ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন

নির্বাচনে দল সাজানোর কৌশল নির্ধারণেই শেষ হলো কাউন্সিল

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ২৫ অক্টোবর ২০১৬

নির্বাচনে দল সাজানোর কৌশল নির্ধারণেই শেষ হলো কাউন্সিল

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ সাঙ্গ হলো মিলনমেলা। প্রাচীন দল আওয়ামী লীগ যে যথেষ্ট প্রাজ্ঞ, অভিজ্ঞ ও বিচক্ষণ- তার পরিচয় মিলেছে সদ্য সমাপ্ত সুশৃঙ্খল কাউন্সিলে। অনেকটাই রাজসিক আওয়ামী লীগের জাতীয় এ সম্মেলনের মূল লক্ষ্য কী ছিল, কতটুকুই বা অর্জিত হয়েছে, কেমন হলো নতুন নেতৃত্ব- এ নিয়ে এখন চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। রাজনৈতিক বিশ্লেষক থেকে শুরু করে দলটির বিরোধী পক্ষও অকপটে স্বীকার করেছেন- নেতৃত্বের রদবদল থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের সম্মেলনের সবকিছুতেই ছিল আগামী নির্বাচনের দলের কৌশল, প্রস্তুতি শুরু ও অবস্থানের প্রতিফলন। দেশকে উন্নয়নের সোপানে নিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রোডম্যাপ ঘোষণা, নির্বাচনে প্রস্তুতির ডাক আর রুদ্ধদ্বার কাউন্সিলে অধিবেশনেও নির্বাচনের আবহ ছিল স্পষ্ট। এক কথায়, আগামী নির্বাচনী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সাংগঠনিকভাবে দক্ষ, অভিজ্ঞ এবং সারাদেশ ছুটে বেড়িয়ে দলকে শক্তিশালী করতে পারে, এমন নেতাদেরই কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে বেছে নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বর্তমান কমিটিই আগামী নির্বাচন পরিচালনা করবেন। এ জন্যই দলটির সভাপতি এমন নেতাদের বেছে নিয়েছেন যাদের সাংগঠনিক দক্ষতা আছে, কর্মীদের পাশে থাকার মানসিকতা আছে। যা আগামী নির্বাচনের জন্য দলকে প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে খুবই জরুরী। আওয়ামী লীগের নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সোমবার সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালেও নতুন নেতৃত্বের প্রধান টার্গেটই হচ্ছে আগামী নির্বাচন, তা অকপটেই স্বীকার করেছেন। সম্মেলনের পর দলের এখন প্রধান এজেন্ডা কী হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা দুটি এজেন্ডা হাতে নিয়েছি। এক সাম্প্রদায়িক পরাশক্তিকে পরাজিত করা। দুই আগামী নির্বাচনের জন্য দলের প্রস্তুতি নেয়া। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের মাধ্যমে তৃণমূল থেকে সংঘবদ্ধ হয়ে আমরা আগামী নির্বাচনে জয়লাভ করতে চাই। রবিবার শেষ হয়েছে আওয়ামী লীগের দু’দিনব্যাপী বর্ণাঢ্য জাতীয় সম্মেলন। স্বাধীনতার পর কোন রাজনৈতিক দলের এত সুবিশাল, দৃষ্টিনন্দন ও সুশৃঙ্খল সম্মেলন আগে কখনও হয়নি। প্রধানমন্ত্রী সম্মেলন থেকে আংশিক কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করেছেন। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যেই তিনি পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করবেন বলে জানা গেছে। দলটির এখন সর্বত্র একই আলোচনা- ৮ বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকসহ সম্পাদকম-লী ও কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য পদে কারা আসছেন। সভাপতিম-লী ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদের দিকে লক্ষ্য করলেই স্পষ্ট হবে যে, এসব পদেও আগামী নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে সাংগঠনিকভাবে দক্ষ ও অভিজ্ঞ নেতাদেরই প্রধানমন্ত্রী বেছে নেবেন। ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ পুনর্গঠনে মুখ্য ভূমিকা পালনকারী ড. আবদুর রাজ্জাক ও ফারুক খানকে পদোন্নতি দিয়ে সভাপতিম-লীর সদস্য করাই তার বড় প্রমাণ। