ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

পে স্কেল বিড়ম্বনা

গরিবের ভাতের থালা কেড়ে নিতে যাচ্ছে আরইবি ॥ মধ্যবয়সে মিটার রিডার ও মেসেঞ্জারদের জীবন নানাবিধ সঙ্কটে

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ২৫ অক্টোবর ২০১৬

গরিবের ভাতের থালা কেড়ে নিতে যাচ্ছে আরইবি ॥ মধ্যবয়সে মিটার রিডার ও মেসেঞ্জারদের জীবন নানাবিধ সঙ্কটে

রশিদ মামুন ॥ মাহমুদুর, পল্লী বিদ্যুত সমিতি ঢাকা-২ এর মিটার রিডার ছিলেন। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী নয় বছর চাকরির পর অন্য সমিতিতে যোগ দেয়ার কথা। কিন্তু হুট করে চাকরিটা চলে গেল। আর হবে কি না তারও নিশ্চয়তা নেই। জীবনের ছত্রিশে এসে এই সঙ্কট। তিন বেলা খাবার সঙ্কট, ঘর ভাড়ার সঙ্কট, দুই ছেলে শাকিল আর সাকিবের লেখাপড়ার খরচ যোগাড়ের সঙ্কট। জানতে চাইলে মাহমুদুর কথা বেশি দূর এগেুাতে পারেন না। থেমে থেমে দীর্ঘশ্বাসের ফাঁকে ফাঁকে বলেন, আমি যে এখন কি করব, না করব তার ঠিক নেই। সর্বক্ষণ অন্ধকার দেখি চোখে। কি খাব, কি করে ছেলে দুটোর পড়ালেখা হবে, তার কোন কিছুরই ঠিক নেই। মাহমুদুর (৩৬) এ সঙ্কটে পড়লেও কেউ কেউ জীবনের ৪০ কিংবা ৪৫-এ দাঁড়িয়ে এই সঙ্কটের মুখোমুখি। সরকার পে-স্কেল ঘোষণার পর নিয়ম অনুযায়ী পল্লী বিদ্যুত সমিতির মিটার রিডার এবং মেসেঞ্জারদের বেতনও বাড়ে। বিড়ম্বনার শুরু সেখানেই। কৌশলে গণহারে নিম্ন আয়ের এসব মানুষের চাকরি খেয়ে দিচ্ছে পল্লী বিদ্যুত সমিতির কর্তারা। আগে দু’জন যে কাজ করত এখন একজনকে দিয়ে তা করানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সমিতি। সরকার মানুষের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য নতুন পে-স্কেল ঘোষণা করেছে। অথচ বর্ধিত সুখ তো দূরের কথা এখন চাকরিই থাকছে না। গরিবের ভাতের থালা হেঁচকা টানে কেড়ে নেয়ার কাজটি করছে পল্লী বিদ্যুত সমিতি। অনুসন্ধানে জানা গেছে বাংলাদেশ বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) চেয়ারম্যানের সম্মতি রয়েছে এই কাজে। অভিযোগ রয়েছে, আরইবির ১২ সিনিয়ার জিএম ও জিএমরা মিটার রিডার আর মেসেঞ্জারদের (পিয়ন) সংখ্যা কমানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। সম্প্রতি চাকরি হারানো এসব মানুষ আন্দোলনে নামলে আরইবি চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মঈন গত বৃহস্পতিবার এক জরুরী বৈঠকে মিলিত হন। ওই বৈঠকে সিনিয়র জিএমরা মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে আন্দোলন থামিয়ে দেয়ার আশ্বাস দিয়ে এসেছেন। ভুক্তভোগীরা দাবি করছে তাদের হুমকি ধমকি দেয়া হচ্ছে, কোন আন্দোলনে গেলে গণছাঁটাইয়ের হুমকি দেয়া হচ্ছে। যেহেতু চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ সঙ্গত কারণেই পরিবার পরিজন নিয়ে পথে বসার ভয়ে কথাও বলতে পারছেন না ভুক্তভোগীরা। অবশ্য আরইবি চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মঈন বিষয়টিকে