নিজস্ব সংবাদদাতা, নারায়ণগঞ্জ ॥ নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার পিয়ার সাত্তার আবদুল লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান কর্তৃক কানধরে ওঠবস করানোর ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত শুরু হয়েছে। তদন্তকারী দল সরেজমিন এসে ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগকারী ছাত্র রিফাত, বিদ্যালয়ের শিক্ষক-ম্যানেজিং কমিটির সদস্য-অভিভাবকসহ ১৯ জনের সাক্ষ্য নিয়েছেন ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) শেখ হাফিজুর রহমান।
সোমবার বেলা ১১টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত একটানা বন্দর উপজেলার কলাগাছিয়া ইউনিয়নের কল্যান্দী এলাকায় অবস্থিত পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের কক্ষে বসে তাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন তিনি। আগামীকাল মঙ্গলবার জেলা সার্কিট হাউজে প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তসহ ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট্র ব্যক্তিদের সাক্ষ্য গ্রহণের কথা রয়েছে। এদিকে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কাজ চলাকালে সাংসদ সেলিম ওসমানের অনুগতরা বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ, বিদ্যালয়মুখী প্রবেশমুখী রাস্তাগুলো ছিল তাদের নিয়ন্ত্রণে। তারা ব্যানার, ফেস্টুন ও প্লাকার্ড নিয়ে অবস্থান নেয়।
বিচার বিভাগীয় তদন্তকারী বিচারক ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) শেখ হাফিজুর রহমান এর সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন সিএমএম আদালতের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট গোলাম নবী ও মাজহারুল ইসলাম। এছাড়া তাদেরকে সহায়তা করেন নারায়ণগঞ্জের চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শহীদুল ইসলাম।
বিচার বিভাগীয় তদন্তকারী ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম(সিএমএম) শেখ হাফিজুর রহমান স্কুলে এসে প্রথমে প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তের বিরুদ্ধে কটুক্তির অভিযোগকারী দশম শ্রেণীর ছাত্র রিফাত হাসানের সাক্ষ্য নেন। পরে তিনি রিফাতের মা রিনা বেগম, ইংরেজী শিক্ষক উত্তম কুমার ও মাসুম মিয়া, বাংলা শিক্ষক আনোয়ার হোসেন, অংকের শিক্ষক মোশারফ হোসেন, ইসলাম ধর্মের শিক্ষক বোরহানুল ইসলাম, সহকারী প্রধান শিক্ষিকা পারভীন আক্তার, ম্যানেজিং কমিটির তৎকালীন সভাপতি ফারুকুল ইসলাম, ম্যানেজিং কমিটির সদস্য মোবারক হোসেন, বাইতুল আতিক জামে মসজিদের ইমাম মাহমুদুল হাসান, মসজিদের মুয়াজ্জ্বিন আব্দুল হাই, শিক্ষার্থী রূপন্তী, মৃদুল হাসান, মাকসুদ, রানা, আসিফ, হামিদুল এর সাক্ষ্য নেন। এদিকে সাক্ষ্য গ্রহণকালে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত স্কুল প্রাঙ্গণে উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে সকাল থেকে পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সাংসদ সেলিম ওসমানের অনুগত হিসেবে পরিচিত জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি আবু জাহের, সাধারণ সম্পাদক আকরাম আলী শাহীন, কলাগাছিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন প্রধান, নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ড্রাষ্ট্রিজের সভাপতি ও নারায়ণগঞ্জ রাইফেল ক্লাবের সভাপতি খালেদ হায়দার খান কাজলের উপস্থিতিতে জাতীয় পার্টি ও স্থানীয় নেতাকর্মীরা প্লাকার্ড, ব্যানার, ফেস্টুন নিয়ে স্কুল প্রাঙ্গণে কয়েকশ’ নারী-পুরুষ জড়ো হয় এবং প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তের শাস্তির দাবি জানায়।
গত ১৩ মে নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার কল্যানদীতে পিয়ার সাত্তার লফিত উচ্চ বিদ্যালয়ে ধর্মীয় অবমাননার কটুক্তির অভিযোগ এনে প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে শাররীকভাবে নির্যাতন ও স্থানীয় জাপা (এ) দলীয় এমপি সেলিম ওসমানের উপস্থিতিতে কান ধরে উঠ বস করানোর ঘটনায় গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ পেলে সারাদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। এদিকে ওই ঘটনার পর পরই প্রধান শিক্ষককে পুলিশ শহরের খানপুরে ৩শ’ শয্যা বিশিষ্ট নারায়ণগঞ্জ হাসপাতালে ভর্তি করলেও সেখান থেকে ৭ দিন পর তাকে ২০ মে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করে পুলিশ। ঘটনার দু’দিন পর প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে চাকরী থেকে বরখাস্ত করা হয়। এদিকে শ্যামল কান্তি ভক্তের লাঞ্ছিতের ঘটনায় সরকারের মন্ত্রীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক মহল থেকে স্থানীয় সাংসদ সেলিম ওসমানকে ক্ষমা চাওয়ার দাবি উঠলেও তিনি সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করেন, শিক্ষককে নয়, নাস্তিককে শাস্তি দিয়েছেন তিনি। এদিকে এই ঘটনায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের গঠিত তদন্ত কমিটি প্রাথমিক তদন্তে প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে ধর্মীয় কটুক্তির অভিযোগ না পেলে ওই শিক্ষকে তার সপদে পুর্ণবহাল ও পরিচালনা পর্ষদ ভেঙ্গে দেয়া হয়। অন্যদিকে প্রধান শিক্ষক লাঞ্ছিতের ঘটনায় হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ সপ্রণোদিত হয়ে এই ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে- জানতে চেয়ে জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের প্রতি রুল জারি করে। পরবর্তীতে উচ্চ আদালতের রুলের জবাবে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করলে আদালত তা দায়সারা গোছের উল্লেখ করে বিচার বিভাগীয় তদন্তের ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমকে তদন্ত করে আগামী ৩ নভেম্বর প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। আগামী ৬ নভেম্বর হাইকোর্টে আদেশের দিন ধার্য্য রয়েছে। গত ৯ জুন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে কড়া পুলিশ প্রহরায় তাকে নগরীর নগর খানপুর এলাকার ভাড়া বাড়িতে নিয়ে আসে পুলিশ।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: