ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রফেসর ড. হারুন-অর-রশিদ

রাজনীতির মূলধারা আওয়ামী লীগ

প্রকাশিত: ০৬:৩৭, ২৪ অক্টোবর ২০১৬

রাজনীতির মূলধারা আওয়ামী লীগ

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এ দেশের একটি অনন্য অসাধারণ রাজনৈতিক দলের নাম। আওয়ামী লীগ দীর্ঘ ৬৭ বছরের সংগ্রামী ইতিহাস ও ঐতিহ্যের পতাকাবাহী একটি প্রতিষ্ঠান। ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠা থেকে আজ অবধি নিরবচ্ছিন্নভাবে বাঙালীর সমাজ-রাজনীতি-সংস্কৃতির মূলধারা সমন্বয়, সমতা ও সম্প্রীতির আদর্শকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বহতা নদীর মতো ধারণ করে চলেছে। স্বাধীনতাসহ জাতির যা কিছু শ্রেষ্ঠ অর্জন এর সিংহভাগ কৃতিত্ব এ দলের। জাতির পিতার নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেই এ দল থেমে থাকেনি, এ রাষ্ট্রের সার্বিক গঠন-গড়নে শুরু থেকে একচ্ছত্র নেতৃত্ব দিয়ে আজ জাতির পিতারই সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ ও সৃজনশীল (ঈৎবধঃরাব) নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে বর্তমান পর্যায়ে তুলে এনেছে দুর্বার এক অভাবনীয় উচ্চতায়, যা সারাবিশে^র জন্য এক বড় বিস্ময়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র এক বছর দশ মাসের মধ্যে বিরোধী রাজনৈতিক দল গঠন কিছুতেই সহজসাধ্য ছিল না। মুসলিম লীগ সরকারের রক্তচক্ষুর ভয়ে সেদিন ঢাকা শহরের কোথাও কেউ সরকারবিরোধী রাজনৈতিক কর্মী সম্মেলনের জন্য হলরুম ভাড়া বা জায়গা দিতে সম্মত হননি। অবশেষে উদ্যোক্তাদের ঠাঁই হলো পুরান ঢাকার কে এম দাস লেনের কে এম বশিরের (হুমায়ুন সাহেব নামে পরিচিত) ‘রোজ গার্ডেন’ বাগানবাড়িতে। বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিম সমর্থক প্রগতিশীল অংশের কর্মীদের উদ্যোগে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার এই সম্মেলন ১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন অনুষ্ঠিত হয়। কারাবন্দী অবস্থায় মাত্র ২৯ বছর বয়সে বঙ্গবন্ধু হলেন এর প্রতিষ্ঠিতা যুগ্ম-সম্পাদক। তবে অচিরেই তিনি পরিণত হন এর প্রাণশক্তিরূপে। ১৯৫৩ সালেই পুরান ঢাকার মুকুল সিনেমা হলে ৩-৫ জুলাই অনুষ্ঠিত দলের কাউন্সিলে তাঁর সাংগঠনিক রিপোর্ট পেশকালে তিনি এই মর্মে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ‘আমাদের এই মহান কাউন্সিল অধিবেশন সাংগঠনিক ও অন্যান্য ব্যাপারে এমন গভীর বাস্তবধর্মী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিবে যে, উহা আমাদের সংগঠনকে উদ্দীপিত ... করিয়া বর্তমান ও ভবিষ্যত গণতান্ত্রিক দুনিয়ার জন্য এক অমর ইতিহাস সৃষ্টি করিবে’। বাঙালীর হাজার বছরের স্বতন্ত্র জাতিসত্তার গঠন-গড়ন প্রক্রিয়ার ভেতর থেকে গড়ে ওঠা স্বাধীনতার স্বপ্ন, সংগ্রাম, লড়াই বা জাতির সার্বিক মুক্তির আকাক্সক্ষা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পকিস্তানী পর্বে মূর্ত হয়ে চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। সৃষ্টি হয় বাংলাদেশ বিপ্লব ১৯৭১। প্রতিষ্ঠা পায় স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র, বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু বাঙালীর এ ইতিহাসের মহানায়ক। আর যে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাঙালী জাতির ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন সে প্রতিষ্ঠানের নাম আওয়ামী লীগ। পুরান ঢাকার রোজ গার্ডেনে প্রতিষ্ঠা হলেও আওয়ামী লীগের চলার পথ কখনই কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। এর কোন সাফল্য বা অর্জনই আলোচনার গোলটেবিলে অর্জিত হয়নি, এজন্য প্রয়োজন হয়েছে কঠিন আন্দোলন-সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ। পাকিস্তান