ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বিভিন্ন সংস্থা জমি না ছাড়ায় ইউলুপ প্রকল্প থমকে আছে

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ২৫ অক্টোবর ২০১৬

বিভিন্ন সংস্থা জমি না ছাড়ায় ইউলুপ প্রকল্প থমকে আছে

মশিউর রহমান খান ॥ আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় অনেকটা থমকে আছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) ২২টি ইউলুপ নির্মাণ প্রকল্প কাজ। চলতি বছরের জুন মাসে রাজধানীর ডিএনসিসি এলাকার যানজট কমাতে ও যান চলাচলে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সংস্থাটির মেয়র আনিসুল হক এসব ইউলুপ নির্মাণ কাজ শুরু করা হবে বলে ঘোষণা দিলেও আজ পর্যন্ত প্রকল্প বাস্তবায়নে অগ্রগতিই চোখে পড়ছে না। ইউলুপ নির্মাণের জন্য সরকারের বিভিন্ন সংস্থা তাদের অধিকৃত জমি সিটি কর্পোরেশনকে বুঝিয়ে দিতে রাজি না হওয়ায় এসব ইউলুপ নির্মাণকাজ বিলম্বিত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের হস্তক্ষেপের পরও জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পটির বাস্তবায়নে ধীরগতি দেখা যাচ্ছে। মূলত সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে জমি বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় ফেলে ও অনেকটা গাছাড়া মনোভাবের মাধ্যমে অসহযোগিতার কারণে ইউলুপ নির্মাণ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। ফলে গত এক বছরেও গুরুত্বপূর্ণ এ উদ্যোগটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। পরিকল্পনা গ্রহণ আর ফাইল চালাচালিতেই আজও সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। এ বিষয়ে ডিএনসিসির মেয়র আনিসুল হকের মতে, রাজধানীর যানজট নিরসনে অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প হিসেবে ইউলুপ নির্মাণ কার্যক্রম এগিয়ে চলছে। অতি দ্রুতই এসব ইউলুপ নির্মাণের জন্য সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সক্ষম হওয়ার আশা পোষণ করেন তিনি। তবে বর্তমান অবস্থায় কবে নাগাদ এসব ইউলুপ তৈরির কাজ শুরু করা সম্ভব হবে সংশ্লিষ্ট ২ সিটি কর্পোরেশনের কেউই বলতে পারছেন না। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রায় ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে ডিএনসিসি ও গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন (জিসিসি) সীমানায় ছোট বড় ৬৯টি ক্রসিং বন্ধ করে গাজীপুর থেকে রাজধানীর হাতিরঝিল পর্যন্ত ৩০ কিলোমিটার সড়ক ট্রাফিক সিগন্যালমুক্ত করতে পরিকল্পিত উপায়ে ২২টি ‘ইউ’ আকৃতির গাড়ি পারাপারের সেতু বা ইউলুপ নির্মাণ করতে একটি প্রকল্প হাতে নেয় ডিএনসিসি। নির্মাণের জন্য চিহ্নিত ২২টি ইউলুপের ১২টি ডিএনসিসি এলাকায় এবং ১০টি গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন এলাকায় অবস্থিত। রাজধানীর সামগ্রিক উন্নয়নের লক্ষ্যে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সরকার এমআরটি, বিআরটি, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি প্রকল্পের কাজ ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে ও কতগুলো প্রক্রিয়াধীন অবস্থায় রয়েছে। এসব প্রকল্পের সবগুলোই উন্নত বিশ্বের ন্যায় যাত্রী চলাচল নির্বিঘœ করবে ও রাজধানীর চলমান যানজট কমিয়ে আনবে। জানা গেছে, সরকারের এসব প্রকল্পের সঙ্গে ইউলুপ প্রকল্পটির বাস্তবায়ন সাংঘর্ষিক হবে কি না তা খতিয়ে দেখতে সরকারের সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থা। জমি প্রদান ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার অনেকটা গাছাড়া মনোভাব ও অসহযোগিতার কারণে ইউলুপ নির্মাণ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। ডিএনসিসি সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে গাজীপুর থেকে রাজধানীর হাতিরঝিল পর্যন্ত ২২টি ইউলুপ নির্মাণের জন্য সংস্থাটির পক্ষ থেকে একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। এর প্রাথমিক অংশ হিসেবে ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ একটি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) তৈরি করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। কিন্তু হাতিরঝিল থেকে আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত ডিএনসিসির সীমানা শেষ। অপরদিকে আবদুল্লাহপুর ব্রিজের ওপার থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের সীমানা অবস্থিত। এই ২২টি ইউলুপের মধ্যে ১২টি ডিএনসিসি এলাকায় এবং ১০টি গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন এলাকায় পড়েছে বিধায় মন্ত্রণালয় থেকে পৃথক পৃথক ডিপিপি জমা দিতে বলা হয়। এরপর মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযাযী দুই সিটি কর্পোরেশন আলাদা দুটি প্রস্তাবনা জমা দেয়। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বাস্তবায়নে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না। সূত্র জানায়, মূলত প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ডিপিপি তৈরি করা হলেও ডিএনসিসির নিজস্ব জমি নেই বললেই চলে। প্রকল্পে ইউলুপ নির্মাণের জন্য যেসব স্থানের জমির কথা বলা হয়েছে সেগুলোর প্রায় সবই সরকারী বিভিন্ন সংস্থার। সেসব সংস্থার কাছ থেকে নাগরিকদের সুবিধার্থে ইউলুপ তৈরির জন্য জমি প্রয়োজন তাই এসব জমি ব্যবহারের অনুমতি চেয়ে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কাছে চিঠি পাঠিয়েছে ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ। এ নিয়ে সরকারের অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করছে ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ। উল্লেখ্য, ইউলুপ নির্মাণের জন্য জায়গা নির্ধারণ করতে ডিএনসিসির মেয়র আনিসুল হক গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর সরেজমিনে উত্তরার জসীমউদ্দীন মোড় থেকে টঙ্গী পর্যন্ত পরিদর্শন করেন। পরিদর্শন শেষে মেয়র জানান, যানজট নিরসনে প্রাথমিকভাবে বনানী-কাকলী, এয়ারপোর্ট, উত্তরার জসীমউদ্দীন ও আবদুল্লাহপুরের ট্রাফিক মোড়ে চারটি ইউলুপ নির্মাণ করার প্রকল্প নিয়েছে ডিএনসিসি। পরে ঐ বছরের ২৮ নবেম্বর ইউলুপ নির্মাণ বিষয়ক সভায় ডিএনসিসির পক্ষ থেকে বলা হয়, গাজীপুর থেকে হাতিরঝিল পর্যন্ত ৩০ কিলোমিটার সড়ক ট্রাফিক সিগন্যালমুক্ত করতে ২২টি ‘ইউ’ আকৃতির গাড়ি পারাপারের সেতু বা ইউলুপ নির্মাণ করা হবে। ছোট-বড় মিলিয়ে মোট ৬৯টি ক্রসিং বন্ধ করে এসব ইউলুপ নির্মাণ করা হবে। ডিএনসিসির কর্মকর্তাদের আশা, ইউলুপগুলো হলে রাজধানীর যানজট প্রায় ২৫-৩০ শতাংশ কমে যাবে। দুই ধরনের ইউলুপ নক্সা করা হয়েছে। একটিতে ছোট-বড় দুই ধরনের যানবাহনই চলবে। অন্যটিতে শুধু ছোট গাড়ি চলবে। একটি ইউলুপ থেকে আরেকটি ইউলুপের সর্বনিম্ন দূরত্ব হবে ৮০০ মিটার আর সর্বোচ্চ ৩ দশমিক ২ কিলোমিটার। এসব ইউলুপ দিয়ে গাড়িগুলো স্বাভাবিক গতিতে চলাচল করতে পারবে। ফলে তখন বিভিন্ন মোড়ে কোন ট্রাফিক পুলিশেরও প্রয়োজন হবে না। সূত্র জানায়, ইউলুপগুলো নির্মাণ করতে ৩৭ দশমিক শূন্য ৯ বিঘা জমির প্রয়োজন হবে। এর মধ্যে সড়ক ও জনপথের ৩১ দশমিক ২৫ বিঘা, রেলওয়ের ১ দশমিক ৬১ বিঘা ও সিভিল এ্যাভিয়েশনের ১ দশমিক ৮৩ বিঘা। এসব জমি ব্যবহারের অনুমতি চেয়ে সংস্থাগুলোকে চিঠি দেয়া হয়েছে। এসব জমি খালি আছে, কোন অধিগ্রহণের প্রয়োজন হবে না। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ইউলুপ প্রকল্পের ডিপিপি গ্রহণ করে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে কিছু শর্ত সাপেক্ষে ডিপিপির প্রাথমিক সম্মতি দেয় পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। পরবর্তীতে চলতি বছর এসব শর্তপূরণের জন্য ১২ মে বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে আলোচনায় বসেন ডিএনসিসির কর্মকর্তারা। এ বিষয়ে ডিএনসিসির নির্বাহী প্রকৌশলী ও ইউলুপ নির্মাণ সংশ্লিষ্ট প্রধান কর্মকর্তা খন্দকার মাহবুব আলম জনকণ্ঠকে বলেন, জনগুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনা রয়েছে। এছাড়া সহযোগী সকল সংস্থার সঙ্গে ডিএনসিসি মেয়রের ও সংশ্লিষ্টদের আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কাজ শুরুর প্রক্রিয়া দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। এ বিষয়ে ডিএনসিসি মেয়র আনিসুল হক জনকণ্ঠকে বলেন, যানজট নিরসনে ডিএনসিসি কর্তৃক গৃহীত অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সঙ্গে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তাদের ছাড়পত্র ও মতামত পাওয়ার পর ডিপিপি অনুমোদিত হওয়ার পর প্রকল্প প্রস্তাব অনুযায়ী এটি অতি কম সময়ের মধ্যেই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। তবে কবে নাগাদ কাজ শুরু হবে, তা নির্ধারিত করে বলা সম্ভব নয়। তবে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সংস্থার প্রধানদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক চলমান রয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে জমি নিয়ে সৃষ্ট সমস্যার অতি দ্রুত সমাধান করা সম্ভব হবে। নাগরিক যন্ত্রণা লাঘবে যানজট সমস্যা কমিয়ে আনতে এসব ইউলুপের নির্মাণকাজ শুরু করতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ইউলুপ তৈরি করা গেলে রাজধানীর যানজট ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
×