেন ও পরামর্শ দেন। তিনি সব সময় ভেজাল ও নকল ওষুধের বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন থাকতে পরামর্শ দেন। কম দামের ওষুধ লেখেন, যাতে মানুষ সহজে কিনতে পারে। আজকে যে ভেজাল ওষুধবিরোধী আন্দোলন তারও পুরোধা ব্যক্তি তিনি। মাদক এবং নেশা জাতীয় দ্রব্যের কারণে তরুণ সমাজের অবক্ষয় রোধে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির জন্য তিনি সব সময় কাজ করে যাচ্ছেন। বিশেষ করে তরুণ সমাজই যে আমাদের ভবিষ্যত সে কথাটি তিনি মনে-প্রাণে বিশ^াস করেন। মেধাবী দরিদ্র ছাত্রদের লেখাপড়ার খরচও বহন করেন। মনে পড়ে একবার কবি শামসুর রাহমান জ¦রে ভুগছিলেন। আমি ফোনে কথা বললাম। রাহমান ভাইকে বললাম, এখন চারদিকে ডেঙ্গু হচ্ছে। একটু ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া দরকার। তিনি রাজি হলেন। আমি আমার ছোট বোন সেতারা এলিনকে অফিসের গাড়ি দিয়ে পাঠালাম রাহমান ভাইকে বাসা থেকে এবিএম আব্দুল্লাহর কাছে নিয়ে যেতে। রাহমান ভাইকে ডাক্তার এবিএম আব্দুল্লাহ পরম মমতায় দেখেছিলেন। পরে শামসুর রাহমান বলেছিলেন, অসাধারণ মানুষ ও চিকিৎসক এবিএম আব্দুল্লাহ। এরকম মানুষ এই একুশ শতকের মুক্তবাণিজ্যের জগতে বিরল। অনেক চিকিৎসক দেখেছি কথা না শুনেই প্রেসক্রিপশন লিখতে শুরু করেন। তিনি রোগীর সঙ্গে অনেকক্ষণ সমস্যা নিয়ে আলাপ করেন, তারপর চিকিৎসাপত্র দেন। যমুনা আর ব্রহ্মপুত্রের তীরে বেড়ে উঠেছেন তিনি। জামালপুর তার জন্ম জেলা। নানা ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে যুক্ত এ জেলার নাম। এ জেলার মানুষের স্বভাবগুণে যে সারল্য ও মানবপ্রীতি তা তার মধ্যে শতভাগ বিদ্যমান। ইসলামপুর উপজেলার হাড়িয়াবাড়ী গ্রামের লোকেরা এখন গর্বের সঙ্গে উচ্চারণ করে আমাদের গ্রামের সন্তান ডাঃ এবিএম আব্দুল্লাহ। প্রফেসর ডাঃ এবিএম আব্দুল্লাহর মা আমেনা খাতুন আর পিতা এটিএম মঞ্জুরুল হকের বুক গর্বে ভরে ওঠে। স্রষ্টার কাছে সন্তানের দীর্ঘায়ু প্রার্থনা করেন। শুধু পিতা-মাতা নন, তার প্রাথমিক বিদ্যালয় কিংবা ইসলামপুর নেক জাহান উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও গর্বের সঙ্গে বলে বেড়ানÑ ডাঃ আব্দুল্লাহ তো আমাদের স্কুলের। বরাবরই মেধা তালিকায় প্রথম। ১৯৯২ সালে লন্ডনের রয়েল কলেজ থেকে এমআরসিপি এবং ২০০৩ সালে যখন এডিনবরা থেকে এফআরসিপি ডিগ্রী নেন তখন চিকিৎসক সমাজে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। জীবনে বারবার দেশের বাইরে থাকার সুযোগের হাতছানি উপেক্ষা করেছেন। এদেশের মানুষ, মাটি ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি দায়বদ্ধ তিনি। মধ্যপ্রাচ্য, ব্রিটেন সব জায়গাতেই সুবর্ণ হাতছানি উপেক্ষা করে তিনি বারবার ফিরে এসেছেন স্বদেশে। পাবলিক সার্ভিস পরীক্ষায় তিনি অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়ে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে তৎকালীন আইপিজিএম আর বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। এত কাজের ফাঁকে সংসার-সন্তানের দায়িত্ব পালনে তিনি