পর্বে ’৪৮-এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু আর ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের মাধ্যমে এর পরিসমাপ্তি। পাকিস্তান ও বাংলাদেশ পর্বের এ যাবত সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যত আন্দোলন-সংগ্রাম ও অর্জন, আওয়ামী লীগ ব্যতিরেকে এর কোন অর্জনই কি ভাবা সম্ভব? আর এসব অর্জনই হচ্ছে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। উল্লেখ্য, প্রতিষ্ঠাকালীন যুগ্ম-সম্পাদকের সময় বাদ দিলে বঙ্গবন্ধু ১৪ বছর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক (১৯৫২-১৯৬৬) এবং ৮ বছর (১৯৬৬-১৯৭৪) সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। অন্যদিকে, জননেত্রী শেখ হাসিনা ১৯৮১ থেকে বর্তমান পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে এ সংগঠনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। যা কিছু আওয়ামী লীগের অর্জন তা অনিবার্যভাবে এ দেশের জনগণেরই অর্জন। ‘আওয়ামী’ অর্থ জনগণ আর ‘আওয়ামী’ থেকে আওয়ামী লীগ। এ দেশের জন-গণ-মন নন্দিত দলের নামই হচ্ছে আওয়ামী লীগ। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী ন্যূনতম সময়ের মধ্যে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠন-পুনর্বাসন সম্পন্ন করে বঙ্গবন্ধু যে মুহূর্তে সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের একটি শক্তিশালী ভিত রচনা ও এর সার্বিক উন্নয়নে মনোনিবেশ করলেন, ঠিক তখনই মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত দেশী-বিদেশী চক্রের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রে সংঘটিত হয় বাঙালীর জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে মর্মান্তিক ১৫ আগস্ট ট্র্যাজেডি। এরপর মোশতাক-জিয়া-এরশাদ-বেগম খালেদা জিয়া ও বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে এ দেশে মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যাখ্যাত সেই পাকিস্তানী সেনা-আমলা শাসন ও সাম্প্রদায়িক ধারার পুনঃপ্রত্যাবর্তন ঘটে। ১৯৮১ সাল থেকে শুরু করে আন্দোলন-সংগ্রামের দীর্ঘ পথে শেখ হাসিনাকে গ্রেফতারবরণ, একাধিকবার গৃহে অন্তরীণ থাকা, প্রায় এক বছর তাঁর শেরে বাংলানগরের নির্জন কক্ষে সাব-জেলে কাটানো, মিথ্যা মামলায় বিশেষ আদালতে বিচারের সম্মুখীন হওয়া, হত্যার উদ্দেশ্যে জনসভাস্থলে বিধ্বংসী বোমা পুঁতে রাখা, জনসভার উদ্দেশ্যে যাত্রাকালে গাড়ি বহরে শত শত রাউন্ড গুলিবর্ষণ ও বহু লোককে হতাহত করা (চট্টগ্রাম, ২৪ জানুয়ারি ১৯৮৮), ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলাসহ ২৪ বার তাঁর প্রাণনাশের উদ্দেশ্যে আক্রমণের চেষ্টা ইত্যাদি তাঁকে অতিক্রম করতে হয়েছে। ক্ষমতার বাইরে তো বটেই, এমনকি ক্ষমতায় থাকাকালীনও আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিকভাবে পরাজিত ও প্রতিক্রিয়াশীল অপশক্তির ষড়যন্ত্র, সন্ত্রাসী তৎপরতা ইত্যাদি মোকাবেলা করে সব সময় এগিয়ে যেতে হয়েছে। সংগঠনগতভাবে আওয়ামী লীগ এক মহান ঐতিহ্যের অধিকারী। যেমন এ বছরের কাউন্সিলসহ দলটি ৬৭ বছরে ২০টি নিয়মিত কাউন্সিল এবং ৫টি বিশেষ কাউন্সিল অধিবেশন এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত করেছে অর্থাৎ বিশেষ কাউন্সিল বাদে গড়ে ৩ বছরে একটি করে নিয়মিত কাউন্সিল। বাংলাদেশে ডান-বাম নির্বিশেষে আর কোন দল এভাবে প্রায় নিয়মিত কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত করতে সক্ষম হচ্ছে বলে মনে হয় না। আওয়ামী লীগ শুধু ক্ষমতা প্রত্যাশী একটি গতানুগতিক রাজনৈতিক দল নয়, আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতির একটি বিশেষ ধারার প্রতিনিধিত্বকারীও। আর সেই ধারাই হচ্ছে