চাকরি হারানো বলে মানতে নারাজ। তিনি দাবি করেন তাদের নিয়োগ চুক্তিভিত্তিক। চুক্তি শেষের পর আর নবায়ন হবে কি না তা প্রয়োজনীয়তার ওপর নির্ভর করে। এখন আমাদের লোক না লাগলে চুক্তি নবায়ন করব কেন? তিনি বলেন, একজন মিটার রিডার বেতন পায় ত্রিশ হাজার টাকা কিন্তু তাকে দিয়ে দ্বিগুণ কাজ করাতে চাইলে তা করবে না, এসব কি মগের মুল্লুক? সত্যিই চাকরি হারানো মানুষের সঙ্গে যা করা হচ্ছে তা মগের মুল্লুক ছাড়া সম্ভব নয়। তিন বছর আগের ২০১৩ এর ১৫ জানুয়ারি আরইবির এক দফতর আদেশে বলা হয়, মিটার রিডার ও পিয়নরা এক সমিতিতে তিন বছর করে মোট ৯ বছর চুক্তিভিত্তিক কাজ করবেন। এরপর চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে অন্য সমিতিতে অভিজ্ঞতার সনদ নিয়ে যোগদান করবেন। এক্ষেত্রে তার বেতন-ভাতা ঠিক থাকবে। সরকারী নিয়ম অনুযায়ী এদের স্থায়ী চাকরিজীবীর মতো সুযোগ সুবিধা ভোগ করার বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু তবুও তিনি অস্থায়ী হিসেবেই বিবেচিত হবেন। সরকারী চাকরির যে বিধান তার থেকে এই প্রক্রিয়া কিছুটা খাপছাড়া হলেও ৫৫ বছর পর্যন্ত অভিজ্ঞতার সনদ নিয়ে বিভিন্ন সমিতিতে এসব কর্মীদের চাকরির সুযোগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পে-স্কেল পাওয়ায় বেতন বেড়েছে। সেখানে আরইবির মিটার রিডার আর পিয়নদের চাকরি যাচ্ছে! ওই দফতর আদেশের চুক্তির মেয়াদ সংক্রান্ত ধারার ১ এর (ক) তে বলা হয়েছেÑ কোন সমিতিতে মিটার রিডার/ মেসেঞ্জারদের তিন বছর চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ২/১ দিনের বিরতি দিয়ে তাদের পূনরায় তিন বছরের চুক্তিতে নিয়োগ হবে। এই প্রক্রিয়া চলবে নয় বছর পর্যন্ত। দফতর আদেশের ১ (খ) তে বলা হয়েছেÑ তিন বছরের তিনটি মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তাদের অন্য সমিতিতে নিয়োগ পরীক্ষা ছাড়াই একইভাবে নিয়োগের সুযোগ প্রদান করতে হবে। অর্থাৎ সেখানেও ২/১ দিনের মধ্যেই নিয়োগ হবে। এত দিন তাই হয়েছেও। এখন নিয়োগের সময়ের শর্তের কথাও মাথায় রাখছে না সমিতি। একজন মানুষ ৫৫ বছর চাকরি করবে আর ৫৫ বছরই অস্থায়ী বা চুক্তিভিত্তিক-এমন নীতি নিয়েও বার বার প্রশ্ন উঠেছে। নিম্ন আয়ের এসব মানুষ আন্দোলন করলেও তাদের নানাভাবে দমিয়ে দেয়া হয়েছে। সেই চেষ্টা এখনও করা হচ্ছে। মাঝে কয়েকবার স্থায়ী করার বিষয়ে আলোচনা হলেও পল্লী বিদ্যুত সমিতির কর্তাব্যক্তিরা তাতে বাদ সেধেছেন। আর এতে জীবনের বিড়ম্বনা আর অনিশ্চয়তা পিছু ছাড়েনি তাদের। বেতন বাড়লে দ্বিগুণ কাজ করতে হবে এমন কোন শর্ত পে-স্কেল ঘোষণার সময় সরকার দেয়নি। আরইবির যেসব স্থায়ী কর্মকর্তা কর্মচারী রয়েছেন তাদের কেউ তো দ্বিগুণ কাজ করছেন না। তাহলে মিটার রিডার আর পিয়নদের মতো গরিব মানুষের প্রতি এই অত্যাচার কেন? সেই প্রশ্নের উত্তর নেই কারও কাছেই। চাকরি হারানোদের একজন সাইদুল রহমান (রয়েল) বলছেন, আমরা জানতে চেয়েছিলাম আমরা ৯ বছর চাকরি