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগকে ঢেলে সাজাতে চান- এটিও স্পষ্ট হয়েছে সম্মেলনের কাউন্সিল অধিবেশনে। উন্নয়ন ও পরিবর্তনের ধারাবাহিকতা রক্ষায় দলকে তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আনার লক্ষ্যে জনগণের ঘরে ঘরে গিয়ে প্রচার চালাতে তৃণমূল নেতাদের নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, সামনে নির্বাচন, জনগণের কাছে যেতে হবে। তৃতীয় দফা নির্বাচিত হতে জনগণের ঘরে ঘরে গিয়ে উন্নয়ন, অর্জন ও সফলতার কথা বলতে হবে। সেই সঙ্গে দলকে আরও শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। আগামী নির্বাচনে দলের পরিকল্পনা ও প্রয়োজনীয় মেসেজ নিয়েই তৃণমূল নেতারা স্ব স্ব এলাকায় ফিরে গেছেন। এবারের আওয়ামী লীগের অন্যতম আকর্ষণীয় বিষয় ছিল কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের নির্বাচন। গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোর অধিকাংশই পূরণ করা হয়েছে। এ নিয়ে প্রকাশ্যে কোনরকম ক্ষোভ বা হতাশা দেখা যায়নি। এ দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর পদ-পদবি নিয়ে হাঙ্গামা-হুজ্জত নতুন কিছু নয়। কিন্তু আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে তার ন্যূনতম আঁচড় পড়েনি। সাড়ে ছয় হাজার কাউন্সিলর দলের সভাপতির প্রতি পূর্ণ আস্থা রেখেছেন, গঠিত কমিটি মনেপ্রাণে গ্রহণ করে নিজ নিজ এলাকায় আগামী নির্বাচনে আবারও বিজয়ের দৃঢ় প্রত্যাশা নিয়ে ফিরে গেছেন। দলের নেতৃত্বের জন্য এটি খুবই অনুকরণীয়। দীর্ঘ ৭ বছর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন শেষে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম নিজেই নতুন সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ওবায়দুল হকের নাম ঘোষণা দলটির অভ্যন্তরে শৃঙ্খলা, উদারতা ও গণতন্ত্রের ভিত্তিরই বড় প্রমাণ বলেও অনেকে মনে করছেন। আওয়ামী লীগের ২০তম সম্মেলনে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতেই ছিল সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন। এ নিয়ে দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে হয়েছে বিস্তর আলোচনা। গণমাধ্যমের কাছেও এটিই ছিল চুম্বক আকর্ষণ। দায়িত্বরত সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের সঙ্গে আলোচনায় ছিল সভাপতিম-লীর সদস্য সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের নামও। কিন্তু রবিবার কাউন্সিলে অধিবেশনের দিনে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচনের সময় এলে চমক দেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম নিজেই। সৌজন্যের এক বিস্ময়কর প্রকাশ দেখিয়ে দলের সবাইকে অবাক করে দিয়ে তিনি নিজেই সাধারণ সম্পাদক পদে ওবায়দুল কাদেরের নাম প্রস্তাব করলে কণ্ঠভোটে তা পাস হয়। এরপর সাবেক ও বর্তমান দুই সাধারণ সম্পাদক নিজেদের মধ্যে কোলাকুলি করে সুশৃঙ্খল রাজনীতির অনন্য উদাহরণ তুলে ধরেন সারাদেশের তৃণমূল নেতাদের সামনে। পদ-পদবি নয়, দলই যে প্রধান তারও একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন সৈয়দ আশরাফ। দু’মাস ধরে চলা উৎকণ্ঠা ও জল্পনা-কল্পনার অবসান শেষে নতুন নেতা নির্বাচন করে তাদের কাছে দুই প্রত্যাশা রেখে রবিবার বাড়ি ফিরতে শুরু করেছেন দলের কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃণমূল-সর্বস্তরের নেতাকর্মী ও কাউন্সিলররা। এ দুই প্রত্যাশা হলো- দলকে আরও সুসংগঠিত করা এবং আগামী জাতীয় নির্বাচনেও জয় লাভ করে সরকার গঠন করা। শেখ হাসিনার