বাংলাদেশের মূলধারা। এর সারকথা হচ্ছে সমন্বয়, সমতা ও সম্প্রীতি। দেশের বৃহত্তম, দায়িত্বশীল ও ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আওয়ামী লীগ শুধু দেশ পরিচালনায় নেতৃত্ব দেয় না, একই সঙ্গে দেশবাসীর সম্মুখে তুলে ধরে পথ চলার অগ্রবর্তী চিন্তাও। বাঙালীর সমন্বয় ও সম্প্রীতির আদর্শ, অন্য কথায় অসাম্প্রদায়িকতা হচ্ছে সমাজ-রাজনীতির মূলধারার প্রধান বৈশিষ্ট্য। হাজার বছরের সময় পরিসরে এ আদর্শ সৃষ্টি ও তা ভিত্তি লাভ করে। পাকিস্তান পর্বে ’৪৮-৫২-এর ভাষা-আন্দোলন থেকে শুরু করে বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে তা প্রবল রাজনৈতিক ধারা হিসেবে রূপ লাভ করে। সংগঠনগতভাবে এ পর্বে সকল আন্দোলন-সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগকে রাজনীতির মূলধারা হিসেবে যদি মনে না করা যায় তা হলে ’৪৮ থেকে ’৭১এ সময়ের সকল আন্দোলন, এর আদর্শিক ভিত্তি, পরিশেষে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ইত্যাদির ব্যাখ্যা কী হবে? ধর্মভিত্তিক দ্বিজাতিতত্ত্বের বিপরীতে দাঁড়িয়ে অসম্প্রদায়িক আদর্শের ভিত্তিতেই স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা। অসাম্প্রদায়িকতার আদর্শ যদি প্রধান ধারা না হবে (যার সার্থক প্রতিনিধিত্বকারী দল আওয়ামী লীগ), তা হলে ১৯৭০ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত যতগুলো নির্বাচন হয়েছে তাতে জামায়াতে ইসলামী গড়ে শতকরা ৬ ভাগের বেশি ভোট লাভ করে না কেন? মনে রাখা প্রয়োজন যে, ভোটের সংখ্যা বিচার করেই রাজনীতির মূলধারা বিচার করা যায় না। আমাদের দেশে জিয়া-এরশাদ-খালেদা জিয়ার অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন, এমনকি ‘সালসা’ মার্কা (২০০১) নির্বাচনের কোনটিতেই যে ব্যালটে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেনি বা ঘটতে দেয়া হয়নি তা দেশবাসী সকলের জানা রয়েছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এককভাবে ৪৮.০৪ ভাগ ভোট ও ২৩০টি আসন লাভ করে। পক্ষান্তরে, বিএনপি-জামায়াত জোট ৩৭.২০% ভোট এবং ৩২টি আসন লাভ করে (বিএনপি ৩২.৫০ ভাগ ভোট এবং ৩০টি আসন, অন্যদিকে জামায়াত ৪.০ ভাগ ভোট ও ২টি আসন পায়)। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে নির্মম হত্যার পর দীর্ঘ ২১টি বছর বাংলাদেশ পাকিস্তানী ধারায় পরিচালিত হয়। এ সময়ে বিভিন্ন সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয় ও বিদেশী উৎস থেকে প্রাপ্ত অর্থবলে আমাদের দেশে ধর্মীয় নামাবলি পরিহিত জঙ্গী গোষ্ঠীর উত্থান ঘটে। সামরিক-বেসামরিক গোষ্ঠীর আচরণও ছিল আওয়ামী লীগের প্রতি বৈরী। এমনই একটি চরম প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে ২১ বছর ক্ষমতার বাইরে থেকে পরিশেষে ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠনের সুযোগ লাভ করে। মূলধারার প্রতিনিধিত্বকারী দল বা সংগঠন না হলে আওয়ামী লীগের ওই অবস্থা থেকে কিছুতেই উত্তরণ ঘটার কথা নয়। আওয়ামী লীগ চরম প্রতিকূল অবস্থা থেকে উঠে এসেছে এবং আগের ওই পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তির আর কোন সম্ভাবনা যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নেই তা প্রায় নিশ্চিত করে বলা যায়। আওয়ামী লীগ যদি মূলধারাকেই প্রতিনিধিত্ব না করত তা হলে এর পরিণতি পাকিস্তানের মুসলিম লীগ, ভারতের কংগ্রেসের বেহাল অবস্থা কিংবা বাংলাদেশের বিলুপ্ত বা প্রায় বিলুপ্ত বহু রাজনৈতিক দলের ভাগ্যবরণ করতে হতো। সেটি ঘটেনি এবং ভবিষ্যতেও এর সম্ভাবনা নেই। বরং মূলধারাকে প্রতিনিধিত্ব করে বলেই আওয়ামী লীগের দিন দিন আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা বেশি। লেখক : উপাচার্য, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়
×