করার পর কোথায় যাব। আমাদের বলা হয়েছে অপেক্ষা করুন। কিন্তু কত দিনে সেই অপেক্ষার শেষ হবে তা কেউ বলছেন না। তবে এখন যে নতুন নিয়ম করা হয়েছে তাতে আমাদের আর প্রয়োজন হবে না বলে মনে হচ্ছে। চাকরি হারানোদের অনেকে অভিযোগ করছেন, প্রতিদিন অন্তত ১৫ থেকে ২০ জনের চুক্তির মেয়াদ শেষ হচ্ছে। এসব চুক্তি আর নবায়ন হচ্ছে না। এর অর্থ হচ্ছে তারা চাকরি হারাচ্ছে। গত জুনের মাঝামাঝি সময় থেকে পাঁচ মাসে এই সংখ্যা দুই থেকে আড়াই হাজার। রাষ্ট্রীয় কোন প্রতিষ্ঠানে এভাবে কৌশলে কর্মী ছাঁটাইয়ের উদাহরণ বিরল। সরকারের কাছ থেকেই উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ নিয়েই কাজ করে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড। তবে তাদের গঠন একটু ভিন্ন। গত ১৬ মে আরইবির এ সংক্রান্ত একটি সভার কার্য বিবরণীতে বলা হয়, পল্লী বিদ্যুত সমিতির মিটার রিডারদের অনুমোদিত পদের বিপরীতে কাজ করছেন সাত হাজার ৮১০ জন। এখানে দুই হাজার ৮৮৫ মিটারের বিপরীতে একজন করে মিটার রিডার। অন্যদিকে মেসেঞ্জারদের অনুমোদিত পদ সাত হাজার ৯৬৪ জনের বিপরীতে ছয় হাজার ৭৫ জন কাজ করছেন। দুই হাজার ৫১৫ মিটারের বিপরীতে একজন মেসেঞ্জার এখন দায়িত্ব পালন করছে। আরইবির নির্বাহী পরিচালককে প্রধান করে গঠিত চার সদস্যের একটি কমিটি চার হাজার মিটারের বিপরীতে একজন মিটার রিডার এবং পাঁচ হাজার মিটাররের বিপরীতে একজন মেসেঞ্জার রাখার সুপারিশ করে। আরইবি এই সুপারিশ অনুমোদন করলেই চাকরি হারা মানুষের তালিকা লম্বা হতে থাকে। এখন চাকরি হারানো এসব মানুষ চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। সেই লম্বা তালিকায় স্থান পাওয়া কামাল হোসেন বলছিলেন নিজের অনিশ্চয়তার কথা, স্ত্রীর ওপর ভরসা করতে হচ্ছে তাকে। ছোট একটি চাকরি করেন তার স্ত্রী। কিন্তু তার আয়ে চলা দায়। চাকরি হারানো কামালের একটি ফুটফুটে মেয়ে রয়েছে। মেয়ের ভবিষ্যতের জন্যেই বাবার চাকরিটি দরকার জানিয়ে বলেন, আমরা অনেক চেষ্টা করেছি। বলেছি আমাদের দিয়ে আরও বেশি কাজ করান, তাও চাকরিটি রাখুন। কিন্তু কেউ আমাদের কথা শুনতে চাইছে না। হতাশ কামাল বলেন, কি যে করি কিছুই বুঝতে পারছি না। মিটার রিডার এবং মেসেঞ্জারদের অভিযোগÑ যাদের বিরুদ্ধে তাদেরই একজন সিসিয়ার জিএম ঢাকা-২ ও ৪ পল্লী বিদ্যুত সমিতির দায়িত্বপ্রাপ্ত রবিউল হোসেন বলেন, আমাদের যা গ্রাহক তার থেকে মিটার রিডার ও মেসেঞ্জারের সংখ্যা বেশি। আগের থেকে এখন যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল হয়েছে। এতে একজন মিটার রিডার আগের তুলনায় বেশি কাজ করতে পারেন। এজন্যই নতুন নীতিমালায় মিটার রিডারদের সংখ্যা কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সঙ্গতকারণেই কোন সমিতির অতিরিক্ত মিটার রিডার এবং মেসেঞ্জারের চুক্তির মেয়াদ নবায়ন হচ্ছে না। তবে ভবিষ্যতে কোন সমিতির গ্রাহক সংখ্যা বাড়লে তারা আবার লোক নেয়ার বিজ্ঞপ্তি দেবে। সেখানে তারা আবেদন করতে পারবে।
×