কাছে আস্থা-বিশ্বাসের জায়গায় পুরনো হলেও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নতুন করে দায়িত্ব পালন করতে এসেছেন ওবায়দুল কাদের। তাই নতুন সাধারণ সম্পাদকের কাছে তৃণমূল নেতাদের দাবি, তিনি শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করে দলকে আরও সুসংগঠিত করবেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনে আবারও দলের বিজয় নিয়ে আসতে কঠোর পরিশ্রম করবেন। কেন সাধারণ সম্পাদক পদে পরিবর্তন? এ বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও আওয়ামী লীগ নেতাদের মূল্যায়ন হচ্ছে, দীর্ঘদিন ধরে সরকারে রয়েছে আওয়ামী লীগ। এ কারণে কেন্দ্রের সঙ্গে মাঠের নেতাদের যোগাযোগ কমে গেছে, সরকারের মধ্যে দল বিলীন হওয়ার অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। কেন্দ্রের সঙ্গে তৃণমূলের একধরনের দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছে। এই দূরত্ব ঘোচানোর প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে সাধারণ সম্পাদকের। এ কারণে হয়তো সাধারণ সম্পাদক পদে পরিবর্তন আনা হয়েছে। তাঁদের মতে, নতুন সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের কমবেশি সব পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। এই সময়ের মধ্যে সব জেলা সফর, ইউনিয়ন-পৌর-উপজেলা নির্বাচন পরিচালনায় মুখ্য ভূমিকাও পালন করেন তিনি। এই নির্বাচনগুলোয় আওয়ামী লীগ ব্যাপকভাবে জয়লাভ করেছে। এ কাজ করতে গিয়ে ওবায়দুল কাদের সারাদেশের দলীয় সাংগঠনিক অবস্থার প্রকৃত চিত্র জানতে পেরেছেন। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও ওবায়দুল কাদেরের সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো হতে পারে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে নিয়ে দলটির কোন পর্যায়ের নেতাকর্মীর শ্রদ্ধা-ভালবাসার কমতি নেই। দলে অসম্ভব জনপ্রিয়ও তিনি। ‘ক্লিন ইমেজের’ মানুষ তিনি। ২০০৭ সাল থেকে দলের একটি খারাপ সময়ের মধ্যে দক্ষতার সঙ্গে নিজের কাজ করেছেন। সততা, বিশ্বস্ততা, জনপ্রিয়তা, ক্লিন ইমেজসহ সব কিছুর বিচারে সৈয়দ আশরাফ অনন্য উচ্চতার শিখড়ে থাকলেও শুধুমাত্র নিজেকে গুটিয়ে রাখার প্রবণতার কারণেই সাধারণ সম্পাদক পদে এই পরিবর্তন। দলটির নানা পর্যায়ে সৈয়দ আশরাফ সম্পর্কে এমন কথা প্রচলিত যে, তাকে সবসময় পাওয়া যায় না, দলের কাজে ততটা সক্রিয় নন। আর আগামী নির্বাচনে প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি আসতে পারে। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনে বিজয়ী হতে হলে আওয়ামী লীগকে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। তৃণমূলে দলের মধ্যে থাকা বিভেদ, দ্বন্দ্ব-কোন্দল দূর করে ঐক্যের বাঁধনে বাঁধতে হবে। এখন মাঠের নেতাদের সক্রিয় করাই সবচেয়ে বেশি দরকার। এ কারণেই সৈয়দ আশরাফের বদলে হয়তো ওবায়দুল কাদেরকে বেছে নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সোমবার রাতে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে মতবিনিময় শেষে বেরিয়ে কয়েকজন জেলার নেতা সাংবাদিকদের বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের উন্নয়নের প্রচার করতে মাঠেঘাটে থেকে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন। আমরা চাই, নতুন সাধারণ সম্পাদকও আমাদের সেই কাজে সহযোগিতা করবেন। সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে দলকে এগিয়ে নিতে আরও অবদান রাখবেন। আশাকরি, দলকে শক্তিশালী এবং আগামী নির্বাচনে বিজয়ের ক্ষেত্রে ওবায়দুল কাদের হবেন সভানেত্রী শেখ হাসিনার একজন বিশ্বস্ত সহযোদ্ধা।
×