সচেতন। তার সন্তানরা মেধাবী এবং মার্জিত বলে জানি। সংসার আর চিকিৎসার জগত কিন্তু তাতেই তার কর্মের সমাপ্তি নয়, বরং সৃজনশীল লেখালেখি, বিশেষ করে চিকিৎসা ও সামাজিক সমস্যাবিষয়ক নিবন্ধ রচনায় তিনি পারঙ্গম। চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্পর্কিত চল্লিশটিরও বেশি নিবন্ধ দেশে ও দেশের বাইরে প্রকাশ পেয়েছে। ৭টি মৌলিক আকর গ্রন্থ। ঝযড়ৎঃ ঈধংবং রহ ঈষরহরপধষ গবফরপরহব গ্রন্থের জন্য ২০১৩ সালে পেয়েছেন ইউজিসি পুরস্কার। ২০১৬ সালটি যেন তার আশীর্বাদের বছর। তিনি এ বছরই পেলেন মার্কেন্টাইল ব্যাংক পুরস্কার। সর্বোচ্চ আনন্দের যে পুরস্কার সেটি একুশে পদক পেলেন এ সালেই। শুধু চিকিৎসার মাধ্যমে রোগী আরোগ্য করার কৌশল করায়ত্ত তা নয়, বৃহত্তর সামাজিক কল্যাণ কর্মেও তিনি নিবিষ্ট। নিজ গ্রামে জমি দান করে কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করেছেন। তৈরি করেছেন মসজিদ, মাদ্রাসা। গ্রামের সাধারণ মানুষের নয়নের মণি ডাঃ এবিএম আব্দুল্লাহ। নির্বাচন করে নেতা হবার জন্য নয়, নিঃস্বার্থ মানবকল্যাণই যার ব্রত তার জন্য অনায়াসে স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা জানাতে সাধ হয়। কিন্তু সামনে তো অনেক কাজ। কথায় কথায় একদিন বললেন, স্বপ্ন আছে বড় কিছু করার। বাংলাদেশে একটি আন্তর্জাতিকমানের হাসপাতাল হোক। আমাদের রোগীরা চিকিৎসার জন্য বাইরে যায় বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে, আমরা উন্নয়নশীল দেশ এটা ঠিক না। দেশের চিকিৎসা কাঠামো ঢেলে সাজানোর পক্ষে তিনি। গরিব মানুষ যেন ঠিকমতো পরিষেবা পায়, সাধ্য না থাকলে সঠিক চিকিৎসা যেন হয় সে বিষয়টিতে তিনি সজাগ। আমি কখনও কখনও অনেক রাতে ফোন করলে তিনি ধরতে না পারলেও ফোন ব্যাক করেন। এত ব্যস্ত, তবু সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে রাখেন। তার মহত্ত্ব দেখে অবাক হই। তার সব কাজে স্ত্রী মাহমুদা বেগমের আছে অকুণ্ঠ সমর্থন-সহযোগিতা। দুটি সন্তানÑ একটি মেয়ে সাদিয়া সাবাহ এবং ছেলে সাদী আব্দুল্লাহ। তারা পিতার মতোই চিকিৎসক এবং সামাজিক মূল্যবোধে মানবিক গুণাবলীতে সমৃদ্ধ। আমরা প্রায়শ বলি দেশে ভাল মানুষ কই? যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ- আমরা যদি রবীন্দ্রনাথের সেই কবিতাটির কথা স্মরণ করি এবং যখন ডাঃ এবিএম আব্দুল্লাহর মতো মানুষ দেখি তখন ভাবতে বাধ্য হই- রবীন্দ্রনাথের অনিবার্য চরণ : দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া একটি ধানের শীষের ওপর একটি শিশির বিন্দু। কিংবা লালনের সেই বিখ্যাত গান- বাড়ির পাশে আরশি নগর সেথায় একঘর পড়শি বসত করে আমি একদিনও না দেখিলাম তারে। আমরা চোখ মেলে মানুষ দেখতে চাই; কিন্তু দেখি না। দেখাটা খুবই জরুরী, কারণ আলোকিত মানুষের দ্যুতি আমাদের প্রশান্তি দেবে, মানবের কল্যাণে ব্যবহৃত হবে যার প্রজ্ঞা। ডাঃ এবিএম আব্দুল্লাহ মানুষের মন জয় করেছেন এবং আলোকিত মানুষের কাতারে প্রথম দিকে স্থান করে নিয়েছেন। তিনি বৌদ্ধিক মতের সহজিয়া মানুষ। তার সাফল্য হোক দিগন্তজোড়া। লেখক : কবি
×